রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির পাশে হিন্দিতে লেখা, ‘আমি বাংলার মেয়ে’। তার নিচেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে বসানো উক্তি, ‘মেয়েরা পরের ধন হয়। এবার বিদায় করে দেব।'
কবিগুরু সখেদে লিখেছিলেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?’ ‘সবলা’ কবিতায় বিধাতার উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রশ্নটি রেখেছিলেন 1928 সালে। এখন 2021। এতদিনেও বিধাতা বুঝি মুখ তুলে চাইলেন না। এখনও নারীর ‘আপন’ বলে কিছু আছে কী? তারপর না হয় ভাগ্যের জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন আসবে। এদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীরা আক্রমণের ঊর্ধ্বে নন। ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তর্জনী উঁচিয়ে নারীকে তাঁর ‘আসল স্থান’ চিনিয়ে দিতে সদা তৎপর।
সম্প্রতি সরকারের দলীয় নেতারা নানা ঘটনায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সেইসব মন্তব্যে ক্রমাগতই বিদ্ধস্ত হয়ে চলেছে নারী স্বাধীনতা। বিগত ক'বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীদের ওপর অত্যাচার ও লাঞ্ছনার পরিমাণ বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর নারী নির্যাতনের ঘটনা আগের বছরের তুলনায় প্রায় 7% বৃদ্ধি পেয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়াতেও নারী বিদ্বেষের স্বর ক্রমশই তীক্ষ্ণ হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র একটি প্রতিক্রিয়া ঘিরে বিতর্ক চরমে ওঠে। যদিও বাবুলের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের অভিযোগ এই প্রথম নয়।
কিছুদিন আগেই বাবুল সুপ্রিয় তাঁর নিজস্ব টুইটার হ্যান্ডলে একটি মিম পোস্ট করেন। সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির পাশে হিন্দিতে লেখা, ‘আমি বাংলার মেয়ে’। তার নিচেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে বসানো উক্তি, "মেয়েরা পরের ধন হয়। এবার বিদায় করে দেব।' স্বভাবতই বাবুলের এহেন ট্যুইটের প্রতিক্রিয়ায় নিন্দার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলে। রাজনৈতিক লড়াই লড়তে গিয়ে যে লিঙ্গবৈষম্যের লড়াইও শুরু হবে, তা ভাবা যায়নি। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল, রাজনৈতিক কৌশলের অঙ্গ হিসাবে নিজেদেরকে যতটা বাংলার সঙ্গে একাত্ম করে দেখাতে চাইছে, বিজেপিকে ঠিক ততটাই বহিরাগত শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। ঠিক যেভাবে 2015 সালের বিহার নির্বাচনে নীতিশ কুমার বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে বিহারি বনাম বাহারিতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই বহিরাগত খোঁচার সূত্র ধরেই এসেছে তৃণমূলের নয়া নির্বাচনী স্লোগান, ‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’। সেই স্লোগানের মোকাবিলা করতেই, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র এই কদর্য টুইট।
একজন রাজনীতিবিদ তাঁর প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক কৌশলে মোকাবিলা করবেন সেটাই দস্তুর। কিন্তু পুরুষতন্ত্র ও ক্ষমতা দাঁত-নখ বার করে তেড়ে এলে তা দুশ্চিন্তার বিষয়। নারী মাত্রই ‘পরের ধন’, এমন ভাবনার পেছনে স্পষ্টতই বক্তার মনের গভীরে প্রোথিত ন্যক্করজনক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। ধন-সম্পদের সঙ্গে মানুষ তখনই তুল্য হয়, যখন তার বিক্রয়মূল্য থাকে, সেক্ষেত্রে সেটিকে বলা হবে দাসপ্রথা। অতএব বাবুলের মিম অনুসারে মেয়েরা দাস ব্যবস্থার অধীন। বিয়ের নামে নারী কেনাবেচাকেই প্রকারান্তরে গুরুত্ব আরোপ করলেন তিনি।
সেই টুইট থেকে আরও কী জানা গেল? না, নারী নামক ‘ধন’কে একসময় পরের কাছে বিদায় করে দিতেই হয়। তাতেই নাকি নিস্তার মেলে!
আরও পড়ুন: নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দলীয় পদ পাওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখায় অনুশীলন করেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু সংঘ-লালিত মানসিকতায় তিনি যে যথার্থই দীক্ষিত হয়েছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। সংঘের গুরু গোলওয়ারকর নারীদের সন্তান উৎপাদকের বেশি কিছু ভাবেননি, এমনকি দলিত রমণীকে ব্রাহ্মণ পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ারও নিদান দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, দলিতের সন্তান ব্রাহ্মণ ঔরসজাত হলে, দলিতের জাতিগত মানোন্নয়ন হবে! এখনও উত্তর ভারতের অধিকাংশ নারী নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যায়, আক্রান্ত দলিত বা নিম্নবর্ণের হলে, আক্রমণকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ উচ্চবর্ণের হয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক হাথরসের ঘটনাতেও নির্যাতিতা মেয়েটি দলিত বাল্মিকী সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও, আক্রমণকারীরা ছিলেন উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ভুক্ত।
বিজেপি এবং সংঘ পরিবার তাঁদের এই অভিনব সমাজ নির্মাণ করতে উত্তর ভারতের একটা বড় অংশে সক্ষম হলেও, বাংলায় তাঁদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলার মাটিতে সাধক রামপ্রসাদ আগমনী গান লিখেছেন, ‘এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না; আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ, কারও কথা শুনব না।' যেখানে শাক্ত পদাবলীর সময়েও স্বয়ং দেবী দুর্গাকে বাংলার ঘরের মেয়ের চোখে দেখা হয়েছে, তাঁকে বাপের ঘর থেকে শ্বশুর ঘরে না পাঠানোর প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, সেখানকার মেয়েরা একবিংশ শতকে হঠাৎ ‘পরের ধন’ হয়ে যাবে কীভাবে?
এককালে বিহার-উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে মহাবিদ্রোহের অন্যতম সেনানী উদাদেবী পূজিতা হতেন। এখন সেখানে নারীমূর্তির পুজোর খুব একটা চল নেই। সেখানে রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে স্লোগান ওঠে, ‘নো দুর্গা, নো কালী, অনলি রাম অউর বজরংবলী।' অন্যদিকে বাংলা অনেকদিন আগে থেকেই শাক্তভূমি। এখানে নারীমূর্তির সামনে শক্তির উপাসনা করেন সাধক। তীব্র পুরুষাকার এখানে ধর্মাচরণের সঙ্গে মিশে যায়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের বিপ্লবমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’-এ তো স্বদেশকেই মাতৃজ্ঞানে পুজো করা হয়েছে। আবার বাল্মিকীর রামচন্দ্রের তুলনায় বাংলার কৃত্তিবাসী রামকে কিছুটা ভীরু মনে হয়, পত্নীনিষ্ঠ মনে হয়, অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে বলেন বাংলার রাম ‘স্ত্রৈন’। বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এখনও নারীর স্বতন্ত্র অবস্থান অটুট রয়েছে। সবক্ষেত্রেই যে সফল হওয়া গেছে তা নয়, কিন্তু গোলওয়ারকর কিংবা সংঘ যে চোখে নারীকে দেখে, বাংলা সেই চোখে নারীকে দেখে না।
রাজনৈতিক লড়াইয়ে নিখাদ রাজনীতিই থাকুক। বাংলার এবং দেশের মেয়েরাই ঠিক করুক তাদের ঘর কোনটা হবে। ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর ডাক দেওয়া রাজনীতিবিদরা কার্যত নারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেই শেখেননি। নারীদের আপন বলে কিছুই থাকবে না, মতামত প্রকাশের অধিকার কিংবা গণতান্ত্রিক সত্তা বিকাশের সুযোগ তাঁরা পাবেন না; কেবল পরের ঘরে যাবার জন্য সেজেগুজে মুখ ঢেকে তাঁরা ঘরে বসে থাকবেন- এই জাতীয় মানসিকতা নিয়ে কোনও জনপ্রতিনিধির সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া উচিত নয়।
বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?
যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।
সোশাল মি়ডিয়া আর রাজনীতিতে রামের একচ্ছত্র আধিপত্য় হরণ করে এবার আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণ!
সৃষ্টি আর লয় হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়, তবু আমরা বর্ষার জলে ভিজতে চাই, ভাসতে চাই।
দুর্গাপুজোয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রচারে মত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালির ঈদ নিয়ে আপত্তি ঠিক কোথায়?
তোমার শিল্প নেই, সংস্কৃতিও ঘুচতে বসেছে, ভদ্রজন, তাই কি তোমার এই কৌলীন্য রাখার দায়?