‘ফিরে ফিরে যতবার কলকাতায় আসি, যতবার…মনে হয় কলকাতা বোধহয় একেবারে থেমে যাবে, আর চলবে না…তবু কলকাতা চলেই চলেছে। একেকটা বছরের ফারাক, আর দেখি কলকাতা আরও দুঃসহ, আরও যন্ত্রণাময়। মনে হয় নোংরা যেন আরও বীভৎস, দারিদ্র আরও বাড়ছে, হতাশা আরও মরিয়া। যতবার কলকাতার মুখোমুখি হই, মনে হয় এ এক নারকীয় শহর, কলকাতা। যার উত্থান নেই, যার শিয়রে হয়তো বা সমূহ সর্বনাশ...’ 70-এ পদাতিকের মুখ চিরে এভাবেই বেরিয়ে এসেছিলেন মহীরুহ মৃণাল।
মৃণাল সেন। 14 মে তাঁর জন্মদিন। সিনেমা বানানোয় বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও, ফিজিক্সের ছাত্র মৃণালের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল রুডলফ আর্নহেইম-এর ফিল্ম ইসথেটিক্স ও আইজেনস্টাইনের শিষ্য নীলসেনের সিনেমা অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট নামক বইগুলিই। সিনেমা বানানোর আগে ফিল্ম সোসাইটিতে ছবি দেখতে শুরু করেন, আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সদস্য হতে পারেননি। লিখতে শুরু করেন চলচ্চিত্র বিষয়ে তাত্ত্বিক ও গবেষণামূলক লেখা। প্যারিসের নব্য তরঙ্গ আন্দোলন তাঁকে বিচলিত করে, বামপন্থী রাজনীতি তাঁকে জড়িয়ে ধরে। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। না, কখনই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। নিজেকে তিনি একজন ‘প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট’ বা ‘ইন্ডিভিজুয়াল মার্ক্সিস্ট’ বলতেন। 1955 সালে বানিয়ে ফেলেন প্রথম ছবি ‘রাত-ভোর’। ছবিটি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, ‘অত্যন্ত জঘন্য ছবি’।
এই হল মৃণাল। যিনি নিজেকে নিজেই কাটাছেঁড়া করতে জানতেন। ক্যাওসের মধ্যেই সোজাসুজি নিজের ভিতরে ঢুকে পড়তে পারতেন, তাই চার বছর অপেক্ষা করে পরিচয় করান এক চিনা ফেরিওয়ালার সঙ্গে, যে এ দেশকে তারই দেশ ভেবে ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে পড়ে। দর্শকদের দেখান ‘নীল আকাশের নীচে’। তবে ছবিটির আঙ্গিক ও প্রতিন্যাসে তেমন কোনও অভিনবত্ব ছিল না। তৃতীয় পদক্ষেপ ‘বাইশে শ্রাবন’ তাঁকে পৌঁছে দেয় আন্তর্জাতিক পরিসরে। কী এমন দেখালেন তিনি?
তিনি দেখালেন সমাজ ও সময় – যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ মানুষের মধ্যে সম্পর্কবোধে মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটায়, যেখানে পরিবারের মধ্য দিয়ে তাকালে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে, সময় কী বলছে বোঝা যায়। সম্ভবত ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে এই ছবিটিতেই প্রথম নারীস্বাধীনতার প্রসঙ্গ প্রকৃত অর্থে ধরা পড়ে। 1961-তে বানালেন ‘পুনশ্চ’। ‘বাইশে শ্রাবন’-এর গ্রাম থেকে এবার তিনি তাকালেন শহরের দিকে। দেখালেন সেখানেও ঘটছে একই ঘটনা। 1962-তে সমাজের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে মজা করে কমেডি আঙ্গিকে বানালেন ‘অবশেষে’। মেয়েদের আপাত সামাজিক ভয়-ভীতি ও সংস্কার মুক্ত হতে হবে এই নির্দেশ দিয়ে 1964-তে বানান ‘প্রতিনিধি’। 1965-তে বানানো ‘আকাশ কুসুম’-এ তিনি নায়ক অজয়ের মধ্য দিয়ে সমালোচনা করেন পেটি বুর্জোয়া ব্যবস্থার। 1966-তে এক কৃষক পরিবারের যৌথ সংসারের সমস্যা নিয়ে ওড়িয়া ভাষায় বানালেন ‘মাটির মনিষ’। কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কৃষক পরিবারের সমস্যার বিশ্লেষণে তিনিই প্রথম, এই ছবিতে, মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেন। 1967-তে ভারতীয় ইতিহাসের পাঁচ হাজার বছর-এই বিষয় নিয়ে ‘মুভিং পারস্পেকটিভ’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানান। এটি তিনি ফিল্ম ডিভিশনের জন্য তৈরী করেছিলেন। 1969 সালে হিন্দি ভাষায় বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে, উৎপল দত্ত, সুহাসিনী মুলে’কে নিয়ে ‘ভুবন সোম’ বানিয়েছিলেন, যে ছবিতে ধারাভাষ্য দিতে শোনা যায় অমিতাভ বচ্চনকে। মৃণাল সেনের কথায়, এই ছবিতে, I just wanted to make fun with this ridiculous business of bureaucracy.
একটি শিশুচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন তিনি, তাই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে 1970-এ বানান ‘ইচ্ছাপূরণ’। এ ছবির কথা বিশেষ প্রচলিত নয়। অনেকের মতে ছবিটি শিশুদের পক্ষে কঠিন।
‘আমার বয়স কুড়ি। কুড়ি বছর বয়স নিয়ে আমি আজও হেঁটে চলেছি হাজার বছর ধরে…দারিদ্র, মালিন্য আর মৃত্যুর ভিড় ঠেলে আমি পায়ে পায়ে চলেছি হাজার বছর ধরে…হাজার বছর ধরে দেখছি ইতিহাস, দারিদ্রের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস’, মৃণাল যখন একেবারে নতুন উত্তাপে উচ্চারণ করছেন এই কথাগুলো, সেই সময় একে একে জন্ম নিচ্ছে সত্তর দশকের কলকাতায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের রসায়নে তাঁর ট্রিলজি, ‘ইন্টারভিউ'(1971), ‘ক্যালকাটা ৭১’ (1972) আর ‘পদাতিক’ (1973)। তাঁর চলচ্চিত্র বেয়ে উঠে আসে ‘আরবান গেরিলা’রা।
বিভক্ত স্বাধীন ভারতের অন্তর্গত পশ্চিমবাংলার গ্রামীন জীবনযাপন আর অবিভক্ত বাংলায় 1943-এর দুর্ভিক্ষ-আকাল-মৃত্যু এই দুইয়ের তুলনা এবং দু’টি সময়ের পর্যবেক্ষণে 1980 সালে প্রকাশ্যে আনেন ‘আকালের সন্ধানে’। ‘একদিন প্রতিদিন’ তৈরি করেন 1979 সালে। আর ‘খারিজ’ 1982 সালে। 1983 সালে এই ছবির জন্যে আন্তর্জাতিক কান ফেস্টিভ্যালে বিশেষ জুরি পুরস্কারে সম্মানিত হন। 1977 সালে হিন্দি কথা সাহিত্যিক প্রেম চন্দের ছোটগল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় ‘ওকা উরি কথা’। হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় 1985 সালে মৃণাল সেনের পরিচালনায় তৈরি হয় ‘জেনেসিস’। একে একে জন্ম নেয় ‘মৃগয়া’, ‘কোরাস’ ‘মহাপৃথিবী’, ‘অন্তরীন’, ‘চলচ্চিত্র’, ‘এক দিন আচানক’, ‘কান্দাহার’, ‘পরশুরাম’, ‘চালচিত্র’... ইত্যাদি। 2002 সালে তাঁর শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’, তুখোড় অভিনয়ে নেশা ধরিয়েছিলেন তখনকার নতুন তিন মুখ নন্দিতা দাস, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও কৌশিক সেন।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি শুধুমাত্র বাংলা নয়, সমগ্র দেশের চলচ্চিত্র ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক সচেতনতার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক, ওষুধ বিপননকারী, চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী, চিত্রপরিচালক, লেখক, চিত্রনাট্যকার, পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট- একাধিক বর্ণময় পরিচিতি তাঁর। বের্টোল্ট ব্রেখটের এপিক থিয়েটার এলিয়েনেশন ইফেক্ট তত্ত্ব তাঁর শিল্পভাবনায় ছাপ ফেলেছিল। যেমনভাবে, চলচ্চিত্রে ব্রেখটিয়ান ভাবনা প্রযুক্ত করার প্রেরণা পেয়েছিলেন প্যারিসের নিউ ওয়েভ বা ন্যুভেল ভাগ ফিল্ম মুভমেন্টের জঁ লুক গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো ও ক্লদ শ্যাব্রলদের থেকে, ঠিক তেমনভাবেই সাহস ও অনুপ্রেরণা পেতেন সমসাময়িক সমমনস্ক বন্ধু বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, ঋত্বিক ঘটক, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ - এঁদের থেকে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর গলায় গলায় ভাব না থাকলেও, একে অপরকে সমীহ করতেন দু’জনই।
তিনি থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস-এর সমন্বয় ঘটাতেন তাঁর চলচ্চিত্রে। বারংবার ফ্রিজ শটের ব্যবহার করে চিত্রণাট্যের সাধারণ ভঙ্গিমাকে ভেঙ্গে দিয়েছলেন। তাঁর সিনেমার বিশেষ মূর্ছনা গণসংগীত, ধ্রুপদ ও এক্সপেরিমেন্টাল যন্ত্রসঙ্গীত। পুরস্কার-সম্মাননা তাঁর মতো প্রবাদপ্রতিমকে বিচলিত করেনি কখনই। তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্রযাত্রায় তিনি ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সিনেমার ইতিহাসে সাবলীল পথ প্রশস্ত করেছেন। তাঁর এই সৃষ্টিশীল পথচলায় সামিল করতে চেয়েছিলেন বিশ্বদর্শকদের। তিনি ছিলেন ‘টোটাল ফিল্ম মেকার’; সমগ্র চলচ্চিত্র ভাষার ‘কিংবদন্তী’।
তাঁর মতো মহীরুহের ছত্রছায়ায় সাবালক হয়েছে দেশের চলচ্চিত্র ভাবনা। দীর্ঘকালীন জরা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে 95 বছর বয়সে জীবনকে খারিজ করে আকালের সন্ধানে চলে গিয়েছেন পরিযায়ী এই ‘রেবেল’। অবিচুয়ারি-হাহাকার-চলে যাওয়া নিয়ে চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হয় না…তিনি যা চেয়েছিলেন তা সুসম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে… কারণ, অতিক্রান্ত ইতিহাস খননে প্রজন্মের জিজ্ঞাসাকে সঠিক ধারনা দিতে তিনি অভিভাবকের মতো রেখে গেছেন তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্ত বাতাস, কয়েক দশকের সিনেমা সম্পদ আর অকুতোভয়তা - যা বর্তমানে ভীষণভাবে দরকার, হয়ত ভবিষ্যতেও।
রামকিঙ্কর লকডাউন দেখে যাননি। তিনি দেখে গিয়েছেন বিশ্বযুদ্ধ, দুঃখ, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খরা।
আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে
টক ফুচকা, মিষ্টি ফুচকা, দই ফুচকা, বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা, হেদুয়ার ফুচকা
শুধুই ‘জনপ্রিয়’ রবীন্দ্রনাথ নয়, এ সময়ে উঠে আসুক প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ।
নিউ মার্কেট সংলগ্ন মির্জা গালিব স্ট্রীটের ভাইব্রেশন একসময়ে সত্যিই শহরে কাঁপুনি ধরাতো।
সময়টা অস্থির। এই অস্থির সময়কে কেন্দ্র করেই ওপেন উইন্ডো আয়োজন করেছিল ছবি ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর।