×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শয়নে স্বপনে, রয়েছ রাষ্ট্রেরই নয়নে!

    বিতান ঘোষ | 02-03-2022

    প্রতীকী ছবি।


    ‘Alert! You are under CCTV surveillance’ — পথে ঘাটে বেরোলে বহু জায়গাতেই এই সাবধান বার্তা আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু সাবধান বার্তা ব্যতিরেকেই যদি অনুপুঙ্খ জরিপ করা হয় আপনাকে, আপনার যাবতীয় কার্যকলাপকে? বিস্মিত হচ্ছেন? হয়তো আপনার বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করেই শাসক বুঝে গেছে আপনি এখন বিস্মিত হচ্ছেন, এরপর হয়তো রুষ্ট হবেন



    নজরদার রাষ্ট্রের নজরদারি নিয়ে দিস্তাদিস্তা নিউজপ্রিন্ট খরচ হচ্ছে। সম্প্রতি পেগাসাস-কাণ্ডের পর ব্যক্তিমানুষের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক চলছে। এমনিতেও ব্যক্তিমানুষ তার রেফ্রিজারেটরে কীসের মাংস রাখছেন, কী পোশাক পরছেন, কোন বই পড়ছেন, কোন সংগঠন করছেন, তা রাষ্ট্রের নখদর্পনে। রাষ্ট্র তাই সমতায় বিশ্বাসী। তবে এই সাম্য অর্থনৈতিক সাম্য নয়, বরং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মাঝে এই সমতা ভাবনার, এই সমতা মতপ্রকাশের। বিরুদ্ধ কিংবা ব্যতিক্রমী ভাবনাকে কেটে-ছেঁটে বাকিদের সমান করাই রাষ্ট্রের এক এবং অদ্বিতীয় কর্তব্য



    জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত '1984' উপন্যাসে এমনই এক নজরদার রাষ্ট্রের রূপ বর্ণনা করেছেন। সম্প্রতি সংসৃতি নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে এবং দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়, ‘1984’ উপন্যাসের আঙ্গিকে ওই একই নামে একটি নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। গত 27 ফেব্রুয়ারি কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে তারই প্রথম অভিনয় সম্পন্ন হল। নাটকের গৌতম ইসলাম নাম্নী এক চরিত্র প্রায়ই বিস্মরণের অতলে ডুবে যান। হাতে নোটবুক নিয়ে কবিতা লেখেন। আর পার্টিজান হয়েও সর্বান্তকরণে চান পার্টি ভিতর থেকে পচে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক



    পার্টির শীর্ষে রয়েছেন বিবি বোস। অরওয়েলের বিগ ব্রাদার, নাট্যমঞ্চে বি-বি হয়েছেন। তাঁর নজরদারির বাইরে কেউ নন, এমনকি ঘনিষ্ঠ পার্টিকর্মীরাও নন। বিগ ব্রাদার বিরোধী দলের অস্তিত্ব মানেন না, মানেন না নরনারীর প্রেম কিংবা যৌনসুখেরমতো মানসিক এবং জৈবিক তাড়নাগুলিকেও। কারণ এগুলো পার্টির শৃঙখলাকে ভঙ্গ করে। যারা পার্টি-বিরোধী, পার্টি তাদের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। নাটকের গৌতম যেমন অনুগত পার্টিকর্মী হিসাবে স্বহস্তে কয়েকজন মানুষের যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলে। ক্ষমতা ও ক্ষমতাসীনের কাছে এরা অস্তিত্বহীন, আছে কিন্তু নেই



    তবু গৌতমের দ্বিধা ঘোচে না। মনের মধ্যে লড়াই চলে। নাটক যত এগোয়, ততই গৌতমের ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য কমতে থাকতে। চিরন্তন ক্ষমতার সামনে সে সংশয়ী হয়। রাষ্ট্রের রক্ষকরা (Thought Police) তাঁর স্বাধীন চিন্তায় লাগাম পরাতে উদ্যোগী হয়। বিবি বোস তাঁকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন। তীব্র নির্মম অত্যাচারের সামনে ক্ষমতা গৌতমকে চারটি আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করে, 'টা আঙুল দেখতে পাচ্ছ, তিনটে না পাঁচটা? তীব্র যন্ত্রণা নিয়েও গৌতম গোঙাতেগোঙাতে বলে চলেন চারটে!
     


    গৌতমের সামনে ক্ষমতার অধিপতি বিবি বোস প্রমাণ করতে চান ক্ষমতা চিরজীবী, তার মরণ নেই। যন্ত্রণায় গোঙাতেগোঙাতেও গৌতম বলে, ক্ষমতা নয়, প্রেম, মানবিকতাইচিরজীবী। গৌতমের মতে 2+2= 4 বলার মধ্যেই বাঁচার সার্থকতা আছে। এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যকেও ক্ষমতা যেদিন বদলে দেবে, সেইদিনই ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটবে



    অলীক এক অতীতের কাহিনীকে দাঁড় করিয়ে, ইতিহাসকে ভেঙে চুরে অনৈতিহাসকে স্থান করে দিয়ে যাবতীয় সত্যকে ক্ষমতার জোরে অস্বীকার করার এই নিদারুণ দৃশ্য আমরাও কি আমাদের চারপাশে দেখছি না? ক্ষমতা তো শুধু রাস্তাঘাটেই পুলিশনামায়নি, ক্ষমতার পুলিশ পৌঁছে গেছে আমাদের মস্তিষ্কেও। আমাদের ভাবনা, কলমকে নিয়ন্ত্রিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা। এরপরেও যারা বে-সুরে বাজছে, কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের উল্টোদিকে সংখ্যালঘু আত্মপরিচয় নিয়ে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অস্তিত্বই মুছে ফেলছে ক্ষমতা। ক্ষমতা চায় গৌতম ইসলামরা আজীবন শুধু রাষ্ট্রের গুণমুগ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের কথাই বলে যাক। আর তাদের নোটবুকের পাতাগুলো স্বকীয় ভাবনার অভাবে সাদা-ই রয়ে যাক



    নাট্যশিল্পের নান্দনিকতা রক্ষায় অনেক বিদগ্ধ মানুষ নাটকে সমকালকে তুলে ধরার বিরোধী। কিন্তু নান্দনিকতার মতো বিষয়গুলি যদি ক্ষমতা ও ক্ষমতাসীনের চোখ দিয়ে দেখা হয়, তবে তার মধ্যে শুধু আজ্ঞাপালনই থাকে, শিল্পের মাধ্যমে চিরন্তনীর প্রতি প্রশ্ন তোলা যায় না, বলা যায় না রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ অরওয়েল এমনই এক নিয়ন্ত্রিত, আরোপিত, মিথ্যাসর্বস্ব, প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসকের শাসনাধীন সময়ের ভবিষ্যতবানী করেছিলেন। 2022-এর ভারত, যে ভারত আকলাখ, গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গির মৃত্যু দেখে ফেলেছে, ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভাসের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে প্রতিবেশীকে শত্রু ঠাওড়াতে শিখছে, তার সামনে অরওয়েলের এই পূর্বানুমানকে তুলে আনল সংসৃতি। তাদের ধন্যবাদ। অরওয়েল কতটা সত্যদ্রষ্টা ছিলেন, সেই বিচার না হয় সমকালীন ভারতবর্ষই করুক

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ঢঙে সনিয়া বলবেন আমায় তোমরা যেতে দাও, আর বাকিরা পথ আগলাবে— এই হল কংগ্রেসের হাল!

    সমাজ নির্মিত ‘খুনি' হিসাবে একাকী রিয়াকে যে অসম লড়াইটা লড়তে হচ্ছে, সেই লড়াইয়ে সংহতি থাকবে।

    মানুষের মনোলোকে আড়ি পাতা ফেসবুকের অন্তর্লোকে আলো ফেলবে এই বই।

    জন্মিলে মরিতে হইবে, ক্যাপিটালিজম সঙ্গ দেবে!

    তালিবানি মৌলবাদের রোগ পালটা মৌলবাদী দাওয়াইতে সারবে না, এটা দেশের রাজনৈতিক তালেবরদের বুঝতে হবে।

    স্বাধীনতার 75 তম বছরে যে গণ-আন্দোলন প্রতিস্পর্ধী শাসককে নতজানু করল, সেই আন্দোলনেরও প্রেরণা মহাত্মা।

    শয়নে স্বপনে, রয়েছ রাষ্ট্রেরই নয়নে!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested