×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • প্রতিবাদী নারীর স্বাধীন সত্তায় বিস্মিত শাসক

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 13-02-2021

    প্রতিবাদে সামিল ভারতীয় মহিলারা

    মহিলারা স্বেচ্ছায় থাকেন না, তাঁদের রাখা হয়এই মনুবাদী ধারণার থেকে স্বাধীন ভারতের বিচারব্যবস্থা কি আজও বের হতে পারেনি? যাঁকে রাখা হয় তিনি হলেন রক্ষিত। শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গে যা হয়, তার ব্যঞ্জনার্থ কি আমরা জানি না? প্রশ্নটি নতুন করে উঠল দিল্লির উপকণ্ঠে আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি নিয়ে দেশের প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। মন্ত্বব্যটি ছিল, ওখানে ওই পরিস্থিতির মধ্যে মহিলাদের কেন রাখা হয়েছে?

     

    শাহিনবাগ হোক বা সিংঘু সীমান্ত, কিংবা পার্ক সার্কাস থেকে চেন্নাই, সামনের সারিতে রয়েছেন সাধারণ ঘরের মহিলারা। একটা সময় যাঁরা বাড়ির চার দেওয়াল বা বড় জোর পাড়ার মধ্যেই আবদ্ধ থাকতেন তাঁরাই সমস্ত আগল ভেঙে গর্জে উঠছেন অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে। নয়া নাগরিকত্ব আইন, কৃষি সংস্কার আইনের প্রতিবাদই হোক বা অঙ্গনওয়ারি কর্মীদের দাবি আদায়ের লড়াই কোথাও গিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এক জায়গায় – নারীর অগ্রণী প্রতিবাদী ভূমিকায়। 

     

    আড়াই মাস ধরে চলা কৃষি আন্দোলনে সামনের সারিতে মহিলাদের অবস্থান আগে কোনও কৃষক আন্দোলনে দেখা যায়নি। এবার শুধু মহিলারা এগিয়ে এসে পথে নেমেছেন তাই নয়, তাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বক্তৃতাও দিচ্ছেন। উদ্বুদ্ধ করে আরও বেশি সংখ্যক মহিলাদের এই আন্দোলনে সামিল করছেন। তাঁরা যেন উদ্যম আর সাহসের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অন্যদিকে চেন্নাইয়ে অঙ্গনওয়ারি, মিড ডে মিলে কর্মরত মহিলারা পথে নেমেছেন তাঁদের দাবি নিয়ে। ফুল টাইম কাজ করার পরেও কেন ঠিকা কর্মীদের মতো সুবিধা পাচ্ছেন, কেন পাচ্ছেন না অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও। এর জন্য তাঁরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন

     

    এই বছরের জানুয়ারি মাস যদি পাঞ্জাব-হরিয়ানার মহিলাদের হয় তবে, গত বছর অর্থাৎ 2020 জানুয়ারি মাস শাহিনবাগের দাদিদের। বয়সকে উপেক্ষা করে তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন। জহরলাল নেহেরু থেকে জামিয়া, আলিগড় থেকে যাদবপুর, নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সামনের সারিতে মেয়েদের দেখা গিয়েছে বারংবার। ভারতের মাটিতে নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের আগে এতদিন ধরে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন চলতে দেখা যায়নি যার নেতৃত্বে মহিলারা ছিল। একবিংশ শতাব্দী যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে এতদিন যে যে বিষয়গুলোতে পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার, আনাগোনা ছিল তা আর আগামীদিনে থাকবে না। মেয়েরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার, নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। 

     

    তবে মহিলারা যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে নজির গড়ছেন তা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কিভাবে দেখছে? মানতে পারছে কি? যে মহিলারা এই আন্দোলনগুলোয় যোগদান করেছেন তাঁদের পরিবারের সমর্থন তাঁদের সঙ্গে থাকলেও সমাজের এক অংশ যে মেনে নিতে পারছে না তা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির কথাতেই স্পষ্ট ধরা পড়েছে। যে হাত রুটি গড়ে, পতিসেবা করে সেই হাত যখন ট্র্যাক্টর চালিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে যায় সমাজের চোখে তো তো লাগবেই। যে দেশে আজও কন্যা ভ্রূণ হত্যা চলে সেখানে এই বিষয়গুলো যে অস্বস্তির কারণ হবে, তা তো স্বাভাবিক। তাই তো মাননীয় প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন কেন এই ঠাণ্ডায় মহিলাদের রাখা হয়েছে’। হ্যাঁ আজও মহিলাদের রাখা হয়’। তাঁরা যোগ দেন না। মেয়েরা যেন ঘরের কোণে রাখা সুন্দর ফুলদানিটা। টোঁকা লাগলেই ভেঙে যাবে। তাই তাঁরা আন্দোলনে কেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারে! কিন্তু এঁরাই মাইলের পর মাইল হেঁটে জল জোগাড় করে আনে, পিঠে সন্তানকে বেঁধে দুমুঠো খাবার জোগাড়ের তাগিদে কাজ করেন। তখন তাঁদের কষ্ট হয় না। অথচ সরকারের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পথে নেমে আন্দোলন করলে তাঁদের কষ্ট হয়। 

     

    হায় প্রতিষ্ঠান! হায় সরকার! হায় বিচারব্যবস্থা! সমাজ যখন বহুদূর পথ হেঁটে গিয়েছে, তখন তারা কোথায় পড়ে? মেয়েরা কোনও জিনিস’ না যে তাদের রাখতে হবে। তাঁরা মানুষ, তাঁদের অধিকার জ্ঞান আছে। তাঁরা জানে কোনটা তাঁদের প্রাপ্য আর কোনটা তাঁদের ছিনিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। আজ যখন মেয়েরা সমস্ত আগল ভেঙে জিনিসগুলো সহজ করে তুলছে, দেখিয়ে দিচ্ছে এভাবেও পারা যায়’, তাহলে সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠান কেন এগিয়ে এসে তা মানতে পারছে না? কেন একাংশের চিন্তা ধারণা আজও বদলাচ্ছে না? সমাজ এগোলেও সমাজ ব্যবস্থা এগোতে পারছে না কেন? আন্দোলনগুলো যেমন একদিকে নজির তৈরি করছে তেমনই এই প্রশ্নগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরছে। 

     

    রাজধানীর বুকে ঘটে চলা একের পর এক আন্দোলনে থাকা মহিলারা তার হাঁড়কাপানো ঠাণ্ডা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বাথরুম যাওয়ার সমস্যা সহ নানান অসুবিধা অগ্রাহ্য করে যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তা তো আর তাঁরা আন্দোলনজীবী বলে নয়। কোনও বিপদ ঘটলে তার প্রথম আঁচ বাড়ির মহিলাদের গায়ে এসেই লাগে। নতুন কৃষি আইনে কৃষক পরিবারের আয় কমে গেলে মহিলাদেরই প্রথম তাঁদের সংসারের খরচ কমাতে হবে। সমস্যা যখন পরিবারের সকলের, বিপদের আঁচ যখন তাঁর গায়েও লাগছে তাহলে নারী কেন পথে নামবে না? কেন লড়াই করে নিজের অধিকার বুঝে নেবে না?

     

    অন্যদিকে নয়া নাগরিকত্ব আইন সব থেকে বেশি ভয় দেখাচ্ছে সেই মহিলাদেরই। কেন? আজও এমন বহু মানুষ আছেন যাঁদের জন্মের নথি নেই, নেই বিবাহের প্রমাণপত্র। বহু বিবাহের রেজিস্ট্রেশন হয় না সরকারি ভাবে। ভারতে প্রতিবছর কম বেশি 2 থেকে 2.5 কোটি বিয়ে হয়, তথ্য অনুযায়ী কম বেশি 1কোটি বিয়ে নথিভুক্ত হয়। যাঁদের নাম কোনও ভাবে নথিভুক্ত হয় না, তাঁরা কী প্রমাণ দেখাবে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করার জন্য? বিয়ের পর ঠিকানা এবং নাম পরিবর্তন মহিলারই হয়।  নাগরিকত্ব প্রমাণ তাঁর পক্ষে বেশি কঠিন পুরুষের তুলনায়। তাই মহিলারা সমস্ত বাধা অতিক্রম করেও গত বছর নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। 

     

    তেমনটাই ঘটছে চেন্নাইতে। বহুদিন ধরে অঙ্গনওয়ারি, মিড ডে মিলের কর্মীরা তাঁদের বেশ কিছু দাবি রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করে চলেছিল। কিন্তু সুরাহা হচ্ছিল না কোনও সমস্যারই। তাই বাধ্য হয়ে এবার তাঁরা পথে নেমেছেন। তাঁরা ফুল টাইম কাজ করলেও কেন তাঁদের ঠিকাকর্মীর মতো ব্যবহার করা হয় বা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওঁরা। তাঁদের দাবি যে 4.5 লাখ ভ্যাকেন্সি আছে তা সত্বর পূরণ করতে হবে, 3.5 লাখ কর্মীকে "টাইম স্কেল পে" আওতায় আনতে হবে। অবসরের সময় এককালীন 5 লাখ টাকার গ্র্যাচুইটি দিতে হবে সঙ্গে 7850 টাকা মাসিক পেনশন শুধুমাত্র মহিলাদের এই আন্দোলনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে হজম রা কঠিন।

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    নাছোড় বৃষ্টিতে নাজেহাল ভারতবাসী।

    এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে

    সরকারি স্কুলের বাচ্চারা তো স্কুলে ফিরল, বেসরকারি স্কুলের বাচ্চাদের কী হবে?

    স্বামী ধর্ষণ করলেও সেটা ধর্ষণই কর্নাটক হাইকোর্টের এই রায় বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে নতুন ভাবনার দরজা খুলে দ

    জয় শ্রীরাম বনাম জয় বাংলা ধর্মীয় সত্তার রাজনীতি বনাম ভাষা সত্তার রাজনীতি

    নতুন প্রকাশিত ছবি ‘অল্প হলেও সত্যি’ কতটা দাগ কাটল দর্শকদের মনে?

    প্রতিবাদী নারীর স্বাধীন সত্তায় বিস্মিত শাসক -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested