×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • করোনার সুযোগে সিলেবাসে বেছে বেছে কোপ

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 14-07-2020

    এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে

    বাস্তবে হীরক রাজা নেই তো কী? তার ভাবনার উত্তরসূরীরা দিব্যি রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। COVID 19-এর জন্য নিয়মিত ক্লাস করা যাচ্ছে না। পড়াশোনার চাপ বাড়ছে। তাই সিবিএসই বোর্ডের  ক্লাস 9-12-এর বিভিন্ন বিষয়ের বেশ কিছু অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে, যাতে পড়াশোনার চাপ কমানো যায়। সিলেবাসের বোঝা অন্তত 30% কমানোর কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী রমেশ নিশাঙ্ক পোখরিয়াল।

    কিন্তু কোন বিষয়ের কী কী বাদ পড়ল? অর্থনীতি, জীবনবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ের সিলেবাসের বাদ পড়া অংশের হিসেব নিলে একটা পরিষ্কার ছক ধরা পড়ছে। কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের পক্ষে অসুবিধাজনক বিষয়ই বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে। 

    জীবনবিজ্ঞান থেকে বাদ গিয়েছে বিবর্তন এবং বাস্তুসংস্থান-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিবর্তনবাদ- যা শেখায় মানুষের আবির্ভাবের পিছনে ঈশ্বরের হাত নেই, যা রয়েছে তা বিজ্ঞান। মনে রাখা দরকার, খ্রীষ্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের কট্টরপন্থী শিক্ষার ধারায় ডারউইনের বিবর্তনবাদ আজও অত্যন্ত অস্বস্তিকর বিষয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। রামমোহন বিদ্যাসাগরের প্রদর্শিত শিক্ষার পথের একেবারে উল্টো দিকে যাত্রা হল বিবর্তনবাদ, যা জীববিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তেমনই বাস্তুসংস্থানও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জঙ্গলের গুরুত্ব, তার সঙ্গে জড়িত থাকা বহু মানুষের অরণ্য সম্পদের উপর নির্ভরতা ইত্যাদির শিক্ষা দেয়। সর্বত্র বনসম্পদ ধ্বংস করে খনি স্থাপন এবং উন্নয়নের মডেল নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায় জীববিজ্ঞানের এই শাখা। এগুলিই কেন বাদ? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক পার্থিব বসু জানিয়েছেন, “গোটা ব্যাপারটাই ইচ্ছেমতো করা হয়েছে এবং উদ্দেশ্যটা বুঝতে কারও অসুবিধে হচ্ছে না। বিবর্তনের মতো অধ্যায় বাদ দেওয়া দেখে অবাক হচ্ছি না। যে সরকারের মন্ত্রী বলেন বাঁদর থেকে মানুষ এসেছে এর কোনও প্রমাণ নেই, কারণ বাঁদরকে কেউ মানুষ হতে দেখেনি সেই সরকার তো বিবর্তনবাদকে সিলেবাস থেকে বাদ দেবেই। অবশ্য এরা প্রথম নয়, যারা বিবর্তনবাদকে স্কুল পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিল। বিশ্বে বারংবার বহু জায়গায় বিবর্তনকে স্কুল পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।“ বাস্তুসংস্থান হল আন্তঃসম্পর্কের বিজ্ঞান, যা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। পার্থিববাবুর মতে, এই জরুরি অধ্যায় বাদ দেওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয়। ‘দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ এভোলিউশন্যারি বায়োলজিস্টস’ সংস্থার সদস্যরাও অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন জীবনবিজ্ঞান থেকে বিবর্তন এবং বাস্তুসংস্থান বাদ দেওয়ায়। তাঁদের মতে, “এই অধ্যায়টিই হল প্রথম ধাপ কোনও পশুসৃষ্ট মহামারী রোগ যেমন COVID 19-কে বোঝার জন্য। যদি সেটাই আর না থাকে তবে তারা বুঝবে কীভাবে? এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক।“

    অর্থনীতি থেকে বাদ গিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা অধ্যায়। একই সঙ্গে, বিজনেস স্টাডিতে আর ডিমনিটাইজেশন বা নোট বাতিল নেই। যার জন্য গোটা দেশ তোলপাড় হল, অর্থনীতির যে ধাক্কা চার বছরেও সামলানো গেল না, সেই গোটা নোট বাতিল অধ্যায়টাই বাদ দিয়ে দেওয়া হল! কেন? বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায়চৌধুরীর বক্তব্য, “বাদ দেওয়ার একটা কারণ থাকবে তো, এক্ষেত্রে তো সেটাই স্পষ্ট না। এটা অত্যন্ত জরুরি অধ্যায়, কী হয়েছিল কেন হয়েছিল তা জানা প্রয়োজন ছাত্রদের।“ বাদ যাওয়ার নির্দিষ্ট কারণ অজানা, সিবিএসই বোর্ডও কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে নোট বাতিল যে এখন বিজেপি-র প্রিয় বিষয় নয়, তা তো স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের কোনও নেতাই আর এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। 

    রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাসের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই বিষয়গুলোতেই কোপ পড়েছে, যেগুলো জানলে পরবর্তীকালে আজকের 9-12 এর পড়ুয়ারা প্রশ্ন তুলতে পারে বা তাদের অধিকার বুঝে নিতে চাইতে পারে। মৈত্রীতন্ত্র, নাগরিকত্ব, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক, ভারতের সামাজিক এবং নতুন সামাজিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার সহ বিভিন্ন জরুরি অধ্যায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে সিলেবাস কমানোর নামে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবাজী প্রতিম বসু বলেন, “যারা স্কুলের পাঠ্যসূচি নির্বাচন করেন, তাঁদের উপরেও চাপ থাকে যে কোনটা বাদ দিতে হবে এবং কোনটা রাখতে হবে। এই গোটা ঘটনা দেখে বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হয়েছে, যা সরকারের জন্য অস্বস্তিকর তাই বাদ দেওয়া হয়েছে। শব ব্যবচ্ছেদের মতোই সিলেবাস ব্যবচ্ছেদ হয়েছে, এবং তাতে বহু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাদ গিয়েছে।" তিনি সমাজবিজ্ঞান থেকে বাদ যাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার সহ বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে বলেন, “সমাজবিজ্ঞান মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, আর সেই পথগুলোই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আজকাল সমস্ত জানলা বন্ধ করা যায় না। যারা জানতে চায়, শিখতে চায়, তারা ঠিক তা জেনে নেয়।“ কিন্তু বেছে বেছে এই অধ্যায়গুলোতেই কোপ কেন পড়ল? পাছে ছাত্ররা নিজেদের অধিকার বুঝে নিয়ে প্রশ্ন তোলে এই ভয়ে? রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য সব্যসাচী বাসু রায়চৌধুরী এই বিষয়ে জানান, “যেগুলো বাদ গিয়েছে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এনারা জানিয়েছেন, শুধুমাত্র এ বছর প্যান্ডেমিকের জন্য সিলেবাস কমানো হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, কারণ বিজ্ঞান, অঙ্ক, সাহিত্য সব কিছু থেকেই সিলেবাস কমানো হয়েছে। তবুও যখনই দিল্লিতে সরকার বদল হয়, যারা ক্ষমতায় আসেন তাঁরা তাঁদের পছন্দ মতো স্কুলের পাঠ্যসূচি বদল করেন, বিশেষ করে ইতিহাস এবং রাস্ট্রবিজ্ঞানের।“ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাজেশ ঝাঁ'র মতে, “দুর্ভাগ্যবশত পড়াশোনার থেকে রাজনৈতিক বিবেচনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার মানে অবনমন ঘটবে। স্বাধীনতা, সাম্য, সামাজিক বিচার একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, একটা বাদ দিয়ে আরেকটা কীভাবে পড়ানো যাবে?”

    ইতিহাস থেকে উপনিবেশবাদ, দেশভাগের মতো অধ্যায় বাদ কেন দেওয়া হয়, যাতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা অথবা বিকৃত ইতিহাস তাদের মনে গেঁথে দেওয়া সহজ হয়, এই জন্য? সাংবাদিক রজত রায় বলছেন, “বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে দেখা গিয়েছে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরাই নতুন করে ইতিহাস তৈরী করার চেষ্টা করেন। দেশভাগ না বুঝলে ছাত্ররা উপনিবেশবাদ বুঝবে কীভাবে? দেশভাগ স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাকে না জানলে কারা এর জন্য দায়ী, কেন দেশভাগ হয়েছিল, তা বোঝা যাবে না। বিকৃত ইতিহাস তৈরী হবে। স্কুলের ইতিহাসের পাঠ্যসূচিকে এত গুরুত্ব কেন দেওয়া হয়, সবাই ক্ষমতায় এসেই কেন স্কুলের ইতিহাসের পাঠ্যসূচি বদলায়? কারণ কিশোর মনে নতুন বিষবৃক্ষ রোপণ করতে চায় সবাই।“

    এইভাবে বেশ কিছু জরুরি অধ্যায় স্কুলের সিলেবাস থেকে বাদ দিলে ছাত্রসমাজের উচ্চতর শিক্ষায় কি অসুবিধা হবে না? গোটা ব্যাপারটা নিয়েই শিক্ষা জগতে এবং ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ জমা হয়েছে। যদিও সিবিএসই-র বক্তব্য, সিলেবাসের কাটাছেঁড়া শুধুমাত্র এক বছরের জন্য। কিন্তু মহামারীর প্রকোপ এক বছরেই কেটে যাবে, তার নিশ্চয়তা কী? কেটে গেলেও যে পুরানো সিলেবাসই ফিরে আসবে, তারই বা গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? সমস্যা হল, ভারতের দেশভাগ বা বিমুদ্রাকরণ এ দেশের স্কুলের পাঠক্রম থেকে বাদ দিলেও সারা বিশ্বে জ্ঞানচর্চার পরিসরে তা রয়েই যাবে।


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    আমাদের আশপাশের প্রতিটা মানুষই যে খারাপ নয়, সেই গল্পই যেন বলল এই শর্ট ফিল্ম।

    মৌমাছিবিহীন মধু তৈরি করছে ইজরায়েলি সংস্থা Bee-io যাতে শুধু মৌমাছিই বাঁচবে না

    গোটা ছবিতে উঠে এসেছে এক নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।

    জয় শ্রীরাম বনাম জয় বাংলা ধর্মীয় সত্তার রাজনীতি বনাম ভাষা সত্তার রাজনীতি

    মহাকাশ গবেষণায় যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল নাসার এই নতুন আবিষ্কার।

    সুন্দরবনের একটি অতি সাধারণ মেয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেখানকার স্বাদ পৌঁছে দিচ্ছেন একা হাতে।

    করোনার সুযোগে সিলেবাসে বেছে বেছে কোপ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested