×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘এক’ নয়, অনেক ভারতই ‘শ্রেষ্ঠ’ ভারত

    বিতান ঘোষ | 04-03-2021

    প্রতীকী ছবি।

    ছিন্নমূল মানুষদের দ্যাশ থাকে, আর মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা আর জাতিসত্তার মধ্যে সমবেত হয়ে আশ্রয় খুঁজে নেয়, তখন সে একটা দেশ খুঁজে পায়। এই বহুধা বিচ্ছিন্ন, খণ্ডিত বহু দ্যাশের সমাহারেই যে ভারত নামক দেশটি (Union of States) তৈরি, তা অনেক সময়ই আমাদের স্মরণে থাকে না।



    সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শরিক হওয়ার জন্যই মনে হয়, গণপরিষদের সদস্যরা এই সত্যকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। সংখ্যাগুরুর ভারতের একমুখনতা যাতে বৈচিত্র্যময় ও সংখ্যালঘু ভারতের কন্ঠস্বরকে অবদমিত করতে না পারে সেই বিষয়ে আম্বেদকর, নেহরু সবিশেষ যত্নশীল ছিলেন। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি হোক কিংবা হিন্দু কোড বিল সংক্রান্ত বিতর্ক— দলের অন্দরেই বহু কেন্দ্রমুখী প্রবণতা এবং সেগুলোর সমর্থকদের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল নেহরুকে। প্রায় ছয় দশক পর দেখা গেল নেহরু-কন্যা ইন্দিরার পৌত্র রাহুল গাঁধীকেও (Rahul Gandhi) এই নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। সংসদে দাঁড়িয়ে শাসক শিবিরের হইহল্লার মধ্যে প্রায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে হচ্ছে, ভারত একটি একমাত্রিক রাষ্ট্র নয়, এটি আসলে রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন— যা পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতার 75 বছর পরেও এই নিয়ে কোনও অন্তিম সমঝোতায় আসতে পারেননি ভারত রাষ্ট্রের অংশীদার (Stake holder)-রা!
     


    সংবিধান মোতাবেক ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোবিশিষ্ট দেশ হলেও, সংবিধান প্রণেতারা সচেতনভাবেই এতে একটা কেন্দ্রমুখী ঝোঁক বজায় রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর 584টি দেশীয় রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা সহজসাধ্য ছিল না। তাই আঞ্চলিক ভিন্নতাকে স্বীকার করেও নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি রাখা ছিল দিল্লির কাছেই। ধ্রুপদী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের এই যে মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য়, তার সূত্র ধরেই ভারত রাষ্ট্রের শাসকরা কেন্দ্রের ক্ষমতাকে দশকের পর দশক ধরেনিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করেছেন, রাজ্যগুলির ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে এবং এখনও পাচ্ছে।
     


    কংগ্রেসের ওল্ড গার্ড প্রবীণতন্ত্র ও সিন্ডিকেটকে কোণঠাসা করতে ইন্দিরা যেভাবে সমস্ত ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন, তাতে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের প্রশ্নে প্রথম সংশয় দেখা দেয়। নেহরু নিজে ভাষা ও ধর্মগত বিভিন্নতায় বিশ্বাসী না হলেও আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলির প্রতি যত্নশীল ছিলেন। ভাষার ভিত্তিরে রাজ্য গঠন তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে পীড়িত করলেও, অঙ্গরাজ্যসমূহের ইউনিয়নের প্রধান হিসাবে তিনি এই ভিন্নতার সরব প্রকাশকে উপেক্ষা করতে চাননি। অবশ্য তাঁর আমলেই মাসুল সমীকরণ নীতির মতো বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিতে বাংলার লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়েছিল। সেই লক্ষ্মী আর বাংলায় ফেরেনি, বিধানচন্দ্র রায়ের চেষ্টা সত্ত্বেও নয়।
     


    গত শতাব্দীর আটের দশকে অবশ্য এই কেন্দ্রমুখীনতায় একটা ছেদ দেখা যায়। যদিও সেটা পূর্ণচ্ছেদ ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে এবং রাজ্যগুলির ক্ষমতায়নের দাবিতে 1984 খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় এক বিরোধী কলক্লেভের আয়োজন করা হয়েছিলএই কনক্লেভের মূল হোতা ছিলেন বাংলার তকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আর এর কুশীলবরা ছিলেন কাশ্মীরের ফারুক আবদুল্লা, কর্ণাটকের রামকৃষ্ণ হেগড়ে, অন্ধ্রপ্রদেশের এনটি রামা রাও, ওড়িশার বিজু পট্টনায়ক প্রমুখরা। এই কনক্লেভের সূত্রেই কেন্দ্রের তকালীন কংগ্রেস সরকার বিচারপতি সারকারিয়ার নেতৃত্বে সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। এই কমিশনের প্রধান কাজ ছিল সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে নতুন করে বিবেচনা করা। কমিশন রাজ্যগুলিকে আরও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও, পরবর্তী সময়ে সেই প্রস্তাবগুলিকে মান্যতা দেওয়া হয়নি। আরও পরে নয়ের দশকে মণ্ডল রাজনীতির সুবাদে মূলত উত্তর ভারতে লালু, মুলায়মের মতো আঞ্চলিক নেতারাও কেন্দ্রের সঙ্গে সমান তালে দর কষাকষির রাজনীতি করে যেতে পেরেছেন। ভিপি সিং-এর সময় থেকে যে জোট রাজনীতির সূত্রপাত হয়, তাতেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এই লালু মুলায়মরা।

     


    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোটের স্বার্থ মাথায় রেখে কখনও মণিপুরি টুপি পড়েন, কখনও বা কাশ্মীরি শাল। কিন্তু দেশের বর্তমান শাসকদল বিজেপি ঐতিহাসিক ভাবেই মনে করে, ভারত একটি অখণ্ড সত্তা। দেশের স্বার্থেই যে আঞ্চলিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, এ কথা তো গোলওয়ারকরও বলে যাচ্ছেন তাঁর ‘We or Our Nationhood Defined’ (1939) গ্রন্থে। তাঁর মতে, ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী প্রত্যেকের একটিই পরিচয়, তিনি ভারতীয়। এর বাইরে অন্য কোনও ভাষাগত বা সংস্কৃতিগত পরিচয় তাঁর মতে ভারত রাষ্ট্রের ধ্বংসের কারণ হবে।
     

    আরও পড়ুন: হলোকস্ট: বিদ্বেষ-সেতুতে জোড়ে ভারত ও জার্মানি


    আজকের ভারত রাষ্ট্রের শাসকও অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রের সোচ্চার সমর্থক, এক ভাষা, এক দেশ, এক জাতির উগ্র প্রচারক। নরেন্দ্র মোদীর বিগত সাত বছরের শাসনে নয়া নাগরিকত্ব আইন, জিএসটি ইত্যাদির মাধ্যমে কিংবা যোজনা কমিশনের অবলুপ্তির মাধ্যমে যেভাবে রাজ্যগুলির ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে খর্ব করা হচ্ছে, তাতে দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। রাহুল সংসদে তাঁর বক্তৃতায় এই ভাবনার গোড়াতেই মোক্ষম আঘাত হেনেছেন। এই দেশটি যে একজন কাশ্মীরি কিংবা মণিপুরীর সঙ্গে পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এবং এই বোঝাপড়ার বন্ধন শিথিল হলে যে দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, তা রাহুল আরও একবার শাসককে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠে, রাহুলের দলও যখন অতীতে এই দেশের শাসক হয়েছে, তখনও কি এই পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে? সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করে দলের আস্থাভাজন লোককে রাজ্যপাল পদে বসানো— এসব তো কংগ্রেস আমলেই শুরু হয়েছে, যেসব রেওয়াজের উত্তরাধিকার বহন করছে আজকের বিজেপি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ""রাহুল যা বলেছেন, তা অভিনব কিছু নয়। সংবিধানে তো এই কথাই বলা হয়েছে। তবে, বিজেপির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান অ্যাজেন্ডার পালটা হিসাবে রাহুলের এই কৌশলটি ভাল লেগেছে।''
     


    ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দিল্লির বজ্র আঁটুনিতে, বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রসের ফস্কা গেরো হয়েছিল। মন্ডল রাজনীতির প্রাবল্যে ভারতের একটা বড় অংশে কংগ্রেস তার প্রভাব হারায়। দক্ষিণের দ্রাবিড় আন্দোলন কিংবা পঞ্জাবের বিচ্ছিনতাবাদকে অবশ্য ভারত রাষ্ট্র নরমে গরমে মূলস্রোতের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। কিন্তু এখান থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, অতিরিক্ত কেন্দ্রাভিমুখীনতা ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে দুর্বলই করবে। অলীক জাতীয়তাবাদী মোহজাল এক ভারতকে শ্রেষ্ঠ ভারত করবে না। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেও সেই আশঙ্কা-বার্তারই পুনরুচ্চারণ। ""আজকের শাসক যেভাবে গোটা দেশকে নিজেদের মতো করে একসূত্রে গাঁথতে চাইছে, তার ফল ভাল হবে না।''

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    দায়িত্বশীল নাগরিককে 74 বছর বয়সী স্বাধীন রাষ্ট্রের উপহার একটা কেক আর চকোলেট

    বাঙালিকে রবীন্দ্র-কবিতা না শুনিয়ে, প্রধানমন্ত্রী ‘খেলা’র মন্ত্র শেখালে জাতির উপকার হতে পারে!

    আসামের ফর্মুলায় বাংলা-জয় হল না বিজেপির।

    শিল্পী মাত্রেই সংশয়ী, সংশয়ী হওয়া মানেই পরশ্রীকাতর হওয়া নয়

    কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই দেশ, আবারও না হয় পরীক্ষা দেবে।

    ‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!

    ‘এক’ নয়, অনেক ভারতই ‘শ্রেষ্ঠ’ ভারত-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested