×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • স্বেচ্ছাচারের পৌষমাস, স্বাধীনতার সর্বনাশ

    বিতান ঘোষ | 12-11-2021

    প্রতীকী ছবি।

    আঙুর ফল টক। যা অর্জন করা যায় না, তাকে অস্বীকার করাই ধুরন্ধর ব্যক্তির কাজ। এটা সত্য যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের অধুনা জাতীয়তাবাদের মসীহা বিজেপি কিংবা পূর্বতন জনসংঘের কোনও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না। তাই বলে, দেশের স্বাধীনতাটা ভিক্ষার সমতুল্য হয়ে যাবে! এ তো হতাশাগ্রস্তের ছিঁচকাঁদুনি হয়ে গেল মশাই। কেন্দ্রের শাসকদল স্বাধীনতার 75 তম বর্ষপূর্তিতে ধুমধাম করে অমৃত মহোৎসব পালন করছে। আর সেই শাসকদল ঘনিষ্ঠ, সদ্য পদ্মসম্মানপ্রাপ্ত অভিনেত্রী বলছেন, স্বাধীন ভারতের বয়স মাত্র 7 বছর! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। জনৈক কঙ্গনা রানাওয়াত নাম্নী বলিউড অভিনেত্রী বলেছেন, ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছে 2014 সালে। এখানেই থামেননি সেই অভিনেত্রী। বলেছেন, 1947 সালে যেটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা নাকি ভিক্ষা, স্বাধীনতাই নয়। কে কাকে কোন উদ্দেশ্যে ভিক্ষা দিল, দেশের এত বিপ্লবী, শহীদরা তাঁদের জীবনের বিনিময়ে ভিক্ষালাভ করলেন কিনা, সেই কূটপ্রশ্ন তুলে কোনও লাভ নেই।

     

     

    স্বাধীনতা কী, খায় না মাখে, সেটা কেষ্ট না রাধে— তা কঙ্গনার জানার কথা নয়। ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার কথা বলছেন। তাই 1947 সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকেই বেমালুম অস্বীকার করেছেন। তার পরিবর্তে বলেছেন 2014 সালের কথা। কিন্তু এই বছরে কী এমন ঘটেছিল, যার জন্য ভারত হঠাৎ স্বাধীনতা পেয়ে গেল? ইতিহাসে যে বিশেষ ক্ষণ কোনও যুগান্তকারী ঘটনা বা পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে, তাকে আমরা জলবিভাজিকা বলে থাকি। কোনও দিক থেকেই তো 2014 সালকে তেমন কোনও গোত্রে ফেলা যায় না। হ্যাঁ, এই বছর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি কেন্দ্রে প্রথম এককভাবে ক্ষমতায় আসে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সবচেয়ে শোচনীয় ফল করে। কঙ্গনার কাছে তবে কি বিজেপির এই বিপুল রাজনৈতিক সাফল্যই ‘স্বাধীনতা’, নাকি কংগ্রেসের এই শোচনীয় ব্যর্থতা, কোনটা? 

     

     

    ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে যদি একটু বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করা যায় এবং কঙ্গনার বক্তব্য মোতাবেক 2014 সালকে ইতিহাসের একটি জলবিভাজিকা ধরে নেওয়া হয়, তবে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক, স্বাধীনতার প্রায় সবকটি  মানদণ্ডে ভারতের অবস্থান 2014 সালের পর ক্রমনিম্নগামী হয়েছে। 2020 সালে প্রকাশিত ব্যক্তির স্বাধীনতার সূচকে 162টি দেশের মধ্যে ভারত 111 তম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের অবস্থান 142-তম স্থানে! 2014 সালের পর ভারতে সংখ্যালঘু পীড়নের ঘটনা প্রায় 9 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার এই অন্তর্জলি যাত্রা থামানোর কোনও উদ্যোগ শাসক শিবিরের তরফে দেখা যাচ্ছে না। উলটে নানা ভাবে এই পরিসংখ্যানগুলোকে ভুল প্রমাণে সচেষ্ট দলের নেতাকর্মীরা।

     

     

    দেশে যে স্বাধীনতার বড় অভাব ঘটছে তা নিয়ে প্রায় একমত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে জাতিপুঞ্জ। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে বহুবার শাসক শিবিরের পাশে দাঁড়ানো কঙ্গনা স্বাধীনতার দুর্বার স্রোত লক্ষ্য করছেন কোন উপায়ে, তা দুর্বোধ্য। এটা সত্য যে কঙ্গনার ব্যক্তি স্বাধীনতা বিজেপির শাসনে ক্রমশ বেড়েছে। তিনি খামখেয়াল হুড়ুমতালে যা খুশি বলে গেছেন। তাঁর বক্তব্যে প্ররোচনা থেকেছে, বিদ্বেষও থেকেছে। দেশের স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিজেপি সর্বত্র দেশদ্রোহের ভূত দেখে বেরোলেও, কঙ্গনার কোনও কথাতেই দোষের কিছু দেখেনি। এই যেমন স্বাধীনতার বয়স এক ঝটকায় প্রায় 68 বছর কমিয়ে দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কেউ গরম গরম বক্তব্য রাখলেন না, পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিলেন না। এই কথাই যদি মুসলিম ধর্মাবলম্বী কেউ কিংবা রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি বিরোধী কেউ বলতেন, তাঁর যে কী অবস্থা হত তা ভেবেই গা শিউরে ওঠে! কঙ্গনা হয়তো তাঁর স্বেচ্ছাচারটাকেই স্বাধীনতা বলে মনে করেছেন। তাই দেশে স্বাধীনতা-হীনতা নিয়ে এত হইচই হলেও তিনি চলতি সময়টাকে স্বাধীনতার মরশুম বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন।

     

    আরও পড়ুন: কীসের গ্রিন? কতটা পুলিশ?

     

    তবে একটু তলিয়ে দেখলে একটা বিষয় নজর এড়ায় না। তা হল বিজেপির ছত্রধর (অ)রাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও 47-এর স্বাধীনতাকে বহুবছর মান্যতা দেয়নি। এমনকি দেশের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাও বহু বছর সঙ্ঘের সদর দপ্তর নাগপুরে ওড়েনি। এই নিয়ে সাভারকর এবং গোলওয়ারকরের বিচিত্র বিচিত্র সব ব্যাখ্যা ছিল। সংঘ আগাগোড়া মনে করে এসেছে যে, অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনাই আসলে স্বাধীনতা। কিছুদিন আগেই আন্দামান সেলুলার জেলে সাভারকরের কুঠুরিতে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্বাধীনতার এই বোধই হয়তো কঙ্গনার মধ্যে জেগে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেও থেকে যাচ্ছে। সাভারকর যখন জানতেনই যে এসব ভিক্ষা এবং তিনি ভিক্ষাবৃত্তি করছেন, তখন খামোকা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে জেল খাটতে গেলেন কেন? পরে বোধহয় বুঝেছিলেন, সব ঝুটা হ্যায়। তাই নতশিরে ক্ষমাপ্রার্থনা করে...। 

     

     

    যাইহোক, কঙ্গনা এমনই অনন্ত স্বাধীনতার স্রোতে ভাসতে থাকুন, এমনই গবেষণালব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশ করতে থাকুন। কিন্তু সংযমের শিক্ষাটাও তার থাকা দরকার। স্বাধীনতার এতগুলো বছর যদি ফাঁকিই হবে, তবে প্রধানমন্ত্রী 70 বছরের অনুন্নয়নের জন্য কাকে দুষবেন, ইংরেজদের? 2 অক্টোবর রাজঘাটে গিয়ে কার সামনে নতজানু হবেন? কীসের ভিত্তিতে অমৃত মহোৎসব করবেন? স্বপ্নে দেখলাম কঙ্গনা 75-এর গা থেকে 5 খুলে নিয়ে দৌড়চ্ছেন, আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ধাওয়া করেছেন!


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    কৃষ্ণের মোহনবাঁশিতেই যখন হিরণ্যকশিপুরা পরাভূত, তখন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারে আসার কীই বা প্রয়োজন?

    উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর স্বরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন দুই সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ

    শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।

    ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চের ‘রাজনৈতিক’ পোস্টারে বিজেপিকে রোখার ডাক।

    গদ্দারদের সঙ্গে কিভাবে ট্রিট করা হয়, তার একটা নমুনা দেখানো হয়েছিল ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ।

    মহাভারতের অর্জুন রামায়ণের রামচন্দ্রকে হারিয়ে ফিরে এলেন পুরনো রাজনৈতিক আশ্রয়ে।

    স্বেচ্ছাচারের পৌষমাস, স্বাধীনতার সর্বনাশ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested