×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • নীলকণ্ঠ পাখিটার খোঁজ আজও চলছে

    বিতান ঘোষ | 24-07-2021

    প্রতীকী ছবি।

    উপন্যাসটি পড়ার আগে জেনেছিলাম, গুণীজনেরা বলেছেন, এটি উপমহাদেশের বিবেক। এই বিশেষণটিই আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল এক নিঃশ্বাসে এই উপন্যাসটি পড়ে ফেলতে। এত ক্ষতবিক্ষত উপমহাদেশের বিবেক সঙ্গোপনে কোন অজানা ব্যথায় ডুকরে ওঠে, তা জানার এক অদম্য ইচ্ছায় পড়তে শুরু করলাম অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকন্ঠ পাখির খোঁজেউপন্যাসের চলন কী ভীষণ সাবলীল, গ্রামের প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া, নাম না জানা নদীর টলটলে জল যেন। ঔপন্যাসিক উপন্যাসে পাঠকদের তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটা, তা দেখাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছেন না। শুধু নিজের হৃদয়মন্থন করে তুলে আনছেন অমৃত আর হলাহল। উপমহাদেশের বিবেক কেমন আছে— বহুদিন তাকে এত বড় যাত্রামঞ্চে খুঁজে পাইনি। তারই অন্বেষণে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পথ চলা শুরু করলাম

     

     

    উপন্যাসে ছোট বড় নানা রঙের চরিত্র। প্রত্যেকেই ভীষণ রকম জীবন্ত, যাদের উত্তরসূরীদের সঙ্গে এখনও ট্রেনে বাসে দেখা হয়। যন্ত্রনা রেখে ঢেকে হাসি বিনিময় হয়। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ঠাকুরবাড়ির বড় ছেলে মণীন্দ্রনাথ ওরফে মণি, যে জীবনের হারিয়ে যাওয়া নীলকন্ঠ পাখিগুলোর খোঁজ করতে করতে পাগল হয়ে গেছে। সত্যিই কি পুরাণের সেই নীলকন্ঠ পাখি, এককালে এই বাংলাদেশের গাছের ডালে ডালে এসে বসত? লেখক মণিকে দিয়েই বলিয়ে নিচ্ছেন, এই কামনা-বাসনা রূপ নীলকন্ঠ তো আমাদের হৃদয়েই বাস করে। তাকে যতই আমরা ধরার চেষ্টা করি না কেন, সে নাগাল এড়িয়ে উড়ে যায় বারবার। এই মহামারী পীড়িত সময়ে অনেকেরই নীলকন্ঠ পাখি খোয়া গেছে। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে চাকরি হারিয়েছে, দিনমজুর বাপের ছেলেটা স্কুলবাড়ি, সেখানকার বন্ধুদের হারিয়েছে, হয়তো চিরতরেই। বহুদিন দেখা হয় না বলে অপরিণত কত প্রেম আর পরিণতি পায়নি

     

     

    মণীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের মাঠ ঘাট পেরিয়ে, অর্থহীন শব্দ গ্যাৎচোরেৎশালাবলে চিৎকার করে নীলকন্ঠ পাখি খুঁজত। খুঁজত তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী পলিনকে। কাহিনীর এই অংশ যেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপ্তপদীউপন্যাসকে মনে করায়। ঘটনাগুলি আবর্তিত হয় অবিভক্ত বাংলার নারায়ণগঞ্জ জেলার জল-জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম রাইনাদিকে কেন্দ্র করে। মটকিলা গাছের ঝোপে, কাফিলা গাছের ছায়ায় গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান করে। ঠাকুরবাড়ির সকল কাজে যেমন মুসলমান পাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনই গরিব মুসলিম ঘরগুলির বিপদে-আপদে ঠাকুরবাড়ির ছোটকর্তা তাঁদের পাশে দাঁড়ান। আর ঠাকুরবাড়ির আদরের সোনার প্রাণের সুহৃদ সামসুদ্দিনের মেয়ে ফতিমা। তারা হাত ধরে পথে মাঠে ঘোরে, অজানা এক শিহরণে শিহরিত হয়ে একে অপরের হাত ধরে। কিন্তু বাড়িতে বলে না সে কথা, তাহলে হিন্দু সোনাকে স্নান করে পবিত্রহয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। ফতিমার বাবা মুসলিম লিগ করেন, সোনার ছোট কাকা কংগ্রেস। দু'জনেরই দু'জনের প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, বাৎসল্য, অথচ প্রচার, পালটা প্রচার চলতে থাকে। বুকের মাঝে করাতকল চলে, ছোট্ট সোনা ফতিমা বোঝে না কীসের জন্য এত ভাগ বাঁটোয়ারা

     

    (সৃষ্টি ও স্রষ্টা: পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের প্রচ্ছদ এবং অতীন বন্দোপাধ্যায়)

     

    ঠাকুরবাড়ির খাস লোক ঈশম। সে সারাদিন বাবুদের তরমুজ খেত পাহারা দেয়। সেই তরমুজ খেতকে সে অপত্য স্নেহে বড় করে তোলে। সেই জমিই তাঁর কাছে প্রাণ। গ্রাম্য আটপৌরে জীবন এগোতে থাকে নিজস্ব ছন্দে। কিন্তু ছন্দপতন হতেও বিলম্ব হয় না। দিকে দিকে শ্লোগান শোনা যায়, ‘আল্লা হু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ। হিন্দুপাড়া গুলি থেকে পাল্টা আসে, ‘বন্দেমাতরম’, ‘ভারত মাতা ী জয়এতদিনের সম্পর্কগুলোকে যেন ধর্মের নামে কোতল করার প্রণোদনা আসতে থাকে দু'পক্ষ থেকেই। মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা বেতারে সম্প্রচারিত হওয়ার পরই হিন্দুপাড়া গুলো ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকে। ঠাকুরবাড়ির সবাই জমিজিরেত, এমনকি ঈশমের তরমুজ খেত বিক্রি করে দিয়ে হিন্দুস্তানে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বাড়ির বড় ছেলে পাগল মণীন্দ্রনাথের আর বাড়ি ফেরা হয় না। সহজ সাদাসিধে উদাসী মানুষটাকে ধর্মের ছোরা দিয়ে কোরবানি করে দেওয়া হয়। এই কাহিনীর বিবেক কি তবে এই পাগল ঠাকুর, যিনি চিরতরে নীরব হয়ে গেলেন? যেন তাঁর ভাইপো তাঁকে কিটসের কবিতা সুর করে পড়তে বললেই তিনি বলবেন, ‘আমাকে গাহিতে বোলো নাতারপর জন্মভিটে, এতদিনের সম্পর্কগুলোকে নিয়ে এতবড় রাজনৈতিক প্রহসন দেখে আবারও গেয়ে উঠবেন, ‘এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?’

     

     

    কখনও কখনও ভ্রম হয়, মনে হয়ে ঈশমই বুঝি এই কাহিনির বিবেক, উপমহাদেশ তাঁর কন্ঠে বাঙময় হচ্ছে। সে নিরক্ষর, কিন্তু দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী লড়ালড়ি দেখে, সে ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলে, ‘কার দেশ, কে দেবে আর কেই বা নেবে?’ সত্যিই তো, দেশটা কার? বুকের মাঝে এত বড় একটা দেশ, তাতে কাঁটাতার বসানোর স্পর্ধা দেখায় কোন আহাম্মক? কালক্রমে ঠাকুরবাড়ির সবাই হিন্দুস্তানে চলে যায়। ঈশম জীবনের অন্তিম দিনে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে সেই তরমুজ খেতে ফিরে আসে এবং সেখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগে একমুঠো বালিমাটি নিয়ে সে বলে, ‘এই তো আমার দেশএকদিন এই রুখা মাটিতে সে তরমুজ ফলিয়েছিল, এখন সেসব রুখাসুখা ঘাসজমি। উপমহাদেশের ভালবাসা, মমতায় আর্দ্র হৃদয়টাও তো একদিনের সরকারি নোটিসে কেমন শুকিয়ে ফুটিফাটা হয়ে গেল, আর সেখানে ফসল ফলল না। সোনা আর ফতিমা কোনওদিন মিলল না। তারা হয়ে গেল দুই স্বাধীন দেশের নাগরিক। আফসোস হয়, ‘এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।'

     

    বিবেকের অন্বেষণে তখনও আমি রত। উপন্যাস অন্তিমপর্বের দিকে ধাবমান। ফতিমার মুসলিম লিগ নেতা বাবা জিন্নার সামনে বলে এসেছেন, ‘আমাদের ভাষা বাংলাই থাইকব।' শেষে আর একটা লড়াই, এই লড়াই এবার হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের স্বাভিমানের লড়াই নয়, বাঙালির ভাষা বাঙালির মুখে ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। এই লড়াই শেষে সামসুদ্দিন তাঁর পুরনো গ্রাম রাইনাদিতে ফেরেন। ঈশমকে কবরস্থ করার আগে তাঁর অকপট আত্মোপলব্ধি, তাঁর এতদিনের লড়াই সব বৃথা। ঈশমই তাঁকে বুঝিয়েছে, দেশ কাকে বলে। এককালের বড় মুসলিম লিগ নেতা ঈশমের কবরে মাটি দিতে দিতে বলেন, সোনা বেইমান, কেননা সে তাঁদের সকলকে ছেড়ে হিন্দুস্তানে চলে গেছে। মনে রাখেনি যে, এই দেশেও ওর নিজের কত মানুষ ছিল। আবার দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে আমার মন। তবে কি সামসুদ্দিন ওরফে সামুই এই উপমহাদেশের বিবেক?  খেলাঘর ভেঙে গেছে। সামুরা চেয়েছিল ভাঙতে। কিন্তু প্রতিদানে কী পেল সামু, সোনা, ফতিমা? দেশ পেল? শৈশবের স্মৃতিকে বুকে আগলে নিয়ে কে কোথায় সব ছড়িয়ে পড়ল চিরদিনের মতো। এসব সয়ে বিলাপ করে ওঠে এই উপমহাদেশের বিবেক। বলে, ‘কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সঙ্গীত হারা।'

     

    আরও পড়ুন: খাদ্যের অখাদ্য বিচার: বিশ একুশে মনুসংহিতা (3)

     

    এই ক্ষতবিক্ষত উপমহাদেশের দর্পণ হয়ে রয়ে যায় একটি অর্জুনগাছ। যাতে ছোট্ট সোনা খোঁজ না পাওয়া মণীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে খোদাই করে লিখে দিয়ে যায়, ‘জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্তানে চলে গেছি। ইতি, সোনা।' সেই দর্পণে মুখ রাখলে কয়েক প্রজন্ম পরেও আমাদের লজ্জায়, কষ্টে চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে। শৈশবে সোনা, ফতিমার বুকের মধ্যে যে একটা ছোট্ট দেশ ছিল, তা ফালা ফালা করে কেটে ফেলা হয়েছে। লেখক প্রোটাগনিস্ট নন, তিনি কালের পর্যবেক্ষক মাত্র। তাই তিনি আঙুল উঁচিয়ে বলেননি, এই দেশকে ভাঙল যারা, তারা ওই অর্জুনগাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াক, সোনা-ফতিমার সামনে দাঁড়িয়ে তারা জবাবদিহি করুক। সেই ভার হয়তো উনি পাঠকদের ওপরেই ছেড়েছেন

     

     

    আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী তো বলেন, উনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। উনি কি জানতেন না এই অর্জুন গাছগুলোর কথা? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুমকির সুরে একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষকে বলছেন, বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবেন। উনি জানেন না, দেশের পূর্ব-পশ্চিম উভয় সীমান্তেই কত ঈশমদের তরমুজ খেত শুকিয়ে গেছে? কত সোনা আর ফতিমাদের আর কখনও দেখা হয়নি? এসব নিষ্ঠুর রসিকতায় তাঁর লজ্জা হয় না? একদল বলছেন অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র বানাবেন, আর একদল বলছেন দার-উল-ইসলাম। কেউ বলছেন না সেই দেশের কথা, যেখানে সোনা-ফতিমারা হাত ধরাধরি করে একদিন নীলকন্ঠ পাখি খুঁজত। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাই, সোনালী বালির চরে এখনও ওরা বসে আছে, ওদের বয়স বাড়েনি। ওদের বুকের মাঝে আস্ত এক দেশ আছে, যেখানে কোনও হিংসা নেই, বিদ্বেষ নেই। উপমহাদেশের বিবেক এরাই। হয়তো কান্না লুকিয়ে উপমহাদেশ বলে ওঠে আমার বুকে সোনা-ফতিমারা যেন চিরকাল খেলে বেড়ায়। রাজনীতির কারবারিরা ভুলেও যেন আর তাদের ভেন্নকরার চেষ্টা না করে


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    লাল ফিতের ফাঁসে রুদ্ধ আমলাতন্ত্রের মুক্তির নামে বাংলায় এখন চলছে আসলে ব্যক্তির একক শাসন।

    ‘সৃষ্টিছাড়া’ বাংলায় লক্ষ্মী-সরস্বতীও দিদি-বোন হয়ে যায়।

    প্রতিস্পর্ধা-সঞ্জাত, স্বাতন্ত্রমন্ডিত আলোকবর্তিকাই 2022-এর অন্ধকার দিকগুলোয় আলো ফেলবে।

    বুলডোজার ব্যবহার করা হচ্ছে সহনশীলতা, বহুত্ববাদের মতো প্রকৃত ভারতীয় সত্তাগুলিকে ধ্বংস করতে।

    ভরসা নেই মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিতে, রাজ্যে বিজেপিকে রুখতে নাগরিক শপথ শহরে।

    দায়িত্বশীল নাগরিককে 74 বছর বয়সী স্বাধীন রাষ্ট্রের উপহার একটা কেক আর চকোলেট

    নীলকণ্ঠ পাখিটার খোঁজ আজও চলছে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested