×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • তোমার পূজার ছলে ভোটে লড়েই থাকি!

    বিতান ঘোষ | 14-02-2021

    কবিগুরু, তুমি কার?

    তিনি লিখেছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি।' কবির তিরোধানের এখনও শতবর্ষ হয়নি, তার আগেই তাঁকে নিয়ে শুরু হয়েছে এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক টানাটানি। অদূরে বঙ্গের বিধানসভা দখলের লড়াই। সেই লড়াইয়ে যুযুধান দুই শক্তি তৃণমূল আর বিজেপি স্বয়ং কবিগুরুকেই ভোট ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে। বাম-কংগ্রেসের তরফেও এই নিয়ে তাল ঠোকাঠুকি চলছে। নিজেদের রবীন্দ্রপ্রীতি বোঝাতে রাজনৈতিক দলগুলির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে রবীন্দ্রপ্রেমী ও রবীন্দ্রভক্ত বঙ্গবাসীর ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা!

    প্রথমে লড়াইটা শুরু হয়েছিল বহিরাগতএবং বঙ্গ সংস্কৃতিনিয়ে। ক্রমে তারই সূত্র ধরে এসে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের মুখে ঘুরে ফিরে আসতে থাকল রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতার লাইন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর অতি-দুর্বোধ্য বাংলা উচ্চারণে কবিগুরুর কবিতা শোনালেন। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত সমারোহের মাঝে কোথাও কি গুরুত্ব পাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, সমাজভাবনা, স্বদেশ সম্পর্কিত ধারণা? বাঙালির একটা বড় অংশ মনে করছেন, এই জায়গাতেই মস্ত একটা ফাঁকি রয়ে যাচ্ছে। তাঁদের মতে, রবীন্দ্রনাথ তো নিছক একজন কবি বা গীতিকার নন, তিনি বিংশ শতকের অন্যতম চিন্তাবিদ। তিনি যেমন তাঁর চেতনায়, মানসলোকে বর্তমানকে দেখেছেন, আবার ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসাবে আগামীর সম্ভাব্য গতিপথেরও হদিস দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীতের বাণীগুলোকেই প্রাধান্য দিতে বলেছেন। অথচ, অনেকেরই আক্ষেপ সেই বাণীগুলোকে হালের নীতিহীন রাজনীতি হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না

    রবীন্দ্রনাথ কখনওই তাঁর অন্দরের দরজায় পাহারা বসিয়ে বাহিরকে দূরে রেখে দেননি। সীমানার ব্যবধান পেরিয়ে তিনি সমকালকে দেখেছেন, তাঁর মতো করে তার মূল্যায়নও করেছেন। দেশের স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দেশের অধিকাংশ নরনারী যখন অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেইসময় বিদেশি বস্ত্র পুড়িয়ে ফেলার মধ্যে গঠনমূলক কিছু খুঁজে পাননি তিনি। সে সময় সারা বিশ্বে যে প্রক্রিয়ায় জাতিরাষ্ট্র (Nation State) তৈরি হচ্ছে, তাও মনে ধরেনি রবীন্দ্রনাথের। রাষ্ট্রনির্ভর উগ্র জাতীয়তাবাদের জাঁকজমকপূর্ণ প্রচারের আড়ালে অন্তঃসারশূন্যতাই দেখেছিল কবিমানস। এক জায়গায় কবি লিখছেন, ‘যখন দেখি মানবস্রোত চলছে, চতুর্দিকে বিচিত্র কল্লোল, উদ্দাম বেগ, প্রবল গতি, অবিশ্রান্ত কর্ম, তখন আমারও মন নেচে ওঠে। তখন ইচ্ছা করে বহু বছরের গৃহবন্ধন ছিন্ন করে একেবারে বাহির হয়ে পড়ি। কিন্তু, তার পরেই রিক্ত হস্তের দিকে চেয়ে ভাবি পাথেয় কোথায়। হৃদয়ে সে অসীম আশা, জীবনে সে অশ্রান্ত বল, বিশ্বাসের সে অপ্রতিহত ভাব কোথায়।' রবীন্দ্রনাথ তাই বারবার জোর দিচ্ছেন সমাজ গঠনে, বাঁধনঘেরা রাষ্ট্র নির্মাণে নয়। সমাজের আত্মশক্তিই আগামীর চালিকাশক্তি— আগাগোড়া এই বিশ্বাসে অটল থেকেছেন কবি। আর কবির মতে এই আত্মশক্তি আসবে ভারতবর্ষের সমাজের বৈচিত্র্যের মধ্য থেকে। কবি বলছেন, ‘সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে, পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।' হায়! যেসব রাজনীতিকরা দিবারাত্র রবীন্দ্র বন্দনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন বলে দাবি করছেন, তারা যদি কবির এই কথাগুলো স্মরণে রাখতেন...

    রবীন্দ্রনাথ চাইতেন তাঁর উল্টোমতের মানুষটিকেও সাদরে গ্রহণ করতে, তাঁর সঙ্গে মতবিনিময় করতে। গান্ধীর অসহযোগের পথ নিয়ে তাঁর কিছু প্রশ্ন ছিল। বিহারের ভয়াল ভূমিকম্পের পরে গান্ধীজি বললেন, অস্পৃশ্যতার পাপে এসব ঘটছে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে চিঠি লিখলেন তাঁকে। অলৌকিকতা ও কুসংস্কার ছড়ানোর দায়ে দুষলেন গান্ধীজিকে। গান্ধীও রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠির প্রত্যুত্তর সহ সবটা তাঁর হরিজনপত্রিকায় প্রকাশ করলেন। আজকের ভারতবর্ষে শাসকপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধমতের মানুষটির সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে, তেমনটা কি আমরা কল্পনাও করতে পারি?

    বাঙালি আবেগ ছুঁয়ে ভোট বৈতরণী পেরোতে কেন তবে এই রবীন্দ্রপুজোর ছল? এই ছলনার বিরুদ্ধেও তো বারবার কবির প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। স্বদেশ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যাসত্যই করি, ভান না করি। অক্ষমতার প্রধান বিপদ এই যে, সে বৃহৎ কাজ করতে পারে না বলে বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর মনে করে।' আজকের রাজনীতিকরা এগুলো পড়ে একটুও কি লজ্জিত হবেন না? তাঁদের বক্তৃতামালায় হঠাৎ প্রসঙ্গহীন ভাবেই উঠে আসা দু'লাইনের রবীন্দ্রনাথেই কি সামগ্রিক রবীন্দ্রচেতনার পরিসমাপ্তি ঘটবে? উগ্র দেশপ্রেমে জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাকে ঢেকে রাখা বলশালী রাষ্ট্রনেতা তাঁর সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দেবেন না, ‘সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে কবির সেই স্পর্ধিত উচ্চারণ? ‘এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা, মদমত্ততা, আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয়, তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।' প্রিয় দেশনেতারা, এবার তো বুঝুন রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলার ভোট ময়দানে নেই, আছেন সিঙ্ঘু সীমান্তে কৃষকদের অবস্থানে, আছেন আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনেও

    রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই অলীক কুনাট্যে অনেকের গলাতেই আক্ষেপ ঝরে পড়ছে। কবীর সুমন যেমন জানালেন, ‘যে দলটা (পড়ুন বিজেপি) রবীন্দ্রনাথকে চিনল না, সর্বোপরি যাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং আদর্শের সবচেয়ে বড় বিরোধী রবীন্দ্রনাথ, তাদের মুখে রবীন্দ্রনাথের কথা শুনলে বেদম হাসি পায়। আর বিজেপির বিরোধী দল হিসাবে তৃণমূলও বাধ্যতই এই রবীন্দ্র-রাজনীতিতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে।' চিত্রপরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের মত, ‘বাংলার কমবেশি প্রত্যেকটা দলের অধিকাংশ নেতানেত্রী রবীন্দ্রনাথকে পড়েননি, জানেননি, বোঝা তো দূরস্থান— অনেকে একটা গোটা কবিতাও মুখস্থ বলতে পারবেন না। রাজনীতির মান এখন এতটাই অধোগামী যে রাজনীতিকদের রবীন্দ্রনাথকে ধরে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।' তবে, একইসঙ্গে তাঁর সংযত প্রতিক্রিয়া, ‘প্রশ্নটা এখন বাংলার সংস্কৃতি রক্ষা করার। সেই বিচারে বিজেপির তুলনায় অবশ্যই তৃণমূল কিংবা বামেরা অনেক বেশি নিরাপদ।'

    আজকের বহুবিভক্ত ভারতবর্ষের একটা অঙ্গরাজ্যে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে ভাসছে ধর্ম, জাতপাত, কবিগুরুও। কবি তো তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছিলেন, ‘পরকে আপন করিবার প্রতিভাএই ভারতের রয়েছে। রাজনীতির এই আপন-পরের খেলায় তাঁকেও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা প্রত্যক্ষ করলে কবি কী বলতেন সেই উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু রাজ্য রাজনীতির এই দেউলিয়াপনায় বীতশ্রদ্ধ বাঙালি কবিকে ধার করেই বলবে, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান...অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।'


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বামপন্থার পুনরুত্থান, নাকি জনপ্রিয়তাবাদের হাত ধরে নব্য নাৎসি দমন; রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত কী?

    ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?

    নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে

    কখনও ইন্দিরা, কখনও আডবানী, রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষক লতা চিরকালই শাসকের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন।

    ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।

    গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সীমান্ত দ্বৈরথ কেন এমন রক্তক্ষয়ী মল্লযুদ্ধের চেহারা নিল, তার ময়নাতদন্তে..

    তোমার পূজার ছলে ভোটে লড়েই থাকি!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested