×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • অন্তর্যাত্রায় ‘ঊষা’

    মৌনী মন্ডল | 23-04-2020

    ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়

    একবার এক সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়-কে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছেন, আপনার শরীর বিশেষ ভাল নয়, তাও শুনলাম নতুন নাটকের কাজে...

    সাংবাদিকের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ঊষা বলে ওঠেন, “রঙ্গকর্মী সবসময় একটা সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যায়। এই কথায় ‘রঙ্গকর্মী’ যেন তাঁর হাতে গড়া আলাদা কোনও দল নয়, তিনি স্বয়ং। রাতের শেষে আলো আনে ঊষা, আনে নতুন ভোর প্রকৃত অর্থেই সৃষ্টির উৎস ছিলেন ঊষা। হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁর বাংলা উচ্চারণে একটা হিন্দি প্রভাব ছিল, অথচ কী দৃঢ়! বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে একজন রঙ্গকর্মী ভাবতেন, তার বাইরে কিছু নয়।

    তাঁর কাজের পরিসর কত বৃহৎ ছিল, তা আজ ‘গুগল’ করলেই পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর খ্যাতি। ইহজীবনে চেতনার জাগ্রত-ভূমিতে যে কল্পনা, আদর্শ, কাব্য, শিল্প, ভালবাসা- তা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আজীবন; ঊষার কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। মৃত্যুরও একটা উজ্জ্বল রূপ আছে, অমাবস্যার উল্টো পিঠের মতো। মৃত্যু একা, আবার মৃত্যু মানুষকে সমবেতও করে। এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তাঁর চলে যাওয়া এবং বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের তাঁকে ঘিরে স্মৃতিচারণা, তারই ইঙ্গিত। যাঁরা নাটকের মানুষ, তাঁর সহকর্মী অথবা তাঁর কাছের মানুষ, তাঁদের স্মৃতিকোঠায় আজ যেভাবে ঊষা উদিত হয়েছেন, তা-ই ধরা থাকল এই ‘Farewell-এ।

     

    খুব ছোটবেলায় ঊষা মাসির বাড়ি যেতাম: সোহিনী সেনগুপ্ত 

    খুব ছোটবেলায় ঊষা মাসির বাড়ি যেতাম। মা-বাবা বেরোনোর আগে আমায় রেখে আসতেন। তবে বড় হওয়ার পর তেমন যোগাযোগ ছিল না। মার সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। মাস দুয়েক আগে একবার দেখা হয়েছিল। তখন বলছিলেন, অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছি- তোর সঙ্গে এখনও করা হয়নি, এবার আমাদের কেয়া মঞ্চে তুই আমার ডিরেকশনে একটা সোলো পারফরমেন্স করবি। আমি বলেছিলাম, অবশ্যই করব। তারপরই মা সকালে ফোন করে খবর দিল, ঊষা মাসি নেই। তবে, কাজ করতে করতে চলে যাওয়াটা বোধহয় সকলেই চায়। ঊষা মাসিও চেয়েছিল। তাই হ’ল। কাজের মধ্যে থেকেই চলে গেলেন মানুষটা।

     

    লকডাউনের ফলে শেষ সময়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না: সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত

    জাতীয় স্তরে থিয়েটারে পরিচিত মুখ বলতে যাকে চিনি, তিনি হলেন ঊষা দি। তিন দশক হয়ে গেল ঊষাদির সঙ্গে কাজ করছি। আপাতদৃষ্টিতে সবাই তাঁকে কাজের জায়গায় খুব কমান্ডিং মনে করতেন, কিন্তু মজার বিষয়টা হ’ল তাঁর উপরেও কমান্ড দিয়ে কেউ কিছু বললে, উনি শুনতেন। খুব ইমোশনাল ছিলেন। ‘সপ্তপর্ণী-তে আমার পরিচালনায় একটা নাটক ছিল। নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করতে ভালবাসতেন। যে কোনও কাজেই উজ্জীবিত করতেন। লকডাউনের ফলে শেষ সময়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। 

     

     

    একটা ব্যাপারে খুব আফসোস রয়ে গেল: প্রবীর গুহ

    “সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই প্রিয় বন্ধুর চলে যাওয়ার খবর। ঊষা আমার নাট্যবন্ধু। কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। প্রায় একসঙ্গেই আমরা চলা শুরু করেছিলাম, লড়াই শুরু করেছিলাম। সে হঠাৎ করে আমায় ছেড়ে চলে গেল, মন ভাল লাগছে না। তার যে নাট্যকীর্তি, তা অস্বীকার করার নয়। প্রচুর কাজ করেছেন, প্রচুর ভাবনা ভেবেছেন। অনেক সময় অনেককিছু নিয়েই আমাদের মতভেদ হয়েছে, তবে তার থেকেও বেশি হয়েছে মতের মিল। আসলে আমরা দু’জনই বামপন্থী, দু’জনই রাজনৈতিক নাটকে বিশ্বাস করতাম। একসঙ্গে প্রতিবাদে নেমেছি। আমরা দু’জনই একসময় লড়াই করে লাহোরে নাটক করতে গিয়েছিলাম। ঊষার দলে আমি দু-দু’বার ওয়ার্কশপ করেছি। ‘ফুটা চশমা’ নামে একটা পথনাটক করেছিলাম ওদের সঙ্গে। ঊষা আমার পারিবারিক বন্ধু ছিল। একবার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওম প্রকাশ-কে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির। আমি বললাম কী হ’ল ঊষা? ও বলল, মনটা খারাপ লাগছিল, আজ আমার জন্মদিন, ভাবলাম কার বাড়ি যাই, প্রিয়বন্ধুর বাড়ি চলে এলাম। আমার বাড়িতে আসার আগে ফোন করে বলত, এই আমি কিন্তু মাংস খাব না, আমি ফিশ্-ইটার। একটা ব্যাপারে খুব আফসোস রয়ে গেল, ঊষা আমাকে একবার ‘রঙ্গকর্মী’ সম্মান দিয়েছিল। সত্যিকারের সম্মান। আমি ওকে তা ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। আজ ঊষা নেই...আর কিছুই নয়, একজন আত্মীয়ের অভাব তৈরি হল মনের মধ্যে।“ 

     

    ঊষাদির নাটক দেখে বড় হয়েছি:  সীমা মুখোপাধ্যায়

     ঊষাদির নাটক দেখে বড় হয়েছি। ঊষাদির সঙ্গে প্রথম একসঙ্গে কাজ করেছি ‘সপ্তপর্ণী-তে। ঊষাদি শুধু নাট্যকার বা পরিচালক নন, আমার কাছে তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সেই সময়ের নিরিখে একজন মহিলা হিসেবে দাপটের সঙ্গে কাজ করে গিয়েছেন। বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্বকে একসঙ্গে এক মঞ্চে কাজ করানোর জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তা ঊষাদির ছিল। তার চলা এবং চলে যাওয়া বড় অনবদ্য। একজন থিয়েটারের মানুষের জন্য কাজ করতে করতে চলে যাওয়ার থেকে সুখের আর কীই বা হতে পারে! তিনি শুধু বিদেশে কাজ করেছেন এমনটা নয়, সেখানকার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছেন। তৃপ্তি মিত্র...সেই সময় থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্ম, একটা লম্বা যাত্রা। একটা বড় যাপন, এ বড়ই ঈর্ষনীয়।

     

    ওর পঁচাত্তরে ওর আখড়ায় আবিষ্কার করলাম আমি মাত্র একমাসের বড় ওর থেকে: হিরণ মিত্র

    বহু বছর হল নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন নাটকে শিল্প-নির্দেশনার কাজ করার সুবাদেই পরিচয়-বন্ধুত্ব ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই বন্ধুর ঠিকানা এখন আর তার জানা নেই। তাই, অজানা ঠিকানাতেই পাঠালেন একটি চিঠি এবং উৎসর্গ করলেন এই ছবি।

    সত্তরের দশকে, শ্যামানন্দ জালানের অনামিকা কলা সঙ্গমে জড়িয়ে ছিলাম। ঊষাকে ঠিকমতো হয়ত পাইনি। কিন্তু ও বোধহয়, শ্যামানন্দজীর খুব কাছের মানুষ ছিল। পরে অনেক নাটকের কাজে জড়ালাম। সরাসরি ঊষার ‘কাশীনামা, ‘অন্তর্যাত্রা, ‘মান্টো, নানা কাজ একসাথে করতে লাগলাম। হাবিবজী এলেন ‘বিসর্জন’ পরিচালনা করতে। আমি ডিজাইন করতে লাগলাম। হাবিবজী আমায় অনেক আগে থেকেই চিনতেন। কোনও অসুবিধা হল না মিশে যেতে। ঊষার নতুন কাজের ঘরে বহুবার গিয়েছি, বাড়িতেও গিয়েছি। চন্দন সেন-রা যে ‘নাট্য সমন্বয়’ বানাল, ঊষাও ছিল তার এক উদ্যোক্তা। প্রায়ই কথা হ’ত। কাজের কথাই হ’ত। বহু বছর কেটে গেছে ইতিমধ্যে। ইদানিং তেমন বড় কাজ হচ্ছিল বলে জানি না। তাই বহুদিন কথাও হয়নি। ভীষণ উষ্ণতা ছিল আমাদের বন্ধুত্বে। গত বছর ওর পঁচাত্তরে ওর আখড়ায় আবিষ্কার করলাম আমি মাত্র একমাসের বড় ওর থেকে। এটা কোনও চলে যাওয়ার বয়স নয়। কত কাজ বাকি আমাদের। কত কথা বাকি। নাটক নিয়ে। নাট্যভাষা নিয়ে। নাট্যের চলন নিয়ে। কে জানবে সেই সব কথা, কে তর্ক করবে? এমন নারী কন্ঠ, এমন দাপুটে, এমন পা ঠুকে অভিনয় করা। এমন উদাত্ত কন্ঠ, মঞ্চ, প্রেক্ষাগৃহ ভরে যেত, গমগম করতো আমাদের হৃদয়।

    ভাল থেকো ঊষা।

     

     

     


    মৌনী মন্ডল - এর অন্যান্য লেখা


    পড়া ও মনে রাখার মতো চারটি বাংলা বই নিয়েই এই লেখা

    আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে

    টক ফুচকা, মিষ্টি ফুচকা, দই ফুচকা, বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা, হেদুয়ার ফুচকা

    ধ্বংস ও ধসের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ

    কয়েক দশকের সিনেমা সম্পদ আর অকুতোভয়তা - যা আজ ভীষণভাবে দরকার, হয়ত ভবিষ্যতেও

    অন্তর্যাত্রায় ‘ঊষা’-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested