2019-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সবে ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা 34 থেকে 22-এ নেমে গেছে। সাংবাদিক বৈঠকে জনৈক সাংবাদিক মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে একটি আপাত নিরীহ প্রশ্ন করেন, এরপরে আপনি কি আর ইফতার পার্টিতে যাবেন? নির্বাচনের বিপর্যয়ের পর এই প্রশ্ন আগুনে ঘি ঢালার সামিল! আমি তোষণ করি, না? মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ‘একশো বার যাব’, তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দাপটের সঙ্গে প্রত্যুত্তর দেন। এরপর তাঁর সংযোজন, ‘যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথিও খেতে হয়।' বলাই বাহুল্য তথাকথিত গোরু হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। 2011 সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা 27 শতাংশ, যা এখন কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করা হয়। ধরে নেওয়া হয় পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য এই জনসমষ্টির সমর্থন আবশ্যিক। যদিও এর ব্যতিক্রম আছে। 2019-এর ওই নির্বাচনে মাত্র 4 শতাংশ মুসলিম ভোট পাওয়া সত্ত্বেও উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মেরুকরণের ওপর নির্ভর করে বিজেপি কিন্তু ড্যাং ড্যাং করে 18টি আসন জিতে নিয়েছিল। কিন্তু সেটা ওই ব্যতিক্রমই! 1967 সালের পরে কেবলমাত্র 1984 সালে কোনও জাতীয় দল (এই ক্ষেত্রে কংগ্রেস)-এর আসনসংখ্যা লোকসভায় দুই অঙ্কে পৌঁছেছিল। সেবারে মুসলিম ভোটের আনুকূল্য ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার কারণে সহানুভূতির ঢেউয়ের ওপর ভর করে কংগ্রেস রাজ্যে 16টি আসন জিতেছিল।
দেশভাগের পর থেকে পশ্চিমবাংলায় কোনও মুসলিম রাজনৈতিক দল স্থায়ীভাবে নির্বাচনে সাফল্য তো পায়ইনি, বরং বলা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের ভূমিকা হতাশাব্যাঞ্জক। 1947-এর নভেম্বর মাসে এই বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লিগ দলটির বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল দেশভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে এই দলটির আর কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা যুক্তি দেন যে, মুসলিমদের একটি নিজস্ব পার্টি তাঁদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। 1969-এর নির্বাচনের আগে ‘প্রগ্রেসিভ মুসলিম লিগ’ নামে একটি দল গঠিত হয়। এঁরা 40টি আসনে প্রার্থী দিয়ে তিনটিতে জয়ী হয়, 1.56 শতাংশ ভোট পায় এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করে। এই উত্থান ছিল সাময়িক। 1971-এর নির্বাচনে এঁরা দু’টি আসনে প্রার্থী দিয়ে দু’টিতেই পরাজিত হয়, ভোটের শতাংশ নেমে দাঁড়ায় 0.12-তে। এরপর থেকে মুসলিমদের নিজেদের দল গঠনের প্রচেষ্টা কোনও সময়েই সেভাবে দানা বাঁধেনি। 2014 সালে রাজ্যে মন্ত্রীসভার বর্তমান সদস্য, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী AIUDF-এর হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে ‘ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ এবং AIUDF একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেও নোটার (1.1 শতাংশ) থেকে কম ভোট পায়। 2016 সালে AIUDF বাদে বাকি দলগুলির সঙ্গে যোগ হয় ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ’, যাদের কেরালায় যথেষ্ট গণভিত্তি রয়েছে, এবং ওই রাজ্যের বর্তমান বিধানসভায় তাদের 18টি আসন রয়েছে। এরা একত্রিতভাবে 40টি আসনে প্রার্থী দেয়। প্রতিটিতে জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং মাত্র 0.12 শতাংশ ভোট পায়, যেখানে নোটার ভোটপ্রাপ্তি ছিল 1.52 শতাংশ।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে 1969 সালের নির্বাচন বাদে মুসলিম দলগুলির ভোটের ফলাফল অতি শোচনীয়, অথচ একইসঙ্গে মুসলিম ভোট, বা তথাকথিত সংখ্যালঘু ‘ভোটব্যাঙ্ক’-এর গুরুত্ব অসীম। 1967 এবং 1969 বাদে কংগ্রেস এই রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সিংহভাগ ভোট পেয়ে এসেছে। জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় গান্ধীর মস্তিষ্কপ্রসূত নাশবন্দি অভিযান এবং দিল্লিতে বস্তি উচ্ছেদ মুসলিমদের কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ করে তোলে। দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম স্বয়ং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোটের নিদান দেন। 1977-এর নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটে এবং সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট এই রাজ্যে হৈ হৈ করে ক্ষমতায় চলে আসে। যে কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক দল আদর্শগত ভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল, যেটাকে নিন্দুকেরা ‘তোষণ’ বলে সমালোচনা করেন। দীর্ঘ 34 বছরের বাম আমলে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল, এমনকি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও বড় কোনও হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ ঘটেনি। কিন্তু নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে এই প্রথম মুসলিম জনতা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। তথাকথিত ‘সূর্যোদয়’-এর তিন মাস বাদেই সেখানের উপনির্বাচনে সিপিআই প্রার্থী তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে 40,000 ভোটে পরাজিত হল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর পিডিসিআই দল জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে ছিল। নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী বাদশা আলমের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, যা প্রমাণ করে যে সংকটকালেও এই রাজ্যের মুসলিম মানুষ তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের দলের চেয়ে মূলধারার বৃহৎ দলকেই সমর্থন করা পছন্দ করে।
এই সময়েই সাচ্চার কমিটির রিপোর্টে রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের শোচনীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা প্রকাশ্যে আসে। এর ফলে মুসলিমদের মধ্যে বামেদের গণভিত্তি বিপুল ভাবে ধাক্কা খায়। তথ্য অনুযায়ী 2006 সালে বামদের মুসলিম ভোট ছিল 45 শতাংশ, যা 2016-তে 24 শতাংশ নেমে আসে। একই সময়ে তৃণমূলের পাওয়া ভোট 22% থেকে 51% হয়ে যায়। পুলওয়ামা কান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং প্রবল মেরুকরণের আবহ সৃষ্টি করে। এসত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস যে 22টি আসন পেতে সমর্থ হয়েছিল, তার মূল কারণ হচ্ছে সংখ্যালঘুদের আরও ব্যাপক সমর্থন। তথ্য অনুযায়ী তৃণমূলের 43 শতাংশ ভোটের অর্ধেকের বেশি ছিল মুসলিম ভোট।
এই পর্যন্ত ঠিক আছে; সিংহভাগ মুসলিমদের সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’-এর উত্থান হিসাব গন্ডগোল করে দিল। জন্মের মাত্র দু’মাসের মাথায় বাম-কংগ্রেস জোটের ব্রিগেডের সভায় এই দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। আব্বাস সিদ্দিকি এই ফ্রন্টে বিভিন্ন আদিবাসী, কুড়মি, বাগদি সংগঠন সমাবেত করেছেন এবং এদের প্রার্থী তালিকায় অমুসলিম ব্যক্তিদেরও স্থান হয়েছে। এটা করে তিনি এই ফ্রন্টের একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। মনে রাখতে হবে ফুরফুরা শরিফ একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা প্রায় 3,000 মসজিদ, মাজার, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে। হাওড়া, হুগলি, এবং উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগণায় এঁদের প্রভাব অসীম। এতদিন আব্বাসের কাকা পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তৃণমূলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল প্রায় প্রশ্নাতীত। আব্বাস এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, যে বিদ্রোহ অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানও মনে করেন আদপে একটি পারিবারিক বিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাই হোক, খোদ ফুরফুরা শরিফের উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তিনি, যেমন প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ডানকুনি থেকে রেল লাইন না হওয়া, সেখানকার হাসপাতালের দুরাবস্থা, আইটিআই না হওয়া ইত্যাদি। এছাড়া হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গরিবির কথাও তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে। এইসব কারণের জন্যই তিনি তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন। আবার এটাও ঘটনা, এত ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু 40টি আসন চেয়ে তৃণমূলের সঙ্গেই প্রথম জোটের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি বাম-কংগ্রেস জোটে গিয়ে ভেড়েন। সুতরাং তাঁর ক্ষোভ কতটা ভান কিংবা কতটা খাঁটি, সেটা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু এই ধরনের জোট অভূতপূর্ব, অন্তত বাংলায় নতুন, যেখানে একটি মুসলিম-প্রধান দল মূলধারার বৃহৎ দলের সঙ্গে যৌথভাবে নির্বাচনে লড়ছে। যেহেতু এই ধরনের জোট আগে হয়নি, তাই এটা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে কিংবা মোদ্দা কথায় মুসলিম ভোটে কতটা ভাগ বসাবে তা আগাম বলা মুশকিল।
এর সঙ্গে জুড়েছে হায়দ্রাবাদের ‘মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম) নামক দল, যারা রাজ্যের 6% উর্দুভাষী মুসলমানদের ভোটে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে। এদের সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে, এরা ‘ভোট কাটুয়া’ এবং এরা বিহারে মুসলিম ভোট কেটে বিজেপি-নীতীশ কুমারের জোটকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। এদের মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই বাজারে ভাসছে- দিদি মজবুরি, মগর জরুরি। লক্ষ্যনীয় ভাবে এই নির্বাচনে বিজেপি কিন্তু এখনও অবধি সাম্প্রদায়িক তাস খেলেনি, অন্তত প্রকাশ্যে তাঁরা মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে না। বরং বলছে বাংলার মাটিতে আমার যতটা অধিকার, আব্বাসেরও ততটাই। আরও আশ্চর্য তারাও মুসলিম ভোটে ভাগ বসাতে চাইছে, যে কারণে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরে তারা নয়জন মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। একইসঙ্গে মনে রাখা দরকার, নির্বাচন আট দফার, লম্বা প্রক্রিয়া। প্রথম তিন চার দফায় যদি বিজেপি বোঝে যে অবস্থা সুবিধার নয় তাহলে তারা অবশ্যই মেরুকরণের পথে হাঁটবে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে। অন্যথায় তাদের আশা, আইএসএফ, মিম এবং তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় মুসলিম ভোটে যদি বড় রকম ভাঙন ধরানো যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে, নবান্ন তাদের হাতের মুঠোয়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আজ অনেক বেশি শিক্ষিত, সমঝদার, তাঁরা কোনও চিন্তাশক্তিরহিত, জড়ভরত ভোটব্যাঙ্ক নয়। বিজেপিকে হারনোর মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছাড়া অন্য কোনও দলকে ভোট দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, তা তাঁরা বিহারে দেখেছে। অনুরূপ কোনও ভুল তাঁরা এই রাজ্যে করবেন না এটা একেবারে নিশ্চিত। ‘অল বেঙ্গল ইমাম অ্যাসোসিয়েশন’ তৃণমূলকে সমর্থন করার ডাক দিয়েছে। 2019-এ তারা যেরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতীয়তাবাদের জিগিরে ডুবন্ত তৃণমূলকে ভেসে থাকতে সাহায্য করেছিল, এবারও তারা সেটাই করবে। মুসলিম ভোট নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর চিন্তা হওয়ার কারণ নেই, চিন্তা যে 20% মূলত হিন্দু ভোট বামেদের থেকে রামে চলে গিয়েছিল সেটা নিয়ে। মুশকিল হচ্ছে সেটা উদ্ধার করা শুধু তাঁর প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করছে না, তাঁকে বাম-কংগ্রেস জোটের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
সরকার বিরোধিতা করলে উইচ-হান্ট কিন্তু চলছেই
উত্তরপ্রদেশে আইনের প্রয়োগ অখন নাগরিকের ধর্মের উপর নির্ভর করে।
শাসকের সদ্ভাবনা অসম্ভব, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাই অপ-প্রযুক্তি দমনের পথ।
দেশ কৃষিতে উদ্বৃত্ত, অথচ ক্রমবর্দ্ধমান অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা- হিসেবে ভুল হচ্ছে কোথায়?
এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে সমস্ত বিরোধী স্বর স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে
পরিকল্পিত আক্রমণে পুলিশ কার্যত আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের সঙ্গীর ভূমিকা পালন করেছিল।