×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • না মানে না, হাইকোর্টও বলল!

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 25-03-2022

    নিজস্ব ছবি

    দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের মুখে পিঙ্ক সিনেমার ডায়লগ:  “না মানে না।” সেটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ছিল না। এবার কর্নাটক হাইকোর্ট স্বামী স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেও নারীর শরীরের উপর তার নিরঙ্কুশ অধিকারকে মর্যাদা দিল। দেশের আইন অনুসারে এখনও বৈবাহিক ধর্ষণ ধর্ষণের অপরাধ বলে গণ্য হয় না। এই আইনও পুনর্বিবেচনা করার জন্য হাইকোর্ট অনুরোধ করেছে সরকারকে।  অনেক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল কর্নাটক হাইকোর্টের এই রায়।

     

    লড়াইটা শুরু হয়েছিল 1887 সালে, যা এখনও চলছে। গঙ্গা পদ্মা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেলেও এতটুকু বদল আসেনি ভাবনায়, মননে। 1887 সালে প্রথমবার রুকমা বাই নামক এক মহিলা বম্বে হাইকোর্টে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করেন বৈবাহিক ধর্ষনের অভিযোগে এনে। তিনি স্পষ্টই জানান যে তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান না। কিন্তু তাঁর চাওয়া না চাওয়ায় কী এসে যায় বা যেত? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে তখন বাধ্য করে "স্বামীর ঘর' করতে!

     

    কাট টু, 1889 সাল, দশ বছর বয়সী ফুলমণি দাস তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী স্বামী হরি মিত্রের পাশবিক অত্যাচার সইতে না পেরে মারা যায়। তখন যেন একটু নড়েচড়ে বসল আইনের স্রষ্টারা। তাঁরা ভাবলেন, এবং নতুন আইন আনলেন, পোশাকি নাম "এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট 1891' অথবা "অ্যাক্ট টেন অফ 1891', এখানে শারীরিক সম্পর্কের জন্য স্বইচ্ছায় সম্মতি জানানোর বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে মাত্র বারো করা হল। ভাবুন, বারো বছর মানে সিক্স, সেভেনের ছাত্রী। কতটুকু বোধ তার এসব ব্যাপারে, যে সে তার স্বামীর ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে মতামত জানাবে? তবুও আইন এল, বিবাহিত এবং অববিবাহিত মেয়েদের সুরক্ষার্থে। সারদা আইন নামে পরিচিত এই আইন নিয়েও বিস্তর চর্চা হয়েছিল তখনকার সমাজে। এটাকেই মেয়েদের অধিকার রক্ষার পক্ষে বড় জয় মনে করা হয়েছিল। আসলে আইন প্রণয়নকারীরা বুঝেছিলেন বৈবাহিক ধর্ষণ কতটা অন্যায় এবং অপরাধ, কিন্তু তাঁরা ভেবেছিলেন যেহেতু "বিয়ের পর স্বামীর সম্পূর্ন অধিকার থাকে তাঁর স্ত্রীর শরীরের উপর' তাই বুঝি বিয়ের বয়সের সঙ্গে সম্মতি দেওয়ার একটা যোগ আছে। আর এখানেই গণ্ডগোলটা থেকে যায়। 

     

    এরপর 1929 সালে বাল্যবিবাহ রোধের জন্য মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে 18 এবং ছেলেদের 21 করা হয়। অথচ বর্তমানে এজ অফ কনসেন্ট 15 বছর। অর্থাৎ পনের বছরের নিচে কোনও বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে যদি জোর পূর্বক যৌনসংসর্গ করা হয় তাহলে সেটা অপরাধ, বাকিগুলো নয়। এদিকে দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স 18অর্থাৎ দেশে যে কোনও বিবাহিত মেয়ে বিয়ের পর ধর্ষনের শিকার হতে পারে, এবং সেটা অপরাধ নয়। কারণ এখনও মনে করা হয় বিয়ে মানেই স্বামীর তার স্ত্রীর উপর সম্পূর্ন অধিকার আছে। স্ত্রীর মতের গুরুত্ব নেই। সে যদি কাছে আসতে না চায়, স্বামী জোর করতেই পারে, এবং সেটা "জাস্টিফায়েড"! সমাজের এখনও অনেকেরই ধারণা বিয়ের পর আবার ধর্ষণ কী? বর কখনও ধর্ষণ করতে পারে! বিয়ের পরেই কাছে আসা উচিত, তার জন্যই তো বিয়ে, সেখানেই আবার না কেন! আর এই ভাবনাগুলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে। নইলে ভারতীয় দণ্ডবিধির সেকশন 375 এখনও থাকে! যেখানে বলাই হয় বৈবাহিক ধর্ষণ কোনও অপরাধ নয়। অতীতে সারদা আইনের বিরুদ্ধে যে কটি পত্রিকা লেখালিখি করেছিল তাদের সবার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল! বঙ্গদর্শনের সার্কুলেশন 20 হাজার বেড়ে গিয়েছিল, অমৃতবাজার পত্রিকা সাপ্তাহিক থেকে নিয়মিত দৈনিক হিসেবে প্রকাশ হতে শুরু করেছিল। এখনও বৈবাহিক ধর্ষণের প্রসঙ্গ উঠলে শোনা যায় শাসকের মাতব্বরি কণ্ঠস্বর, আমাদের ভারতয় সমাজে ওই সব হয় না! দিন বদলেছে, কিন্তু সমাজ এবং তার ঘুণে ধরা ভাবনার বদল ঘটেনি এতটুকু। 

     

    আরও পড়ুন:যাদের ‘লক্ষ্মী’ হওয়া হল না

     

    কোনও মহিলা আজও যদি তাঁর উপর ঘটা পাশবিক অত্যাচারের কথা থানায় রিপোর্ট করতে চান তাহলে স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতন, ইত্যাদির কেস দেওয়া হয়। কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ? নৈব নৈব চ! বৈবাহিক ধর্ষনের কারণে ডিভোর্স? ওরে বাবা! তাহলে তো "মেয়েটার জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে"। হ্যাঁ, কারণ এখনও ডিভোর্সী মেয়েদের জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল বলে মনে করা হয়। অথচ একটি নামী ইংরেজি পত্রিকার পরিসংখ্যান বলছে 18-49 বছর বয়সী ভারতীয় মহিলাদের উপর করা শারীরিক নির্যাতনের 30 শতাংশই তাঁর পরিবারের কোনও পুরুষ করেন। তারপরেও মেয়েরা কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেন না। নিলে তাঁর দিকেই আঙুল তোলা হয়, তাঁর জীবন নষ্ট হয়ে গেল বলে মনে করা হয়। 

     

    কাট থ্রি, 2017 সাল কর্নাটকে এক মহিলা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষনের অভিযোগে আনেন তিনি জানান তাঁর স্বামী তাঁর উপর কী ভাবে অত্যাচার করত, মেয়ের সামনে তাঁর সঙ্গে যৌন আচরণে লিপ্ত হত, তাঁকে যৌনদাসী বানিয়ে রাখত। এরপর এতদিন দীর্ঘ লড়াই পেরিয়ে অবশেষে কর্ণাটক হাইকোর্ট সেই মহিলার পক্ষে রায় দিল। 

     

    বিচারপতি এম নাগাপ্রসন্ন রায়ে বলেন," একজন মানুষ একজন মানুষই; একটি কাজ একটি কাজই; ধর্ষণ একটি ধর্ষণই, সেটা যতই একজন পুরুষ যে মেয়েটির স্বামী তার দ্বারা করা হোক না কেন!' হ্যাঁ, ধর্ষণ ধর্ষণই। সেটা কে করেছে বিচার্য নয়। একজন নারীকে অমতে তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করা হলে সেটা ধর্ষণ হিসেবেই গণ্য করা হবে। স্রেফ স্বামী বলে পার পেয়ে যাবে না। "পিঙ্ক' সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের মুখে একটি ডায়লগ শোনা গেছিল, "একজন নারী সে আপনার স্ত্রী হোক, প্রেমিকা হোক, এমনকি কোনও যৌনকর্মীও যদি না বলে তার মানে সেটা না। উল্টো দিক থেকে না বলা মানে আপনার থেমে যাওয়া উচিত। না নিজেই একটা বাক্য।' কোনও মেয়ের অনিচ্ছায় তাঁকে স্পর্শ করা যাবে না। তাঁর না মানে না এটা যেন সকলে মনে রাখেন। 

     

    বিচারপতি নাগাপ্রসন্ন আরও বলেন, আমার বিবেচিত দৃষ্টিতে, কোনও পুরুষ, স্বামী হওয়ার সুবাদে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার লাইসেন্স প্রদান করতে পারে না। ধর্ষণ যদি স্বামী করে থাকেন তাহলে তিনি শাস্তির উর্ধ্বে নন। তিনি  একই সঙ্গে আইনসভাকে অনুরোধ করেন গোটা বিষয়টি আরেক বার ভেবে দেখার জন্য। 

     

    আরও পড়ুন:লড়াকু লক্ষ্মী: 2, নিজের কিছু করার জেদ থেকেই দীপান্বিতা আজ অনন্যা

     

    এতদিন বিয়ের বয়স এবং সম্মতি এই দুটোকে আলাদা করে দেখা হয়নি। বিয়ে হলেই যেন সব বিষয়ে মেয়েটি সম্মতি দেবেই এমনটা ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু তা নয়। অবশেষে সেটা বুঝেছে কিছু মানুষ। কর্ণাটক হাইকোর্টের রায় সেটাই প্রমাণ করে। যদিও লড়াই এখনও শেষ হয়নি, এখনও দীর্ঘ পথ বাকি যতদিন না আইন করে বৈবাহিক ধর্ষণকেও অপরাধের আওতায় আনা হচ্ছে ততদিন রুকমা বাই, ফুলমণি, কিংবা কর্ণাটকের মহিলার মতো আরও শত শত ভারতীয় মেয়েদের লড়াই শেষ হবে না। তবুও আশার কথা এই যে একটু হলেও বদল দেখা গিয়েছে। এবার যেন সত্যি "নারী দিবস' পালিত হল। 

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    2021 -এ উত্তর পূর্ব ভারতে প্রায় 30-60 শতাংশ ঘাটতি দেখা গিয়েছে প্রাক বর্ষার বৃষ্টিতে।

    কার্গিল যুদ্ধের নায়ক বিক্রম বাত্রার জীবনের নানান গল্প তুলে ধরেছে শের শাহ।

    বাংলার সঙ্গীত জগৎ আপাতত ডিজিটাল কনসার্টময়।

    ক্রমাগত ভাঙনের ফলে ফুলহার নদ এবং গঙ্গার ব্যবধান এক কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে

    ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্য তথা সাংস্কৃতিক জগতে এক বিশাল শূন্যতা রচনা করে চলে গেলেন বিরজু মহারাজ। 

    যাবেন নাকি একবার ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে? গেলেই কিন্তু হারিয়ে যাওয়া যায়!

    না মানে না, হাইকোর্টও বলল! -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested