×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শহীদের রক্ত অর্ধেকই ব্যর্থ

    সোমনাথ গুহ | 20-02-2021

    মইদুল ইসলাম মিদ্যার ছবি

    শহীদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলনে জুলুম, অত্যাচারের ফলে তাঁদের কর্মীর মৃত্যু হলে বামপন্থীদের এটি অতি পরিচিত স্লোগান কর্মীদের মনোবল অটুট রাখতে, তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে এই কথাটির জুড়ি নেই। শহীদের রক্ত দু'ভাবে সার্থক হতে পারে: প্রথমত, যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন করা হচ্ছিল সেই লক্ষ্য পূরণ হলে; এবং দ্বিতীয়ত, যে অন্যায় পীড়নের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে তার কোনও প্রতিকার হলে, অর্থাৎ পীড়নকারী শাস্তি পেলে। আমরা দেখেছি আন্দোলনের লক্ষ্য যদি বা কখনও পূরণ হয়ও বটে, পীড়নকারী স্বাধীন ভারতে কখনও শাস্তি পায়না, পায়নি।

     

    শহীদের রক্তের অন্তত অর্ধেক ব্যর্থই হয়েছে।

     

    গত 15 ফেব্রুয়ারি ডিওয়াইএফই (DYFI) কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার মর্মান্তিক মৃত্যু নতুন করে এই চিন্তার উদ্রেক করল। মইদুল টোটো চালক, মেহনতী মানুষ, যাঁর উপর ছয়জনের পরিবার নির্ভরশীল। বামপন্থী আন্দোলনের এই কঠিন সময়েও 31 বছরের এই বলিষ্ঠ যুবক লাল পতাকা কাঁধে তুলে নেন। 11ই ফেব্রুয়ারি ছিল কাজ ও রুটিরুজির দাবিতে বাম ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযান। সকালবেলায় তিনি যখন বাঁকুড়ার কোতুলপুরে তাঁর বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাবেননি যে তিনি আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু রাষ্ট্র নির্মম, যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালাল, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ব্যবহৃত হল। গুরুতর অসুস্থ মইদুল পার্ক সার্কাসের এক নার্সিংহোমে তিন দিন বাদে মারা গেলেন। জানা গেল তাঁর শরীরের উপরাংশে মারের দাগ পাওয়া গেছে, কিডনি, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত। তদন্ত চলছে। পুলিশ পুলিশি নির্যাতনের তদন্ত করছে! ইতিমধ্যেই তাঁর মৃত্যুকে লঘু করার চেষ্টা হচ্ছে। উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নানা কারণ, নানা তত্ত্ব  বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিন দিন তিনি কোথায় ছিলেন, তাঁর আগে কোনও রোগ ছিল কি না, নার্সিংহোমে তাঁর ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়েছিল কি না?

     

    ইতিহাস কিন্তু বলছে, এটাই হয়। মইদুল কোনও ব্যতিক্রম নন, এটাই নিয়ম।

     

    ঠিক 55 বছর আগে, 1966 সালের 16 ফেব্রুয়ারি, বসিরহাটের কাছে স্বরূপনগরে স্কুল ছাত্র নুরুল ইসলাম পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। সারা রাজ্য জুড়ে তখন আকাল, রেশন নেই, কেরোসিন নেই। নুরুল তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। ছোট্ট নুরুল আর বাড়ি ফেরেননি। খাদ্য আন্দোলন উল্কার মতো সারা রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নুরুল, আনন্দ হাইত এঁদের সম্মানে অনেক শহীদ বেদি হয়েছিল। কিন্তু নতুন যুক্তফ্রন্ট সরকার, কিংবা পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট সরকার এঁদের মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে কোনওরকম ব্যবস্থা নিয়েছিল বলে শোনা যায়নি। কিন্তু প্রতি বছর পালা করে ওই সব শহীদ বেদিতে মালা দেওয়া হয়েছে, স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘শহীদের রক্ত...’। 2011সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর রাইটার্স বিল্ডিংয়ে নুরুলের মা আছিয়া বিবির উপস্থিতিতে, ‘হেই সামালো ধান হো’ গানের আবহে ধুমধাম করে 1959-এর খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করা হয়েছে। শহীদের মৃত্যুর পরবর্তীকালে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, বাম কিংবা ডান, তাঁরা শহীদের স্বজনদের নিজেদের রাজনীতির ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছেন এবং পাশাপাশি অতীতের সরকারের মতো একইরকম ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে।

     

    নকশালদের ওপর সংঘটিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তো অতি সুবিদিত। 1967 থেকে 1977 এই দশ বছর তাঁরা যে নৃশংস অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন, তা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বিরল। কাশীপুর, বরানগর, হাওড়া, ডায়মন্ডহারবার, বারাসাত, কোন্নগর হয়ে তালিকাটি দীর্ঘ। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এটি সরকারের হিংস্র, বিকারগ্রস্ত সন্ত্রাসের এক একটি জ্বলন্ত অধ্যায়। 1977-এর জুলাই মাসে সিপিএম সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু লোকসভায় স্পিকারকে বলেন, “স্যর আমার কাছে নির্যাতনের ফিরিস্তি আছে। ‘টর্চার’ নামক পুস্তিকায় আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ দীর্ঘ বিবরণ আছে। আপনি এসব পড়লে আপনাকে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হবে…।” তিনি দেবী রায়, রঞ্জিত গুপ্ত, বিভতি চক্রবর্তী, অরুণপ্রসাদ মুখার্জী, রুণু গুহ নিয়োগীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার ও তদন্ত কমিশন বসানোর দাবি করেন। (সূত্র: দর্পণ, 08.07.1977)। অবশেষে বামফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ি ও নাগরিক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যাকান্ডের তদন্ত’ করার জন্য 1977 সালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু হরতোষ চক্রবর্তী কমিশন গঠন করেন। 1979 সালের এপ্রিল মাসে কমিশন রিপোর্ট দেয় এবং কিছু পুলিশ অফিসারকে চিহ্নিত করে শাস্তির কথা বলা হয়। ব্যাস, ওই পর্যন্তই, তারপর ওই রিপোর্ট ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হয়। হাওড়া জেলে হত্যাকান্ডের ওপর শর্মা-সরকার কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই কমিশনও দোষী পুলিশ ও অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। বিখ্যাত আইনজীবী অরুণপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “হাওড়া জেলে 80 জন বন্দিকে মেরে ফেলা হয়। তখন কংগ্রেস সরকার। পরে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে শর্মা-সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। রিপোর্ট বেরোল 1978 সালে। অনেকের নাম করে রিপোর্টে বলা হল, তারা নিরস্ত্র বন্দিদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে, যার ফলে বন্দিদের মৃত্যু হয়। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়ে গেছি এই দেখে যে, বামফ্রন্ট সরকার এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থাই নিলেন না।” (প্রতিক্ষণ: 16.08.1987)। জ্যোতির্ময় বসু দোষী অফিসারদের গ্রেপ্তারের কথা বলেছিলেন, কিন্তু গ্রেপ্তারি দূরে থাক এই অত্যাচারী অফিসারদের বারবার পদোন্নতি হয়েছে। খুন, ধর্ষণ সহ বহুবিধ অপরাধে অভিযুক্ত রুণু গুহ নিয়োগী সামান্য এস.আই থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হয়েছেন, সরকার দ্বারা মনোনীত হয়ে বিশেষ রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছেন। শিলিগুড়ির তৎকালীন পুলিশ সুপার, নকশালবাড়িতে কৃষক হত্যার খলনায়ক বলে চিহ্নিত অরুণ প্রসাদ মুখার্জী রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা হয়েছেন।

     

    1993 সালের 21 জুলাই পুলিশের গুলিতে 13 জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যুর ঘটনাও অতি সুবিদিত। ওই ঘটনা মানুষের স্মৃতি থেকে সহজে মুছে যাওয়ার নয়। কারণ প্রতি বছর ওই দিনটিতে ধর্মতলায় বিপুল জনসমাবেশ হয় এবং ধুমধাম করে শহীদ দিবস পালিত হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের বাৎসরিক নির্ঘন্টে এই অনুষ্ঠানটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। 2011 সালে ক্ষমতায় আসার পর নতুন তৃণমূল সরকার ওই ঘটনার তদন্ত করার জন্য বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে। কমিশন 2014-র ডিসেম্বরে তাঁদের রিপোর্ট পেশ করেন। কমিশন কোনও বিশেষ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেননি, কিন্তু গুলি চালানার জন্য সম্মিলিতভাবে কিছু ভূতপূর্ব আইপিএস অফিসারকে দায়ী করেন। বলাই বাহুল্য কোনও অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

     

    কমিশনের সদস্যরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মনীশ গুপ্তর সঙ্গেও কথা বলেন। তিনি বলেন সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তাঁকে একটি চিঠি পাঠানো হয় এবং চারজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত করার কথা বলা হয়। শ্রী গুপ্ত বলেন, তিনি সেই চিঠির বিষয়বস্তু পরীক্ষা করে দেখেননি। তিনি আরও বলেন যে তৎকালীন সরকারের চাপে তিনি সেই চিঠি সই করতে বাধ্য হন। কমিশনের চেয়ারম্যান জাস্টিস চ্যাটার্জীর মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। “বিষয়বস্তু না জেনে কারও পক্ষে কি একটি চিঠি সই করা সম্ভব?”, তিনি প্রশ্ন করেন। (সূত্র: স্টেটসম্যান, 31.10.2013)। এই মনীশ গুপ্তকে মমতা ব্যানার্জীর সরকার কী ভাবে বারবার বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী করে পুরস্কৃত করেছেন তা সবার জানা।

     

    কোনও দল ক্ষমতায় আসার পর যখন তাঁদের নিজেদের কর্মীদের মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগ হয় তখন সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং পরিবারের কাউকে চাকরি দেওয়াই কি যথেষ্ট? যে সেই কর্মীর মৃত্যুর জন্য দায়ী তাঁকে নির্দিষ্ট করা এবং যথাযথ শাস্তি দেওয়া কি কাম্য নয়? নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলার রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপথ অনুযায়ী বাম-কংগ্রেস জোটের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অতীতের ইতিহাস বলে যদি তাঁরা ক্ষমতায় আসেনও, মইদুলের মৃত্যুর দিন তাঁরা শোকপালন করবেন, কিন্তু দোষীদের শাস্তি চিরকালের মতো অধরাই থেকে যাবে।

    ঋণ স্বীকার: গণহত্যা: পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (কাশীপুর, বরানগর থেকে লালগড় ভায়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম; সম্পাদনা ও সংকলন শুকদেব চট্টোপাধ্যায়) 

         


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    শাহিনবাগের বর্ষপূর্তিতে স্মরণীয় সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের শক্তি

    তামিলনাড়ু থেকে বাংলা: দান খয়রাতির রাজনীতির শেষ কোথায়?

    নানা ধরনের দমনমূলক আইনের প্রয়োগ এবং সরকার-বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে প্র

    শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মুসলিম ভোট বাংলায় মমতার ঝুলিতেই যাবে।

    সরকার বিরোধিতা করলে উইচ-হান্ট কিন্তু চলছেই

    ভোটমুখী বাংলায় কৃষক আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর কৃষক নেতারা।

    শহীদের রক্ত অর্ধেকই ব্যর্থ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested