গর্ভের সন্তান যেন সুস্থ অবস্থায় জন্মায়। সব সন্তানসম্ভবা মহিলার একটাই আকুতি। তবে এর বাইরেও গর্ভের সন্তান নিয়ে পরিবারের অন্য জনেদের অন্য কিছু ভাবনা থেকেই যায়। পরিবারের অন্য সদস্যরা ভাবেন, গর্ভের সন্তান পুরুষ না স্ত্রী। তার ভিত্তিতেই গর্ভবতী মহিলার অনুমতি না নিয়েই আকছার গর্ভপাত ঘটছে আমাদের দেশে, যেটা বেআইনি। গর্ভে কন্যাভ্রুণ থাকলেই একমাত্র এই ভাবে পরিবারের, স্বামীর পছন্দে গর্ভপাত করানো হচ্ছে নির্বিচারে। নেওয়া হচ্ছে না গর্ভবতী মহিলার অনুমতি। কন্যাসন্তান জন্মানোর জন্য কন্যার মা’কে সহ্য করতে হয় নানান গঞ্জনা, এমনকি কন্যাসন্তান-সহ মা'কে মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে আমাদের দেশে। তবে এরই মধ্যে নতুন খবর, ভারতে এই প্রথম পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি 1 হাজার জন পুরুষ পিছু 1 হাজার 20 জন মহিলা আছেন দেশে। এই সমীক্ষা দাবি করছে, এই মুহূর্তে ভারতে জনবিস্ফোরণের কোনও সম্ভাবনা নেই। তা হলে প্রশ্ন উঠছে, ভারতে কি কন্যাভ্রুণ নষ্ট করার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে? আমরা কি আঁধার থেকে আলোর পথে এগোচ্ছি?
অতীত কিন্তু অন্য কথা বলে! সেন্টার ফর সোস্যাল রিসার্চের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতি 25টি কন্যাসন্তানের মধ্যে এক জনকে হত্যা করা হয় এবং 15 বছরের নীচে 15 লাখের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় প্রতি বছর৷ পশ্চিমবঙ্গে 2001-এর হিসেবে অনুযায়ী নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাত 934 ও 1000।
গত 24 নভেম্বর জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম পর্যায়ের তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 1990 সালে ভারতে 1,000 জন পুরুষপিছু মহিলার সংখ্যা ছিল 927 জন। 2005-'06 সালের জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষায় পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যার অনুপাত ছিল সমান-সমান। অর্থাৎ প্রতি 1,000 জন মহিলা পিছু পুরুষের সংখ্যা 1,000 জন। কিন্তু 2015-'16 সালে জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষায় তা কিছুটা কমে গিয়েছিল। মহিলা এবং পুরুষের অনুপাত দাঁড়িয়েছিল 991: 1000। তবে এ বার সংখ্যার হিসেবে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেল মহিলারা। তার ফলে জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষা হোক বা আদমশুমারি— দেশে এই প্রথম পুরুষ,নারীর আনুপাতিক হিসাবের পরিসংখ্যানে পুরুষের নিরিখে নারীদের সংখ্যা বেশি হল। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জনসংখ্যার আর আনুপাতিক হিসেবের তথ্য ‘স্যাম্পেল সার্ভে’-র ভিত্তিতে পাওয়া গিয়েছে। এই সমীক্ষা 2019 সাল থেকে 2021 সালের মধ্যে করা হয়েছে। দেশের 707 টি জেলার 6 লক্ষ 50 হাজার জনের বাড়িতে গিয়ে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। অরুণাচল প্রদেশ, চণ্ডীগড়, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, ওড়িশা, পুদুচেরি, পঞ্জাব, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশে সমীক্ষা হয়েছিল। তাতে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তবে ভারতের মতো এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার দেশে আদৌ স্যাম্পেল সার্ভে করে পাওয়া এই হিসেবে কতটা নির্ভুল, সেটা আদমশুমারির পরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমীক্ষার ফলাফলে সেই তথ্য উঠে এলেও অনেক রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রেই সেই তথ্য মিলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
আরও পড়ুন:নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়াই মেয়েদের স্বাধীনতা
জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধিকর্তা এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ শীল সংবাদ মাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, ‘‘জন্মের সময় পুরুষ ও নারীর অনুপাত যে ভাল হয়েছে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদমশুমারি থেকে আসল ছবিটা স্পষ্ট হলেও এই ফলাফলের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি যে নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের পদক্ষেপগুলি সঠিক দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’’
তবে, গত পাঁচ বছরে দেশে জন্মের যে হিসেব তাতে দেখা যাচ্ছে পুরুষ এবং নারীর অনুপাত 1000 : 929 হয়েছে। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেদের প্রতি প্রাধান্য আছে। নারীদের বোঝা বলে মনে করার প্রচলিত ধারণা থেকে বার হওয়া যায়নি। সমাজের এই পরিস্থিতিতেও পুরুষদের থেকে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশাবাদী প্রশাসনিক মহল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তবে অনেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, নারী এবং পুরুষদের গড় আয়ুর মধ্যে ফারাক আছে, সেটা ভুললে চলবে না। ভারতীয় জনগণনার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, 2010-'14 সালের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলাদের গড় আয়ু ছিল 66.4 বছর এবং 69.6 বছর। তাই ভারতের ক্ষেত্রে জন্মের সময় পুরুষ ও নারীর অনুপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাজ্যের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্য প্রসূন ভৌমিক বলেন, ‘‘জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষার এই রিপোর্ট যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে যেমন হরিয়ানায় পুরুষের চাইতে নারী জন্মানোর হার সবচেয়ে কম।’’ তাঁর বিশ্লেষণ: ‘‘পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প কন্যাসন্তান জন্মানোর পক্ষে সহায়ক হয়েছে। কোনও পরিবারের কোনও মহিলা সন্তানসম্ভবা হলে রাজ্য সরকারের তরফে সেই সন্তানসম্ভবা মহিলার চিকিৎসা, প্রসবের খরচের ব্যবস্থা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার গাড়ির ব্যবস্থা, সদ্যোজাত শিশুর চিকিৎসা, পরিচর্যার জন্য এখন অনেক সহায়তা দেওয়া হয়।’’ তাঁর অভিমত, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পের জন্য কন্যাসন্তানরা এখন আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে। তাই এই রাজ্যে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা বা কন্যাসন্তান জন্মালে তাকে হত্যা করার মতো ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে আদমশুমারির পর পুরো ছবিটা পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন:যাদের ‘লক্ষ্মী’ হওয়া হল না
একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভারতে কন্যাভ্রুণ হত্যার প্রধান কারণ গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের লিঙ্গ পরীক্ষা৷ যদিও ভ্রুণের লিঙ্গ পরীক্ষা নিষিদ্ধ৷ ফলাও করে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে লেখা থাকে, ‘এখানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না।’ কিন্তু মুনাফার লোভে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো এই কাজ অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে৷ ভারতে কন্যাভ্রুণ হত্যা করা যেন একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে ৷ কারণ আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় যখন জানা যায় গর্ভস্থ সন্তান পুত্র না কন্যা, তখন পরিবারের লোকজন কন্যাভ্রুণ নষ্ট করতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইতস্তত করে না৷ ভারতে বছরে ১০ লাখ কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হয়, সমীক্ষা রিপোর্ট তেমনই জানাচ্ছে৷ বলা যায়, পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়, কেড়ে নেওয়া হয় জন্মের অধিকার৷ তার মারাত্মক পরিণতি দেখতে হয় সমাজ তথা দেশকে৷
ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার৷ ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, কন্যাভ্রুণ হত্যা এখন কার্যত গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে৷ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ এবং ওড়িষা— কোথায় নয়? প্রায় সব রাজ্যেই মোটামুটি একই অবস্থা৷
আগামী জনগণনায় বা সেন্সাসে জানা যাবে নারী-পুরুষের সঠিক অনুপাতে কতটা ফারাক৷ বর্তমান অনুপাত প্রতি হাজার পুরুষে ৮০০ বা তার কম নারী৷ এর পরিণামটা হতে চলেছে মারাত্মক৷ ছেলের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে৷ বাড়ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মেয়ে পাচার৷ বাড়ছে বাল্যবিবাহ, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার৷ তবে এর মধ্যে জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষার এই রিপোর্ট যথেষ্ট আশা জাগাচ্ছে। হয়তো এমন এক দিন আসবে যখন পুরুষের তুলনায় শুধু কাজের ক্ষেত্রেই নয়, সংখ্যার দিক থেকেও পুরুষের চাইতে বেশি হয়ে যাবে নারী।
বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের পূর্বাভাস, মাঠের ফসল প্লাবিত হয়ে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা
গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরী হওয়ার বদলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন দলীয় কোন্দলে বিদীর্ণ।
কলকাতা পুর নির্বাচনে বামফ্রন্টের ইস্তাহার দেখে মনে হচ্ছে তৃণমূলের সাফল্য অনুসরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নেতাজির 125তম জন্মদিন নিয়ে কমিটি, প্রধানমন্ত্রী চেয়ারম্যান, নেই কোনও বৈঠক।
প্রকৃতির ক্যানভাসে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মণীশ মিত্রের দেবী মঙ্গলকাব্য
কলকাতায় সার্কাসের তাঁবু উধাও। একসময় শহরে শীতের বার্তা নিয়ে আসত এই সার্কাসের তাঁবু।