বুড়িমা বলতেন, ‘ব্যবসাটা হচ্ছে তুচ্ছ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে।' বুড়িমার ‘চকলেট বোম’-এর নাম জানে না এমন মানুষ এই বাংলায় সংখ্যায় কম।
সালটা 1948। সদ্য স্বাধীন হয়েছে ভারত। বহু মানুষ তাঁদের ঘর-বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি ছেড়ে একরাশ যন্ত্রণা বুকে চেপে ওপার বাংলা ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পাড়ি দিলেন এপার বাংলায়, মানে ভারতে। দেশভাগের এই যন্ত্রণা আজও কাঁটার মতো বিঁধে আছে বহু মানুষের হৃদয়ে। এই যন্ত্রণা নিয়ে বহু সিনেমা, গল্প, নাটক হয়েছে। এখনও চলছে রাজনীতি। ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় নীতা চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবীর ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’, এই উক্তি এখনও সবার মনে আছে। তবে এই যন্ত্রণাকে জয় করে নিজের সম্মান, সম্ভ্রম, খ্যাতি অর্জন করেছেন, মাথা তুলে বেঁচেছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এমনই এক ছিন্নমূল মহিলা হলেন অন্নপূর্ণা দাস বা বুড়িমার চকলেট বোমের জন্মদাত্রী ‘বুড়িমা’, যিনি ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় এসেছিলেন। ছিন্নমূল এই অন্নপূর্ণা দাস নিজেই নিজের চেষ্টায় বেঁচেছিলেন। বাঁচিয়েছিলেন নিজের সংসার। আরও বেশ কিছু মানুষের সংসার গড়ে দিয়েছিলেন তিনি নিজের হাতে। এই কাহিনী যত সহজে লেখা হয়ে যাচ্ছে, অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনটা কিন্তু ততটা সহজ ছিল না। অন্নপূর্ণা দাস থেকে তাঁকে ‘বুড়িমা’-য় পরিণত হতে অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। করতে হয়েছে অনেক লড়াই। অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে তবেই তিনি সাফল্য পেয়েছেন। বিড়ি বাঁধা, সবজির দোকান করা, সরস্বতী ঠাকুর বিক্রি করা কি না করেছেন অন্নপূর্ণা দেবী! শেষ পর্যন্ত তিনি খ্যাতি পেয়েছেন ‘বুড়িমা’-র চকলেট বোম তৈরি করে।
অন্নপূর্ণা দাসের জীবনটা একটা লড়াইয়ের ইতিহাস। এই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর উদ্বাস্তু কবিতার সেই লাইনগুলি। বুড়িমার কথা মনে পড়লেই কানে বাজে,
‘চল, তাড়াতাড়ি কর,
আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড় এক্ষুনি।
ভোররাতের স্বপনভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে
আর পাশে ফিরতে হবে না।
উঠে পড় গা ঝাড়া দিয়ে,
সময় নেই-
এমন সুযোগ আর আসবে না কোনও দিন।
বাছবাছাই না করে হাতের কাছে যা পাস
তাই দিয়ে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নে হুট করে।
বেড়িয়ে পড়,
দেরি করলেই পস্তাতে হবে...’
দেশের স্বাধীন হওয়ার এটাই ছিল উপহার। ‘উদ্বাস্তু’-এই নতুন শব্দ জুড়ে গিয়েছিল বহু মানুষের নামের পাশে। এমনই একজন উদ্বাস্তু ছিলেন অন্নপূর্ণা দাস। ওপার বাংলা থেকে তিনিও এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন 1948 সালে । তখন দেশভাগ, দাঙ্গায় বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান। ডাক্তার রোগ ধরতে পারেননি। তাই বাঁচানো যায়নি অন্নপূর্ণা দাসের স্বামীকে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ওপার বাংলা থেকে অন্নপূর্ণা পাড়ি দিলেন গঙ্গারামপুর। ঠাঁই হল সরকারি ক্যাম্পে। গঙ্গারামপুর বাজারে এক জনের কাছ থেকে শিখে নিলেন বিড়ি বাঁধা। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিড়ি বাঁধতে লাগলেন। একটু একটু করে, তাঁর সব হল। বাড়ি, ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে দিলেন কলকাতার বরানগরে। বেলুড়ে ন'শো টাকায় একটা দোকানও কিনলেন অন্নপূর্ণা দাস। আবার গঙ্গারামপুরের পাট চুকিয়ে তিনি চলেন বেলুড়ে। নতুন ঠিকানায়। করলেন নতুন দোকান। কী ব্যবসা করবেন, তার খোঁজে ছেলেকে দোকানে বসিয়ে উত্তরপাড়া, সালকিয়া, বড়বাজার চষে ফেললেন। কোন ব্যবসায় লাভ সেটা যাচাই শুরু করলেন। সরস্বতী পুজোর আগে পিলখানার যোগেন্দ্র পালের কাছ থেকে ঠেলাভর্তি করে প্রতিমা নিয়ে এলেন অন্নপূর্ণা দাস। কারণ বেলুড়ে কোথাও ঠাকুর তৈরি হত না। সবাই দূরে সরস্বতী প্রতিমা কিনতে যেতেন। তাই হাতের কাছে প্রতিমা পেয়ে সবাই নিমেষে কিনে নিলেন সব প্রতিমা। অন্নপূর্ণা দাসের পূর্বানুমান বাস্তবায়িত হল। এরপর দোলের আগে রঙের ব্যবসা শুরু করলেন, তাতেও সাফল্য এল।
এভাবেই একবার কালীপুজোর সময় অন্নপূর্ণা দাসের ইচ্ছে হল নিজের দোকানে বাজি বিক্রি করবেন। হাতে মূলধন নেই। ধার করে সেই টাকায় বাজি কিনলেন অন্নপূর্ণা দাস। তার একদিন পরেই সেই বাজির দোকান ভাঙল পুলিশ। জেদের বসে বাজির ব্যবসা করার প্রতিজ্ঞা করলেন অন্নপূর্ণা দাস । কিছুদিন পরেই একদিন ছেলেকে চমকে দিলেন, বাজি বিক্রির লাইসেন্স জোগাড় করে। পেয়ে গেলেন বাজি তৈরির অনুমতিপত্রও।
এবার আর এক চিন্তায় পড়লেন অন্নপূর্ণা দাস। বাজি তৈরির লাইসেন্স তো পাওয়া গেল, কিন্তু বাজি বানানো হবে কেমন করে? বাঁকুড়ায় আকবর আলির সঙ্গে অন্নপূর্ণা দাসের দেখা হয়েছিল। হাতে ধরে সেই আকবার আলিই বাজি তৈরি শেখালেন তাঁকে। সোরা, বারুদ, গন্ধক কী রকম দেখতে হাতে ধরে চেনালেন, শেখালেন বাজি তৈরীর ফর্মুলা। এর পর প্রথম মরশুমেই বাজিমাত করলেন অন্নপূর্ণা দেবী। তাঁর তৈরি সব বাজি বিক্রি হয়ে গেল। আকবরের ফর্মুলাতেই তৈরি হল ‘বুড়িমার চকলেট বোম’।
আরও পড়ুন: বামাখ্যাপা এখন অন্নদাতা
এরপর সবটাই গল্পের মতো করে চলতে লাগল। বাজি-কারখানার জন্য তালবান্দা, ডানকুনি, শিবকালীতে জায়গা কিনলেন অন্নপূর্ণা দাস। ডানকুনিতে কারখানা করার জন্য মাটি খুঁড়তেই বেরোল এক বিশাল আকারের শিবলিঙ্গ। চকলেট বোমের লোগোতে দেওয়া হল সেই শিবলিঙ্গের ছবি। এরপর কারখানার জন্য কেনা তালবান্দার জমি বুড়িমা বিলিয়ে দিলেন গরিবদের মধ্যে। এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন নিজের উদ্যোগে। অন্নপূর্ণা দেবী বলতেন, ‘ব্যবসাটা হচ্ছে তুচ্ছ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে।'
এখনও 16/1 পিয়ারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বিরাট বাড়ির সর্বত্র বুড়িমা বিরাজমান। যেদিন বুড়িমা প্রয়াত হলেন, সেই দিন থমথমে পরিবেশকে খান খান করে ফেটে উঠেছিল বুড়িমার চকলেট বোম। বুড়িমার মৃত্যুতে তাঁকে সম্মান জানাতেই তাঁর ফর্মুলায় তৈরি চকলেট বোম জয়ধ্বনি হিসেবে ফাটানো হয়েছিল সেদিন। যে চকলেট বোম বানিয়ে গোটা বাজির বাজার জিতে নিয়েছেন, সেটা ফাটিয়েই বুড়িমাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল তাঁর কাছের মানুষেরা।
কেমন করে অন্নপূর্ণা দাস থেকে তিনি বুড়িমা হলেন সেটাও একটা কাহিনী। এক দিন দোকানে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে জিনিস কিনতে এসে বলল ‘বুড়িমা, লজেন্স দাও!’ তখন অন্নপূর্ণা দাসের চুলে পাক ধরেছে। বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে-চোখে। সেই থেকেই বুড়িমা নামটাও ছড়িয়ে পড়ল। অন্নপূর্ণা দেবী হয়ে গেলেন ‘বুড়িমা’। আজ বুড়িমা নামের সঙ্গে সাফল্য শব্দটা জুড়ে গেছে। ছিন্নমূল হয়ে এপার বাংলা এসে কী করে বেঁচে থাকা যাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়ে আমাদের মনে বেঁচে রইলেন ‘বুড়িমা’।
ছিন্নমূল হয়ে ওপার থেকে এপার বাংলায় এসে বাজি বানিয়ে বুড়িমা কালীপুজোর মহালগ্নে বাঙালির শ্রেষ্ঠ ব্র্যান
জ্বালানির দামবৃদ্ধির সঙ্গে এবারের অতিবৃষ্টি যুক্ত হওয়ায় শাক সবজি অগ্নিমূল্য, এখনই দাম কমার আশা নেই।
নেতাজির 125তম জন্মদিন নিয়ে কমিটি, প্রধানমন্ত্রী চেয়ারম্যান, নেই কোনও বৈঠক।
গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরী হওয়ার বদলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন দলীয় কোন্দলে বিদীর্ণ।
Retro Fitting পদ্ধতিতে ডিজেল চালিত বাসকে সিএনজিতে রূপান্তরিত করায় মত নেই বিশেষজ্ঞদের।
ভারতে পুরুষের তুলনায় নারীর জন্মহার বাড়ছে