এই মহামারীর বাজারে, বাজারে গিয়ে জুতোটা পট্ করে ছিঁড়ে যাবে ভাবিনি। সপ্তাহে দু-তিন দিন বাজারে যেতেই হয়। বাজার থেকে বাড়ির দূরত্ম খুব বেশি না হলেও, বাজারের থলি হাতে ল্যাঙড়াতে ল্যাঙড়াতে বাড়ি ফেরাটা খুব একটা সুবিধের বিষয় নয়। বাড়ি, বাজার, সুবিধে- বহুকাল হ’ল এই তিনটি মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষ।
যাই হোক, ফাঁদে পড়ে প্রায় কেঁদে ফেলার মুহূর্তে মনে পড়ল, বাজার থেকে কিছুটা দূরে মোড়ের মাথায় একটা জুতো সারাইয়ের দোকান আছে। পরক্ষণেই ভাবলাম জুতো সংক্রান্ত দোকান খোলা না থাকাই স্বাভাবিক। জুতো তো আর চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ডিম নয়! এদিকে, 15 তারিখের পর থেকে লক্ষ করছি বাজারে লকডাউন পরিস্থিতি প্রায় উবে গিয়েছে। মাস্ক পরে হনু সেজে কিলবিল করছে খাদকের দল। সকলের চোখে-মুখেই ‘কী খাই- কী খাই’ ভাব। যদি সব ফুরিয়ে যায়? যদি আমি না পাই? বাড়িতে আছি দু’দিন সবাই মিলে একটু ভাল-মন্দ না খেলে মন ভালো থাকবে কী করে?
(শিল্পী- জয়নুল আবেদিন)
ছেঁড়া জুতো পরে এই সব আজেবাজে কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে মনে হ’ল, একেই বলে হাতে চাঁদ পাওয়া। রিক্সাচালকদের ক্ষেত্রেও তা-ই। রিক্সা কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘সামনের মোড়ে যাবে তো?’
- 10 টাকা বেশি লাগবে দিদি।
- চলো। রিক্সায় পা দেব, ঠিক তখনই দুই বাইকআরোহী লাঠি উঁচিয়ে কুকুর তাড়ানোর ভঙ্গিতে রিক্সাচালকের উদ্দেশে বলে চলে গেল, ‘ওই...রাস্তায় কী করছিস...রাস্তায় যেন না দেখতে পাই’।
এই দুই বাইকআরোহী কারা? পুলিশ? স্বেচ্ছাসেবক?
জানি না। ঘটনার রেশ কাটিয়ে রিক্সায় উঠে মনে মনে ভাবলাম, আমার এই জুতো-ছেঁড়া বিপদে রিক্সাটি না পেলে কী যে হ’তো, ভগবানই জানেন।
হ্যাঁ, বিপদে পড়ে সুবিধা পাওয়ার জন্য আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে মুখে হরিনাম আসে বৈকি! প্রাচীন নিয়ম।
(শিল্পী- জয়নুল আবেদিন)
“সংহারকারী প্রাকৃতিক শক্তি ও বিপথগামী সহজাত প্রবৃত্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সমাজ ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মের সৃষ্টি। বর্বর মানুষ দেখছে, তার আশেপাশে যেসব শক্তিশালী লোক ঘুরে বেড়ায় তাদের সন্তুষ্ট করা যায় ঘুষ দিয়ে অথবা কৌশলে ভয় দেখিয়ে। অলৌকিক বহির্শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে সে এইকথাই ভেবেছে। যাতে অন্যান্য মানুষের মতো সে-ও রাগ, দ্বেষ, ভালোবাসা ইত্যাদির দ্বারা চালিত হয়, সেইজন্য নৈর্ব্যক্তিক প্রকৃতির ওপর অশিক্ষিত মানুষ প্রথমত নরত্ব আরোপ (humanization) করেছে। তারপর তাকে ভয় দেখিয়ে বা তার কথামতো কাজ করে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে। প্রকৃতির প্রতি আদিম মানুষের এই মনোভাবে নতুন কিছুই নেই। বাপমায়ের উপর- বিশেষ করে বাপের উপর ছোট ছেলে এইরকমই মনোভাব পোষণ করে। ছোট ছেলের বাপকে যেমন ভয় করবার কারণ আছে, সঙ্গে সঙ্গে সে জানে বিপদের হাত থেকে বাপই তাকে রক্ষা করবে। বাপের ধারনা থেকেই আদিম মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছে।”(1)
সে যাই হোক... এসব দর্শনতত্ত্ব সব্বাই জানে, যারা জানে না তারা জানতে চায়ও না। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই তাই ধম্মের ষাঁড়ের মতো মুখে হরিনাম নিয়ে রিক্সা করে পৌঁছালাম জুতো সারাইয়ের দোকানে। যা ভেবেছিলাম। বন্ধ। ‘চলুন দাদা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন’ রিক্সা-দাদাকে এ কথা বলতে গিয়ে কী মনে হ’ল দোকানের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হ’ল দোকানের একটা দরজা সামান্য ফাঁক করা। সামনে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বললাম, দোকান কি খোলা?
ভেতর থেকে জবাব এল, ‘হাঁ ঠ্যায়রিয়ে।’
দরজার ফাঁকে চোখ রেখে দেখলাম, ভদ্রলোক যেখানে বসে জুতো মেরামত করেন সেখানেই একটা জায়গা চট দিয়ে ঘিরে উনি রান্নাঘর বানিয়েছেন। সেখানে বসে একটা আলু আর দু’মুঠো চাল ধুচ্ছেন তিনি। ওনার রান্না-খাওয়ার সময় হাতে ছেঁড়া জুতো ধরিয়ে দেব ভেবে কেমন অস্বস্তি বোধ হল। যদিও এধরনের শৌখিন ভাবনায় ওনার পেট ভরবে না। সবকিছুর মূলে তো ওই একটি জিনিসই। পেট ভরানো। দেখলাম ভদ্রলোক আলু-চাল ধোয়া ফেলে তড়িঘড়ি দরজার কাছে এসে আমার হাত থেকে জুতোটা নিয়ে নিলেন। বললেন, ‘বহেন থোড়া ঘুমকে আইয়ে’।
- এই বাজারে কোথায় আর ‘ঘুমব’, আমি দাঁড়াচ্ছি।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানেই থাকেন?’
- নহি, হামার বাড়ি বিহারে আছে। থালা-চম্মচ-ঘান্টা বাজাকে ক্যায়া একদিনকে লিয়ে লকডাউন হুয়া, উসকে বাদ তো এখানেই ফেঁসে গেলাম বহেন। আব অ্যায়সে ক্যায়সে চলেগা, পাতা নেহি। অব তো জুতা সিলানেকে লিয়ে ভি কোয়ি নেহি আতা। সব ঘর মে হ্যায়, হাম জ্যায়সো কে সিওয়া।
বুঝলাম এই ‘হাম জ্যায়সো’ বলতে কী ইঙ্গিত করছেন উনি। পরিযায়ী শ্রমিক। চর্চার বিচারে এখন ‘হট টপিক’।
(শিল্পী- জয়নুল আবেদিন)
জুতো সেলাই করেন যিনি, তাঁকে বলা হয় মুচি। ছোটবেলায় পড়েছিলাম। ‘মুচি’ সূত্রে মনে পড়ল ছোটবেলায় পড়েছিলাম- “ভুলিও না- তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না- নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই!... হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল- মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মন ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।”
ভারতবাসী ভুলে গেছে... হে হে হে। কোনওদিনই মনে রাখেনি। এখন সে রামও নাই, অযোধ্যাও নাই। এখন নরেনের এ বাণী সম্পূর্ণরূপে মারা গিয়েছে, ভারতবাসী এখন মজেছে অন্য নরেন-এ। তাঁর বাণী নেই, আছে শুধু 56 ইঞ্চির ছাতি। সেই ছাতি নিয়ে তিনি বিবেকানন্দ (বিতাড়িত) প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠে যান, দেশবাসীকে দেশ থেকে তাড়ানোর ‘সিলেক্টেড’ সাংবাদিক সম্মেলন করেন।
এই রে, এই দুর্যোগের বেলায় টপিক অন্যদিকে ঘুরে গেলে চলবে না। মূলে ফিরে যাই বরং...
বাড়ি ফিরে এসে খানিক জিরিয়ে পেপার হাতে নিয়ে দেখি, আবার সেই একই। পরিযায়ী শ্রমিক। দুঃখু দুঃখু ভাবের ছবি দিয়ে বিশেষজ্ঞ আলোচনা। ঢং!
এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ। সবাই সবটা জানে। হরিবোল। জাতীয় কোষাগার নেতামন্ত্রীদের ইশারা নির্ভর, এ তো ‘ওপেন সিক্রেট’। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সচেতনতার ক্ষেত্রে জনসাধারণের অবস্থা এই ভাইরাস-সমরে বিমূর্ত আকার ধারণ করেছে, তা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ, তার অবক্ষয় কে আটকাবে?
“জাতির আহ্বানে সাড়া দিবে না?”
এই রে, আবার... আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। কেন যে পড়ে! শিকাগো বক্তৃতার পর স্বদেশাভিমুখে যাত্রার সময় এক সোভিয়েত দম্পতিকে বিবেকানন্দ বলেছিলেন-
“এখন থেকে আমার শুধু একটি মাত্র চিন্তার বিষয় আছে– আর সে হ’ল ভারত। আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে।”
পাদটীকা
--------------------
1স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র বাঙলা মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এর ১০০তম বর্ষপূর্তিতে, মাঘ ১৪০৫ (জানুয়ারী ১৯৯৮) সংখ্যায় প্রকাশিত অবনীভূষণ ঘোষের ‘সভ্যতা ও ধর্মবিশ্বাস- মার্ক্স, ফ্রয়েড ও বিবেকানন্দ’ থেকে সিগমন্ড ফ্রয়েডের এই উক্তিটি সংগৃহিত।
কয়েক দশকের সিনেমা সম্পদ আর অকুতোভয়তা - যা আজ ভীষণভাবে দরকার, হয়ত ভবিষ্যতেও
বিচারবুদ্ধিহীন ফাঁপা আবেগ নয়, চাই বিষয়ের উপরে সঠিক ধারনা ও দখল।
সুন্দর নয়, ‘খ্যাঁচামার্কা’ ছবি আঁকতেই ভালবাসতেন
আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে
সময়টা অস্থির। এই অস্থির সময়কে কেন্দ্র করেই ওপেন উইন্ডো আয়োজন করেছিল ছবি ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর।