×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শাসক গুরু লঘু দেখে, হিংসা সংখ্যা গোনে

    বিতান ঘোষ | 23-03-2022

    প্রতীকী ছবি।

    ""কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে,
    বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।''

    যে অস্বস্তিকর অতীত বহু রক্তক্ষয় ও স্বজনবিয়োগের বিনিময়ে কালের গর্ভে সমাহিত রয়েছে, তাকে টেনেহিঁচড়ে বার করে সেখান থেকে রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করা শাসকের পুরনো একটি কৌশল। কাল কালান্তরে দেশ দেশান্তরে এমন বহু নিদর্শন মিলবে। কৌশলী শাসক মাত্রেই জানেন বর্তমানের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অতীতের পানে চেয়ে থাকা এবং অন্যদেরও সেই কাজে প্রণোদিত করার মধ্যেই প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে।

     


    গত শতাব্দীর নয়ের দশকে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কার্যত বিতাড়িত হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রতি অবিচারের প্রশ্নটি উস্কে দিয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর দ্য কাশ্মীর ফাইলস (The Kashmir Files) শীর্ষক সিনেমাটি। সিনেমাটির পরিচালক, কলাকুশলী মায় প্রযোজক সংস্থার পূর্বকৃত নানা কাজের প্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন এটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, যাতে দেশের শাসকদল বিজেপির হাতযশ আছে। নেপথ্যে শাসকের কতটা অনুপ্রেরণা আছে জানা নেই, তবে বিজেপি শাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছবিটিকে করমুক্ত করা হয়েছে, অসমের মতো রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের অর্ধদিবস ছুটি মঞ্জুর হয়েছে স্রেফ একটি আড়াই ঘন্টার সিনেমা দেখার জন্য। পশ্চিমবঙ্গে আবার বিজেপি বিধায়করা দল বেঁধে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমাটি দেখে এসেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, শিল্প ও শিল্পীর প্র‍তি আজন্ম বীতরাগ থাকা শাসকের সুরেই কথা বলেছে এই ছবি।



    ফ্রম রাজতরঙ্গিনী ভায়া হরি সিং টু 370 ধারা— বহু রাজনৈতিক সামাজিক উত্থানপতনের সাক্ষী ভূ-স্বর্গ। স্বাধীনতার পর মূলত আবদুল্লা পরিবারের হাতেই কাশ্মীরের ভালমন্দের ভার তুলে দিয়েছিলেন নেহরু। শেখ আবদুল্লার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হতে চাওয়ার বাসনা নিয়ে বিরোধীরা নানা কটূ কথা বললেও নেহরু বন্ধু আবদুল্লাকে ভরসা করতেন৷ 1982 সালে শেখ আবদুল্লার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লা শেখের স্থলাভিষিক্ত হলেন এবং 1983-র নির্বাচনে আবদুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ ভাবে লড়ে ক্ষমতাসীন হল, ফারুক মুখ্যমন্ত্রী হলেন। অন্যদিকে উপত্যকায় নিজেদের শক্তি যাচাই করতে গিয়ে কংগ্রেস হঠাৎই ন্যাশনাল কনফারেন্সের হাত ছেড়ে দিল এবং তল্পিবাহক মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে গুলাম মহম্মদ শাহ-কে বসাল। এরপরই কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিসরে দ্রুত উঠে এল জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (JKLF)। আপাত ভাবে তারা উদারবাদের কথাই বলত, উপত্যকায় শিখ, ইসলাম ও হিন্দুদের সমানাধিকারের দাবি এবং কেন্দ্রের হাতের পুতুল হওয়া থেকে কাশ্মীরকে বের করে নিয়ে আসাই ছিল তাদের ঘোষিত লক্ষ্য।



    1987-র নির্বাচনে আবার জোট বাঁধল কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্স। উল্টোদিকে বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিল মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট (MUF)ব্যাপক লুঠতরাজ ও ভোট কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত এই নির্বাচনে কংগ্রেস-ন্যাশনাল কনফারেন্স জয়যুক্ত হলেও, মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের প্রার্থীরাও ভাল রকম সাফল্য পেল। কিন্তু প্রামাণ্য তথ্য ও নথি থেকে তারা যখন বুঝল বেশ কিছু আসনে তাদের জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন তারা ভারত রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর বিশেষ আস্থা রাখতে পারেনি। জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের ছত্রচ্ছায়ায় প্রথমে চোরাগোপ্তা হামলা, সংঘর্ষের খবর আসতে লাগল। কিন্তু আন্দোলনের রাশ যখন পাকিস্তান-ঘেঁষা মুজাহিদদের হাতে গেল, তখন উপত্যকার ‘আজাদ’-এর তুলনায় ধর্মীয় ‘জেহাদ’ই প্রাধান্য পেতে থাকল।



    উপত্যকার মসজিদগুলি থেকে লাউডস্পিকারের মাধ্যমে অবিশ্রান্ত ঘৃণা প্রচারে তটস্থ সংখ্যালঘু হিন্দুরা। রাজনৈতিকে দায়ে কতটা অতিকথন বা অনৃতভাষণ ছিল জানা নেই, কিন্তু ওখানে উপস্থিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বহু সাংবাদিকের বয়ান অনুযায়ী, কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের বলা হয়েছিল তারা যেন প্রাণ ও মান বাঁচাতে উপত্যকা ছেড়ে চলে যায় কিন্তু বাড়ির মহিলাদের যেন সেখানে রেখে দিয়ে যায়। এই হুমকি যে নিছক ফাঁপা ছিল না, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যখন 1990 সালের জানুয়ারি মাস থেকে একের পর এক কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং তাদের পরিবার খুন হতে থাকেন। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ ও মান বাঁচাতে পণ্ডিতদের দল হিন্দুপ্রধান জম্মু, কিংবা আরও দূরের পঞ্জাব, হিমাচল এমনকি মহারাষ্ট্রে গিয়ে ঘর বাঁধতে শুরু করেন। অল্প কয়েকটি পরিবার রয়ে যায় সেনা পরিবেষ্টিত উপত্যকার আশ্রয় শিবিরগুলোতে।

     

    সেই সময় কেন্দ্রে জনতা দলের সরকার। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন জুগিয়েছিল বাম ও বিজেপি। মতাদর্শগত ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বাম ও দক্ষিণপন্থার এত কাছাকাছি আসা দেশের রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কাশ্মীরের রাগ অভিমানকে প্রশমিত করতে প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং (VP Singh) উপত্যকার প্রবীণ নেতা মুফতি মহম্মদ সইদ-কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু মুফতি মহম্মদের কন্যা অপহৃত হলেন এবং কন্যাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসার বিনিময়ে পাঁচজন জেকেএলএফ ‘জঙ্গি’কে জেলমুক্ত করতে হয়েছিল। ফারুক আবদুল্লা এমন নতি স্বীকারের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। হতে পারে সেই বিরোধিতার কারণ ছিল আবদুল্লা পরিবারের সঙ্গে মুফতি পরিবারের ‘চির-মধুর’ সম্পর্ক। কিন্তু ভিপি সিং এ বিষয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। ভিপি-কে বাইরে থেকে সমর্থন জোগানো বিজেপি তখন কোথায়? বিজেপি তখন রামজন্মভূমি আন্দোলনের হাত ধরে উত্তর ভারতে নিজেদের রাজনৈতিক জমি শক্তপোক্ত করতে চাইছে। সুদূর কাশ্মীর নিয়ে তখন তাদের ভাবনার অবসর কোথায়?



    খাতায় কলমে দ্য কাশ্মীর ফাইলস একটি মনোরঞ্জক সিনেমা, সে দর্শক সিনেমাটি দেখে সিটি-ই দিন আর কেঁদে ভাসিয়েই দিন— এটি কোনও ডকুমেন্টেড ফিল্ম অর্থাৎ তথ্যচিত্র নয়। শরদিন্দুবাবুর কথায় এটি বড়জোর ফিকসনাইড হিস্ট্রি, হিস্টোরিকাল ফিকশন তো নয়-ই! রাজনীতিকদের খেয়ালবশে যে কোনও জিনিসকেই 'ঐতিহাসিক' বলে দেওয়ার একটা কু-অভ্যাস আছে। তাই তাঁদের স্বআরোপিত ঐতিহাসিক ঘটনার সমর্থনে বা বিরুদ্ধে ইতিহাসের পাঁজিপুঁথি নিয়ে তর্কযুদ্ধে নামতে হবে, এমন কোনও দায় কারও নেই। কিন্তু স্মরণ করে দিতে হবে এটি ইতিহাস নয়, ইতিহাসের আঙ্গিকে খানিক কল্পনাবিলাস আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন। যেমন মালিক মুহাম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ’ একটু ইতিহাসাশ্রয়ী স্বাদু সাহিত্যকর্ম, নিটোল ইতিহাস নয়। শাসক তেড়েফুঁড়ে এটাই ইতিহাস বলে চালাতে এলে ইতিহাসের চোরাগলি থেকেই কিছু প্রশ্ন শাসকের সামনে রাখা যেতে পারে।

    নয়ের দশকের রামজন্মভূমি আন্দোলন এবং সর্বশেষ বাবরি মসজিদ ধ্বংস— সংঘ পরিবার ও বিজেপি কর্তৃক এই যে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আবহ তৈরি করে দেওয়া হল, তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল কাশ্মীর উপত্যকায়। আর্যাবর্তকে হাতের মুঠোয় আনতে গিয়ে আর্যাবর্তের মুকুটটাই আলগা হয়ে গিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দখলদারির মানসিকতাও অবশ্যই এর প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করেছিল, যাতে ভূস্বর্গের আপাত শান্তিকামী মানুষরাও মনে করেছিলেন, কাশ্মীরের জনতার কাছে গণতন্ত্র বিষয়টা দিল্লির তরফে দেওয়া সস্তার হাওয়াই মিঠাই ছাড়া আর কিস্যু নয়— এই আছে তো এই মিলিয়ে গেল। আবার একটি নির্দিষ্ট এলাকার একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া মানে আরও বড় ভয়ঙ্কর এক প্রতিস্পর্ধাকে বাড়তে সাহায্য করা। ইজরায়েল-আমেরিকা প্যালেস্টাইন সংকটে ইয়াসের আরাফতকে গুরুত্ব না দিয়ে হামাসের মতো উগ্র ইসলামিক এক জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল, আর ভারত রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রহসনের মাধ্যমে জেকেএলএফ-কে প্রায় অপাঙক্তেয় করে মুজাহিদ্দিনদের স্বর্গরাজ্য করে তুলেছিল ভূ-স্বর্গকে।



    কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হন্তারক কারা? নিশ্চয়ই তামাম কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ নন, যারা সরকারের তরফে বিনামূল্যে ছড়রা গুলি খেয়ে থাকেন, মাসের পর মাস এলাকাবন্দি হয়ে থাকেন? ধূসর ইতিহাসে অপরাপরকে সাদা ও কালোয় বিভক্ত করে কোন আদিম প্ররোচনার খেলায় মাতল শাসকদল বিজেপি? হল ফেরত দর্শক কিছু জিঘাংসা বুকে নিয়ে সংখ্যালঘু পীড়নকে ন্যায্যতা দান করুক, এমনটাই কি চান এই সিনেমার সামনের ও পিছনের লোকেরা? উত্তর জানা নেই। কিন্তু ডেমোগ্রাফিক ডায়মেনসনের হেরফেরে কে কোথায় সংখ্যাগুরু আর কে কোথায় সংখ্যালঘু বোঝা যায় না। তাই বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুকে প্ররোচিত করার দায় শাসকদেরই নিতে হবে, হাঁটতে হবে অসংখ্য নিরীহ প্রাণের জানাজা কিংবা শ্মশানযাত্রায়। দেশ, দেশান্তরে যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক স্বগৃহে, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত ‘দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই

    সোশাল মি়ডিয়া আর রাজনীতিতে রামের একচ্ছত্র আধিপত্য় হরণ করে এবার আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণ!

    জন্মিলে মরিতে হইবে, ক্যাপিটালিজম সঙ্গ দেবে!

    বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।

    নিছক খাওয়া-পরা নয়, দুর্গতদের পড়াশোনা আর স্বাস্থ্যেও সমান নজর দিতে চাইছে ‘জোনাকি’।

    তালিবানি মৌলবাদের রোগ পালটা মৌলবাদী দাওয়াইতে সারবে না, এটা দেশের রাজনৈতিক তালেবরদের বুঝতে হবে।

    শাসক গুরু লঘু দেখে, হিংসা সংখ্যা গোনে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested