ভরতপুরে ছোটখাটো ব্যবসা করে ভবেশ নাথ। সেই ছোটখাটো ব্যবসার গালভরা নাম তিনি নিজেই ঠিক করেছেন- জনসেবা। জনসেবা অর্থাৎ তোলাবাজি, খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, ভয় দেখানো ইত্যাদি। নিজের নাম পাল্টে এই পেশার সঙ্গে মানানসই একটি নামও রেখেছেন তিনি। ভিট্টন। এই নামেই এলাকার ছোটখাটো গ্যাংস্টার হিসেবে কুখ্যাত সে। তথাকথিত ভদ্রলোকেরা নিজেদের কুকীর্তি ধামাচাপা দিতে শরণাপন্ন হয় ভিট্টনের। এই "তথাকথিত ভদ্রলোকেরা' হলেন- ছোট-বড় ব্যবসায়ী সমিতি, বিভিন্ন দলের নেতা-মন্ত্রী; ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকেরা। ভিট্টন দেখে, তারই সাহায্য নিয়ে ভদ্রলোকেরা মুখোশ পরে মাথা উঁচু করে সমাজের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, সকলে সবটাই জানে, কেউ কিছু বলে না। সকলের মুখ বন্ধ, ভয়ে নয়তো স্বার্থচরিতার্থে। সব দেখেশুনে ভিট্টন সিদ্ধান্ত নেয় আর ভদ্রলোকদের হয়ে নয়, এবার সেও হয়ে উঠবে ভদ্রলোকদের একজন, হয়ে উঠবে সমাজস্বীকৃত জনসেবক। টপ-টু-বটম্ পলিটিক্যাল লিডার। একজন অভিনেতার সাহায্য নিয়ে পলিটিক্যাল লিডারদের মতো কথা-হাঁটা-চলা-আদবকায়দা নকল করতে শুরু করে সে। নিজেকে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে দিতে, একের পর এক অপরাধ করে চলে সে। ধীরে ধীরে তৈরি করে নেয় নিজের পছন্দ মতো অন্ধকার এক সমাজ। মুখোশের আড়ালে চলে যায় "ভিট্টন'। অন্ধকার সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে ওঠে ভবেশ নাথ। সকলের মুখ বন্ধ, ভয়ে নয়তো স্বার্থচরিতার্থে।
এখানে যে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হল, সেই প্রেক্ষাপট সকলেরই খুব চেনা। সিনেমায় এবং বাস্তবে তার প্রতিফলন আমরা বহুবার দেখেছি, দেখে চলেছি। নতুন কিছু নয়। হিটলারের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষাপট অবলম্বনে ব্রেখট্ লিখেছিলেন ‘আর্তুরো উই’ নাটকটি। হিটলার এবং ব্রেখট্ কেউই আর জীবিত নেই। জীবিত রয়েছে ‘আর্তুরো উই’-এর প্রেক্ষাপট। স্বৈরাচার। তাই সময়ের দাবি মেনে রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্ধকার দিক আরও এরবার তুলে ধরতে চেয়েছেন নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় ব্রেখট্-এর নাটক ‘আর্তুরো উই’-এর বাংলা অনুবাদে তাঁর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয়েছে ‘ভিট্টন’।
অর্ণ মুখোপাধ্যায় এ প্রজন্মের একজন বলিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে নিজের পরিচিতি তৈরি করেছেন। ‘ভিট্টন’ রূপেও নিজের সেই পরিচিতি তিনি অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। অর্পিতা পরিচালিত ‘ভিট্টন’ দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে, আরে এ তো মশলাদার দক্ষিণী বা বলিউড-সিনেমা। নাটকের সংলাপ, অভিনয়, প্রেক্ষাপট, উদ্যাম নাচা-গানা সে কথা মনে করিয়ে দিতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে উৎপল দত্তের কিছু কথা উল্লেখযোগ্য। জীবিতাবস্থায় তিনিও ‘আর্তুরো উই’-এর বাংলা অনুবাদের এক দুঃসাহসিক প্রযোজনা করে বিদ্বজ্জনের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। সে ব্যাপারে উৎপল দত্ত গদ্য সংগ্রহ ১, নাট্যচিন্তা’-তে তাঁর চমৎকার একটি লেখা রয়েছে। সেখানে তিনি যা লিখেছিলেন, তার থেকেই কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি-
“কিয়ৎকাল পরে নকল দাঁতের খট-খট শব্দ করে জপেনদা বললেন, ‘ব্রেখট্ নাটক লিখতেন কেন?’
‘মানুষকে রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করতে, এ সমাজকে বদলাবার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে’- আমি বললাম।
‘তোরাও সেইজন্যেই নাটকটা করলি তো?’
‘অবশ্যই।’
‘তাহলে বলি... তোদের বাঙালি দর্শক এক অক্ষরও বুঝতে পারেনি, সমাজও চেনেনি, রাজনীতিও বোঝেনি। বরং আগে যা-ওবা বুঝত, তোদের অভিনব নাট্য-পরীক্ষার চরকিপাকে পড়ে তাও গুলিয়ে ফেলেছে।’ ধড়মড় করে জপেনদা উঠে বসতে আমরা চমকে পিছিয়ে গেছি। আঙুল তুলে জপেনদা বললেন, ‘কোনো কোনো নিরেট অশিক্ষিত বুদ্ধিবাজ বলে থাকে, ব্রেখট্ করছি এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটাবার জন্য। চেকভ, বার্নার্ড শ, শেক্সপিয়ার, সবার সঙ্গে এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটাতে তারা ব্যস্ত। এদেশের মানুষ মানে, এদেশের বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ব্রেখট্, শ, চেকভ, শেক্সপিয়ারকে খুব ভালোভাবে চেনেন কেতাব মারফৎ। অন্তত থিয়েটারের মালদের চেয়ে অনেক ভালো চেনেন। ওসব পেঁয়াজিতে ভবি ভোলে না। ব্রেখট্-এর উদ্দেশ্য আর তোদের উদ্দেশ্য যদি এক হয়, তবেই ব্রেখট্-এর নাটক করা যায়, নচেৎ কখনো নয়। ব্রেখট্ বিপ্লব প্রচার করেছেন। তাঁর বাংলা প্রযোজনার একটি এবং কেবলমাত্র একটিই যুক্তি থাকতে পারে- বাংলা ভাষ্যেও বিপ্লব প্রচারিত হবে। এবং বিপ্লব প্রচারের একটি ক্ষেত্র আছে, সেটি মজদুর-কিষাণ-মধ্যবিত্ত জনসমষ্টি। অর্থাৎ বিপ্লবটা এমনভাবে প্রচারিত হবে যেন মজুর-কৃষক-কর্মচারীর বোধগম্য হয়। বিপ্লব প্রচার করছি অথচ এমন ঢঙে করছি যাতে বিপ্লবী শ্রেণীরা বুঝতে না পারে, এর চেয়ে হাস্যকর গর্দভসুলভ মিথ্যাচার আর কী হতে পারে আমি জানি না।
মধুর এবার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। ধরা গলায় বলল, না আমরা তো বিপ্লব প্রচারের উদ্দেশ্যেই, মানে, হিটলারের অভ্যুথান সম্পর্কে নাটক দেখে যাতে মানুষ ফ্যাসিবাদের চরিত্র বুঝে নিতে পারে, ভারতের জরুরী অবস্থা ও ইন্দিরাশাহীর গোড়ার কথাগুলো সম্বন্ধে সজাগ হয়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ’... জপেনদা দাঁত খিঁচোতেই মধু থামল। ‘তা সেটা ‘আর্টরো উই’ নাটক দেখে এদেশের রাম শ্যাম যদু মধু কী করে বুঝবে? ‘উই’ তো রূপক নাটক। বাইরে তো সেটা শিকাগোর মার্কিন-ইটালিয়ান দস্যুদের কীর্তি-কাহিনী।
কিন্তু ভেতরের গল্পটা...
ভেতরের গল্প! ভেতরের গল্পের কোনো ঘটনাই যে দর্শক জানে না, সে কী মাথামুণ্ডু বুঝবে? উই-রা গুদাম পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে; সুতরাং হিটলারদের রাইখ্স্টাগ পোড়াবার ঘটনা বাংলার দর্শকের মনে পড়বে, এটা কোন গাধা বলেছে তোদের? বাইরের মাফিয়ার কাহিনীটা বুঝতেই যেকোনো বাঙালি দর্শক গলদঘর্ম হয়ে যাবে, সেখানে পদে পদে জর্মন ইতিহাসের লুকানো ইঙ্গিতগুলো তার চোখে স্পষ্ট হবে কোন অলৌকিক যোগাযোগে? তার ওপর তোদের বিচিত্র দাবি- মাফিয়া এবং জর্মনির ইতিহাস ভেদ করে দর্শককে পৌছুতে হবে ভারতের জরুরী অবস্থার বিচারে। আক্কেলগুলো কোন ব্যাংকে জমা রেখেছিস বল তো? ত্রিবিধ রূপকের এই গোলক ধাঁধায় মানুষ তো খাবি খাবে!’..
হ্যাঁ। উৎপল দত্তের লেখামতো ত্রিবিধ রূপকের এই গোলক ধাঁধায় অর্পিতা ঘোষের ‘ভিট্টন’ দেখেও মানুষ খাবি খেতে পারে! এখানে "মানুষ' বলতে নাটকের রক্ষণশীল দর্শকদের কথাই ইঙ্গিত করছি। কারণ এ নাটক "লিমিটেড' দর্শকদের জন্য নির্মিত হয়নি বলেই ধারণা। এ নাটকের দ্বার অবারিত। এ নাটকের ভাষা কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য নয়; উৎপল দত্ত যে ভাষাকে গুরুত্ব দিতেন, ‘ভিট্টন’-এর ভাষা তাই-ই। নাটক শুরুর আগেই অভিনেতাদের মঞ্চে অবস্থান, বেল না বাজিয়ে দর্শকদের সঙ্গে "ইন্টারঅ্যাক্ট' করতে করতে নাটক শুরু করে দেওয়া, হলের ভিতর সিগারেটের ধোঁয়ায় দমবন্ধ করা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা অথবা নাটক দেখতে দেখতে ‘মাশালা-মুভি’ দেখার যে অনুভূতি, তা অর্পিতা সজ্ঞানে ব্যবহার করেছেন, যা প্রযোজনাকে জ্যান্ত করে তোলে, যা অস্বস্তিকর, যা ঘোর বাস্তব!
ধ্বংস ও ধসের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ
কয়েক দশকের সিনেমা সম্পদ আর অকুতোভয়তা - যা আজ ভীষণভাবে দরকার, হয়ত ভবিষ্যতেও
আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে
এমন নারী কন্ঠ, এমন দাপুটে, এমন পা ঠুকে অভিনয় করা
সময়টা অস্থির। এই অস্থির সময়কে কেন্দ্র করেই ওপেন উইন্ডো আয়োজন করেছিল ছবি ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর।