×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • এক পিতার মৃত্যু

    সোমনাথ গুহ | 13-05-2021

    প্রতিবাদী বাবা-মেয়ে- নাতাশা ও মহাবীর নারওয়াল।

    গত 9 মে মহাবীর নারওয়াল কোভিড আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। অনেকেই প্রশ্ন করবেন কে এই মহাবীর নারওয়াল? তিনি একজন সংগ্রামী মানুষ, যিনি জরুরি অবস্থার সময়ে সরকারের বিরোধিতা করে জেল খেটেছিলেন। এছাড়া তিনি জেএনইউ-এর প্রাক্তন ছাত্রী নাতাশা নারওয়ালের পিতা। নাতাশা ‘পিঞ্জড়া তোড়’ সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। ‘পিঞ্জড়া তোড়’ দিল্লির ছাত্রীদের একটি সংগঠন, যেটি হস্টেলে এবং অন্যত্র ছাত্রীদের ওপরে যে সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সেগুলোর প্রতিবাদে 2015 সালে স্থাপিত হয়। রাজধানীতে নাগরিকত্ব আইন (CAA) বিরোধী আন্দোলনে এঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এঁদের সদস্যরা- নাতাশা, দেবাঙ্গনা কলিতা এবং গুলফিশা ফতিমা শাহিনবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

     

    আরও পড়ুন : ময়দানবের প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে, শবদাহের ব্যবস্থা নেই

     

     

    আমরা জানি গত বছরের 23 থেকে 26 ফেব্রুয়ারি শাসক দলের কিছু নেতার প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত এক নৃশংস হামলা হয়। (ইতিপূর্বে তথাকথিত এই ‘দাঙ্গা’র ওপরে এই পোর্টালে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে)। নাতাশা আর তাঁর সঙ্গীরা দাঙ্গায় আক্রান্ত মানুষদের ত্রাণকার্যে সামিল হন। তখন দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। মহামারীর কারণে শাহিনবাগের সংগঠকরা আন্দোলন স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। প্রতিহিংসাপরায়ণ কেন্দ্রীয় সরকার মহামারীর সুযোগ নিয়ে তাদের অ্যাজেন্ডা পূরণ করতে নেমে পড়ে। শাসক দলের নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ- ঠাকুর যারা হিংসায় সরাসরি মদত দিয়েছিলেন- তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে, দিল্লি পুলিশ শাহিনবাগের সংগঠকদেরই রাজধানীর হিংসার ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে দায়ী করে। শুরু হয়ে যায় ব্যাপক ধরপাকড়। নাতাশা 23 মে তাঁর দিল্লির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ও দেবাঙ্গনা 300 মহিলা নিয়ে জাফরাবাদে জনতাকে হিংসায় প্ররোচিত করেছেন। তাঁদের কাছে নাকি অ্যাসিডের বোতল এবং লঙ্কার গুঁড়ো ছিল। কারোয়াঁ-ই-মহাব্বতের নির্মিত একটি ভিডিওতে মহাবীর নারওয়াল বলেন, এফআইআরে নাতাশা সহ 10 জনের নাম ছিল। পরের দিন আদালতে তাঁদের বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। কিন্তু নাতাশা মুক্তি পাওয়ার আগেই পুলিশ পৌঁছে যায় এবং তাঁকে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়।    

     

     

    28 জানুয়ারি নাতাশার জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি হয়। সরকারি উকিল বলেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দৃশ্যত (prima facie) সত্য। নাতাশার উকিল যুক্তি দেন, হিংসায় অ্যাসিডের কারণে কারও মৃত্যু হয়নি, কিংবা লঙ্কার গুঁড়োয় কেউ আহত হয়নি। নাতাশা তহবিল জোগাড় করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; তিনি কোনও হিংসাত্মক কার্যকলাপেও যুক্ত ছিলেন না। এরকম কোনও ভিডিও বা জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের কোনও সিসিটিভি ফুটেজ নেই, যাতে প্রমাণ করা যায় যে, নাতাশা হিংসায় যুক্ত ছিলেন বা অন্যদের প্ররোচিত করেছেন। তিনি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, আন্দোলন আর ষড়যন্ত্র এক নয়। সরকারি উকিলের পাল্টা যুক্তি বিস্ময়কর। তিনি বলেন শাহিনবাগ আন্দোলনটাই ছিল দিল্লি দাঙ্গার প্রস্তুতি, একটা গভীর ষড়যন্ত্র এবং সেটা এতই গভীর যে, সেটা প্রমাণ করার জন্য কোনও কারণ দাখিল করার প্রয়োজন নেই, কোনও ভিডিও বা সিসিটিভি ফুটেজের প্রয়োজন নেই, এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এটা প্রমাণ করারও দরকার নেই। সরকারি উকিলের এই বয়ানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিচারব্যবস্থার অনেকেই এখন শাসকের তল্পিবাহক, শাসকের কথায় ওঠবোস করাই তাদের কাজ

     

    আরও পড়ুন : মানুষের পাশে সাধারণ মানুষই, নেতাদেরও আগে

     

    ওই ভিডিওতে নাতাশার পিতা বলেন IPC-তে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগে ও জামিন পেয়েছে। এই সব অভিযোগের ভিত্তিতেই ওর ওপর ইউএপিএ চাপানো হয়েছে, অথচ ও মুক্তি পাচ্ছে না। ‘জেল নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ও ঠিক বুঝে নেবে,’ স্নেহবৎসল পিতা বলেন। ‘ওর সঙ্গে আমার নাড়ির টান; দেখুন না ওর উপহার দেওয়া কুর্তা আমি পরে আছি। 13 বছর বয়সে ওর মা মারা যায়। কিছু দিন বাদেই ও নিজেকে পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয়। 2004 সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী যখন বলেন যে আমাদের মুসলিম ভোটের কোনও প্রয়োজন নেই তখন নাতাশা খুব রেগে যায়। তখন ওর বয়স কত, ক্লাস নাইন বা টেন হবে। তারপর থেকে তো নারীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ল, পিঞ্জড়া তোড় গঠন করল’, মহাবীর স্মৃতিচারণ করেন। সফদার হাশমির একটা কথা খুব মূল্যবান। মহিলারা যদি সচেতন না হয়, তাহলে অন্যায় চলতেই থাকবে। ‘আমার মেয়ে তো অন্যায় কিছু করেনি’, অকপট পিতা কন্যার হয়ে সওয়াল করেন। ভিন্নমত ধারণ করা, মতবিরোধিতা তো সুস্থতার লক্ষণ। ভিডিওতে মহাবীর নাতাশার বইপত্তর দেখান। বলেন, ‘জেলে ও উর্দু শিখছে, জেলের পাঠাগারের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে। ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়। ওর ভাই ওর ঘর একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে, যাতে ও বাড়ি ফিরে আরামে থাকতে পারে।' তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যান। মাঝেমাঝে অশুভ সব চিন্তা ভিড় করে আসে। ‘যদি ওর সাথে আর দেখা না হয়, আমার তো বয়স হচ্ছে, দিনকালও ভালো না...তবুও আশা রাখতে হবে। আমি ওর জন্য গর্বিত...,’ পিতার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

     

     

    মহাবীর নারওয়াল কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে নাতাশা 7 মে জামিনের জন্য আবেদন করেন। ‘পিঞ্জড়া তোড়’ ও অন্যান্য সহমর্মীরা অবিলম্বে জামিন দেওয়ার জন্য সোশাল মিডিয়ায় সরব হন। আদালত কর্ণাটকে বিজেপি সরকারকে রক্ষা করার জন্য রাত দু’টোয় শুনানি ডাকতে পারে, কিন্তু মুমূর্ষু পিতাকে দেখার জন্য কন্যার জামিনের আবেদন শোনার সময় করে উঠতে পারে না। সোমবার শুনানির দিন ধার্য হয়। ততক্ষণে অবশ্য মহাবীর যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই হল, কন্যার দেখা না পেয়েই তাঁকে ইহলোক ছেড়ে চলে যেতে হল। আদালতের এই চূড়ান্ত অমানবিকতা সম্পর্কে নাতাশার বন্ধু বলেন, ‘জাস্টিস ডিলেয়ড ইজ জাস্টিস ডিনাইড।' প্রতিটি শুনানিতেই উনি আশা করতেন, এবার হয়তো নাতাশা মুক্তি পাবে, কিন্তু সেটা আর হল না। এটা একটা অস্বাভাবিক সময়, কোভিডের কারণে অনেকের প্রিয়জন অসুস্থ। তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে জামিন দেওয়া উচিত। ‘পিঞ্জড়া তোড়’ একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলে, উনি খালি নাতাশার পিতা ছিলেন না, আমাদের কমরেড, বন্ধু ও একই পথের পথিক ছিলেন। চারদিকের এই হট্টগোলের মধ্যে উনি ছিলেন স্থির, শান্ত ও বলিষ্ঠভাবে সরব। কোভিডের এই মারাত্মক সময়ে জেলগুলো সব এখন মৃত্যুফাঁদ। অনেকে অসুস্থ, যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। অনেকের প্রিয়জন অসুস্থ এবং বন্দি থাকার দরুণ তাঁরা তাঁদের শুশ্রুষা করতে পারছেন না। বিশ্বজুড়ে এই অভূতপূর্ব সংকটের সময় রাষ্ট্র অন্তত বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তি দিতে পারে, যাতে আর কোনও কন্যাকে তাঁর পিতার মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে না থাকতে পারার যন্ত্রণা সাড়া জীবন বইতে না হয়।


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    পীড়নকারী, হত্যাকারী পুলিশের শাস্তি হয়নি কোনও আমলেই।

    বিচারব্যবস্থার সরকারের অনুগত হয়ে পড়াটাই ভয়ঙ্কর বিপদ

    শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মুসলিম ভোট বাংলায় মমতার ঝুলিতেই যাবে।

    UAPA প্রয়োগ করে রাষ্ট্র যে বিচারের নামে যা খুশি করতে পারে, তার উদাহরণ ভারভারা রাও

    দেশের গরিব মানুষের খাবার নেই, দুর্বলের অবস্থা আরও খারাপ, সেই খবর প্রকাশেও বাধা

    স্থানীয় আদিবাসীদের উপর প্রবল প্রভাবের কারণেই স্ট্যান স্বামীকে সরানো রাষ্ট্রের দরকার ছিল।

    এক পিতার মৃত্যু-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested