বঙ্কিমচন্দ্র ইহলোকে থাকলে তাঁকে দেখে সখেদে লিখে ফেলতেন, তিনি কী ছিলেন, কী হয়েছেন। সঙ্গে থাকত আশঙ্কার দোলাচল— তিনি কী হতে চলেছেন। নোটবন্দির (Demonetisation) সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হলে 50 দিনের মাথায় তাঁকে জ্বালিয়ে দিতে বলেছিলেন। এমনিও চরম কেতায় প্রায়শই বলে থাকেন, তিনি ফকির, ঝোলা নিয়ে চলে গেলে তাঁর কোনও পিছুটান থাকবে না। অন্তরে যাঁর এত বৈরাগ্যের ভাব, নশ্বর জীবনের প্রতি অপরিসীম তুচ্ছতা, সেই তিনিই এতকাল সিংহহৃদয় নামে পরিচিত হয়ে এসেছেন। শেষে সেই তিনিই কিনা সামান্য চাষাদের কাছে নতজানু হলেন!
রাজনৈতিক জীবনে বহু চড়াই উতরাই তিনি আগেও দেখেছেন। গুজরাতের একটা ভূমিকম্প তাঁর দলীয় পূর্বসূরি কেশুভাই প্যাটেলের জীবনে ভূমিকম্প না আনলে তাঁর হয়তো কখনওই গুজরাতের কুর্সিতে বসা হত না। তারপর এক দাঙ্গায় তাঁর বাঙ্ময় নীরবতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠল, বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার হদ্দমুদ্দরা যখন তাঁর ভিসা, পাসপোর্ট বাতিল করে দিল, মায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তাঁকে রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিলেন, তখনও তো তিনি সংঘের সবুজের অভিযানের সেই নবীন, যিনি আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাতে পারেন! তার পরও তিনি আরও দু'দফায় মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলেছেন। পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে, জনহিতার্থে পুকুর থেকে কুমির পর্যন্ত ধরেছেন। পড়াশোনাতেও কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন বইকি। ‘এনটায়ার পলিটিকাল সায়েন্স'’ নাম্নী একটি অশ্রুতপূর্ব বিষয়ে দু' দু'টো মাস্টার্স ডিগ্রি করে ফেলেছেন। সাধারণের জ্ঞানগম্যিতে এর সব কিছুই খুব যুক্তিগ্রাহ্য মনে না হলেও, আমাদের সকলকেই তা প্রশ্নাতীত ভাবে মানতে হবে, কারণ তিনি স্বমুখে তা জানিয়েছেন। আর আমরা জানি, তিনি কখনও ভুল হতে পারেন না। শঙ্করাচার্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে জগতের সঙ্গে ব্রহ্মটাও মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তিনি ভুল বা মিথ্যা হবেন? নৈব নৈব চ।
তবে ওই যে, দশচক্রে ভগবানও যে ভূত হয়। প্রশ্নহীন, ভ্রান্তিহীন লার্জার দ্যান লাইফ ভাবমূর্তির সেই তিনিও তবে 'ভুল' হলেন। এতকাল দেশের 70 বছরের ভুলকে চাঁদমারি করে, তিনি নিজেকে সত্যাসত্যের উর্ধ্বে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। এ বার তিনি ভুল করলেন, ভুলের পাপস্খালনও করলেন।
আরও পড়ুন: সুপর্ণা, শীত এসেছে জানি, বসন্ত কবে?
এমন সসেমিরা অবস্থায় তাঁকে বোধহয় আর কখনওই পড়তে হয়নি। এর আগে কাশ্মীরকে সবক শিখিয়েছেন, কালো টাকা উদ্ধারকল্পে নিজের জীবনকেও বাজি রেখেছেন। কিন্তু এতশত বীরত্বপূর্ণ কাজ করে শেষে কিনা পরাজয় স্বীকার করতে হল সাধারণ চাষাভুষোর অনমনীয় জেদের কাছে? চালচুলোহীন যে চাষাগুলোকে তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা দেশের শত্রু ঠাওরেছেন, আন্দোলনজীবী বলেছেন, সেই চাষাগুলোর কাছেই কিনা তাঁর সরকারকে এমন করে সরব আত্মসমর্পণ করতে হল? দিবে আর নিবের চিরন্তন খেলায় তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় কর্পোরেট লবি, যারা তাঁকে সেই ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের সময় থেকে মনের মণিকোঠায় রেখেছে, সেই কর্পোরেট লবিকে তিনি কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারলেন না?
এক জন রাজনীতিককে কালোত্তীর্ণ করে রাখে তাঁর সংশয়বোধ। এক জন রাষ্ট্রনেতা কী ভাবে তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির পরিমার্জন করছেন, তার ভিত্তিতে একটা মূল্যায়ন হয় তাঁর ব্যক্তিত্বের। কিন্তু তিনি তো তাঁর প্রায় ঈশ্বরসুলভ ভাবমূর্তি নিয়ে এই সংশয়ের অনেক অনেক উর্ধ্বে। তাই, রিমলেস বহুমূল্য গ্লাসের চশমাতেও তাঁর চোখগুলিকে সে দিন কেমন যেন নিষ্প্রভ লাগছিল। এত কাল যাঁকে পড়শি দেশের বিরুদ্ধে কিংবা বিরোধীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার বক্তিমে দিতে দেখা গেছে, যাঁর সনাতনী ধর্মাচরণের কাছে ম্লান হয়ে গেছে বিজ্ঞান, যুক্তিবোধ, মায় দেশের বিচারব্যবস্থা, তাঁকে কি এমন অকপট স্বীকারোক্তি করতে দেখে ভাল লাগে, এমন নিঃসঙ্গ সম্রাট হিসাবে দেখতে ভাল লাগে?
অমুকের ‘দ্যাশ’, তমুকের ‘ভিটে’ নিয়ে এই ‘দেশ’, তাকে অস্বীকার করাই শাসকের মূর্খামি।
দেশপ্রেমের রেসিপিতে একটু মুক্তিযুদ্ধের মশলা মেশালে ঝাঁঝ বাড়ে।
বোরখা পরা নাজমার বর 2002-এর গুজরাতে খুন হয়, এখন মুশকানরা আল্লা হো আকবর বললেই দোষ হয়ে যাবে?
কালো চামড়ার মানুষদের ওপর অত্যাচারের যে সুদীর্ঘ দলিল, তাতে জর্জ ফ্লয়েডের নামটা নতুন সংযোজন মাত্র।
সঙ্গীতের মহাকাশে ধ্রুবক হয়েই থাকবেন সন্ধ্যা-তারা।
এককালের নবজাগরিত কলকাতার বহু অন্তর্জলি যাত্রা দেখা নন-এসি মেট্রোর বিদায় হল গীতাপাঠের মাধ্যমে!