আজকের ধনোন্মত্ত, আলোকিত চেতনার ইউরোপ যখন মধ্যযুগে দীর্ঘ ধর্মযুদ্ধে (Crusade) নেমেছে, তখনও এই উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রতা মাথাচাড়া দেয়নি। আজকের এই উপমহাদেশকে তখনকার উপমহাদেশের সঙ্গে মেলানো তাই অতীব কঠিন। পরবর্তী বৈদিক যুগ (Later-Vedic Period) থেকেই এই জম্বুদ্বীপ জুড়ে জাতপাতের জটিল সমীকরণ ছিল। কিন্তু ধর্মে ধর্মে এমন হানাহানি এবং তাকে ঘিরে এমন কুটিল রাজনীতির আবর্তে তখনও ঢুকে পড়েনি এই উপমহাদেশ।
দ্বিজাতি তত্ত্বের হাত ধরে দেশভাগ এসেছে। তার হাত ধরে এসেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হানাহানি, ছিন্নমূল মানুষদের ভিটেমাটি খোঁজার অসম সংগ্রাম। তবু মৌলবাদী রাজনীতি পরিতৃপ্ত হয়নি এখনও। তার চোখে এখনও হিংসার আগুন, এখনও নরসংহারের উদগ্র বাসনা। সে প্রতিস্পর্ধী চরিত্র নিয়ে তার যাবতীয় অন্যায়ের ন্যায্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশভাগের মাসুল সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে বাংলা ও পাঞ্জাবকে। বাংলার কাহিনীটা আরও বেশি করুণ ও প্রহেলিকাময়। 1911-তে বঙ্গভঙ্গ রদ করা গিয়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎ বসুরা তারপরেও বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে দুই বাংলাকে সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে জুড়তে চেয়েছেন। কিন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে মাথানত করতে হয়েছিল ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক জাত্যভিমানকে। রাজনীতির পাশাখেলায় ফজলুল হকরা জেতেননি, জিতেছিলেন মুসলিম লিগের গোঁড়া, রক্ষণশীল সুরাবর্দিরা। লড়াইটা আরও বেশি কঠিন করে দিলেন এপার বাংলার বর্ণহিন্দু ভদ্রবিত্তরা, যাঁরা ক্ষমতার চাল-কলা-মূলো অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে রাজি ছিলেন না। তাঁরাও তাঁদের মতো করে দেশভাগে প্রণোদনা জোগালেন। ঐতিহাসিক জোয়া চ্যাটার্জির ‘Bengal divided: Hindu communalism and partition’ গ্রন্থে এর বিস্তৃত ইতিবৃত্ত আছে। তাই এ দেশের মূলস্রোতের ডিসকোর্স দেশভাগের জন্য যেভাবে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ আর তার সামনে ‘পরাভূত’ গান্ধীকে দোষে, তার মধ্যে ঐতিহাসিক উপাদান খুব কমই আছে। উর্বর কল্পনা ও রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার পরিমাণই বেশি সেখানে।
ওপার বঙ্গেও যে তখন খুব অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ দেখা গিয়েছিল এমন কিন্তু নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয় মুসলিম লিগে, সুরাবর্দির ছত্রচ্ছায়ায়। স্বভাবতই রাজনৈতিক জীবনের সূচনায় বঙ্গবন্ধু দেশভাগ ও বঙ্গভাগের সোচ্চার সমর্থক। পরে প্রায় একক দক্ষতায় সম্প্রদায়গত প্রশ্নটিকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়ে ভাষাগত প্রশ্নটিকে জনগণের মনে উসকে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাকিটা ইতিহাস।
বিশ্বের প্রথম বাংলাভাষী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তবে এই লড়াইতে একজনের নাম প্রায়শই অনুচ্চারিত থেকে যায়, তিনি হলেন মৌলানা ভাসানি, যিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামি লিগের আগে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে বাদ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন ভেদাভেদের উর্ধ্বে সন্ত সুলভ একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। ভারতের বিনোবা ভাবের সঙ্গে যাঁর ব্যক্তিক্ত ও কাজের তুলনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লড়াই রমনার মাঠে সাধারণ জনতার জয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়নি। লড়াই চলেছে নিরন্তর। সেই চোরাগোপ্তা লড়াইতে প্রাণ দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে। সামরিক অভ্যুত্থানে টালমাটাল হয়েছে বঙ্গবন্ধুদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। 1972-এর সংবিধানে বাংলাদেশের যে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হয়েছিল, তা বারবার ঠোক্কর খেয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রনায়ক বনে যাওয়া হোসেন মহম্মদ এরশাদ 1989 সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা হাসিনা ক্ষমতায় এসে 1972-এর সংবিধানকে পুনরায় বলবৎ করেছেন।
শেখ হাসিনা কুমিল্লার ঘটনার দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, কোনও মৌলবাদী শক্তির বাংলাদেশে ঠাঁই নেই। বঙ্গবন্ধু-কন্যার কাছে এমন বক্তব্যই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু হাসিনার লড়াইটা এখন ঘরে-বাইরে। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি বহু দিন ধরেই ক্ষমতার বলয় থেকে অনেকটাই দূরে। জামাত ঘনিষ্ঠ বহু লোককেই জেলের ঘানি টানিয়েছেন হাসিনা। এই অবস্থাতেও হাসিনা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে তাঁর আওয়ামি লিগ উপর্যুপরি সাফল্য পেলেও সে দেশে ভোটদানের হার কমছে। দেশের ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ভূত ভালমতোই চড়ে বসেছে। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েম হওয়ার পর এদের অনেককেই সমাজমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। আবার বিপদের দিনে বাংলাদেশের একদা ‘ত্রাতা’ ভারতও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির লাভক্ষতির অঙ্ক কষে তবেই কূটনীতির পথে এগোতে চাইছে।
আরও পড়ুন: সরকারি পাঠ্য বইয়ে আমরা ওরা
পড়শি গিন্নির গায়ে হাত তুলেছে বলে, অনুরূপ কাজ এ বাড়ির গৃহকর্তার পক্ষে বাহাদুরির হতে পারে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিপীড়িত বলে, এ দেশের হিন্দুদের খোল করতাল নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে এমন তো নয়! নেপালের মদেশীয়, শ্রীলঙ্কার তামিল কিংবা বাংলাদেশের বৌদ্ধ চাকমা— দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মৌলবাদী শক্তির দাপাদাপিতে এই সম্প্রদায়গুলো কোণঠাসা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশেষ কল্কে মিলবে না বলে, আমাদের নেতারা সেসব নিয়ে নীরব থাকেন। কিন্তু অন্য দেশে সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচারকে পুঁজি করে, এই দেশের সংখ্যাগুরুকে ক্ষ্যাপানোর যাবতীয় হীন প্রচেষ্টা করতে তাঁরা কসুর করেন না।
একদা একই দেশ, একই ঐতিহ্য নিয়ে বাঁচা ভারত ও বাংলাদেশ ইতিহাসের সম্পূর্ণ দু'টো আলাদা গতিপথ দিয়ে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সুফল হিসাবে শাহবাগ আন্দোলন পেয়েছে, হুমায়ুন আজাদদের সাহিত্যকীর্তি পেয়েছে। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা, সেই দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জনমনে সঞ্চারিত করতে পারেননি। জহরলাল নেহরু কিন্তু সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রের বিপদ এবং স্খলনের দিকটা নিয়ে আমাদের বারবার সাবধান করেছেন। আর ভারত তো নেহরু বর্ণিত ‘ভাগ্যের অভিসারে’ হেঁটেছে ধর্মবিযুক্ত পথ ধরে— সেই গোড়ার দিন থেকেই। তবে আজ কেন কুমিল্লার ঘটনা দেখিয়ে এই দেশের সংখ্যালঘু পীড়ন ও নিধনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে?
বৌদ্ধ সহজিয়া বজ্রযান মতের উপাসক সাবেক বাংলা, বখতিয়ার খিলজির শাসন দেখেছে, বৈষ্ণব আন্দোলনের ধারাস্রোতে ভিজেছে, শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই দেখেছে। দেখেছে নবাবি শাসন, ব্রিটিশ শাসন, রপ্ত করেছে ভিক্টোরিয়ান আদবকায়দা। মুর্শিদি ও বাওলা গানে মুখরিত হওয়া বাংলার অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য তাকে ধর্মের নিগড়ে বাঁধেনি। আমাদের পড়শি দেশের সংখ্যালঘু পীড়নে ততটাই কষ্ট হয়েছে, যতটা নিজের দেশে সংখ্যালঘু পীড়নে কষ্ট হয়। বাংলাদেশের একাংশ লালন সাঁইদের মত ও পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আমরা কেন রবীন্দ্রনাথদের সেই একই পথ থেকে বিচ্যুত হব?
খাদ্য, বস্ত্র যখন পয়সা দিয়েই কিনতে হয়, সংবাদ নয় কেন?
বুকের মাঝে আস্ত একটা দেশকে যারা লালন করতে ব্যর্থ, তারাই ভাগাভাগির কথা বলে।
দেশভাগের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা তো দেশের বর্তমান শাসকদের পূর্বসূরিরাও, এ কথা কি ভোলা যায়?
সন্তানের বাবার নাম জানতে সমাজের যতই নোলা ছকছক করুক, মা তা জানাতে বাধ্য নন।
যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।
একের পর এক সিদ্ধান্তে আছড়ে পড়ছে বিতর্কের ঝড়, তবু ‘বিদ্যুৎ’-এর চমকে নীরব সমর্থন জোগাচ্ছেন অনেকে।