এ বছর নেইয়ের তালিকাটা যেন বড় বেশি দীর্ঘ। এতদিনের পরিচিত সব দৃশ্যগুলোকেই মহামারী বদলে দিয়েছে। পাঁজিপুঁথির জটিল হিসেবনিকেশে মহালয়াটাও এবার ব্যতিক্রমীভাবে পুজোর অনেকটা আগেই হচ্ছে। তারওপর একইদিনে বিশ্বকর্মা পুজো। কিন্তু উৎসবের এই দ্বৈত আয়োজনেও কেমন যেন মনমরা লাগছিল। বিকেলের আকাশ নিঃসঙ্গ, একাকী। দূরের আকাশে একটা দুটো ঘুড়ি জানান দিচ্ছিল রাত পোহালেই ঘুড়ি ওড়ানোর দিন। অথচ অন্যান্যবার বিশ্বকর্মা পুজোর ক'দিন আগে থেকে লাল, নীল, সবুজ, রঙবেরঙের ঘুড়িতে আকাশটাকে রঙিন হতে দেখেছি। মহামারী আর চারদিকের অনিশ্চয়তা আকাশটাকেও যে ফ্যাকাসে আর বিবর্ণ করে দেবে কে জানত!
পাড়ার মোড়ে মোড়ে ঘুড়ি সুতো নিয়ে কত ছেলেপুলে বসে পড়ত। পুজোর দু'দিন আগে থেকে বিক্রিবাটাও কম হত না তাদের। তাদের একজনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কীরে এবারে দোকান দিবি না?' মলিন মুখে হেসে বলল, "এই পরিস্থিতিতে কোন মুখে লোকজনকে হেঁকে বলব ঘুড়ি নিয়ে যাও দাদা? ঘুড়ি এবার বেচছি না দাদা, পুজোর আগে স্যানিটাইজার আর মাস্ক নিয়ে কিছুদিন বসব। ওগুলোরই এক মার্কেট আছে এখন।' কথা হল পাড়ার বয়স্ক অরূপ জেঠুর সঙ্গেও। প্রত্যেক বছর মহালয়ার দিন অরূপ জেঠু গঙ্গার ঘাটে দুই জোড়া কোশাকুশি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তর্পণ করতে গঙ্গায় আসা মানুষদের কোশাকুশির জোগান দিয়ে দশ-বিশ টাকা আয় হয় অরূপ জেঠুর। বললেন, "এবার তো করোনার ভয়ে অনেকেই ঘাটে আসবে না শুনছি। যাও বা নস্যির পয়সাটা জুটত, সেটাও বুঝি এবার হল না।'
এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে পুরোহিতদের সমবেত মন্ত্রোচ্চারণে পিতৃতর্পণের যে ছবিটা মহালয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল, সেটা কি এবারের মহালয়াতে দেখা যাবে না? এবারের মহালয়া তো চরিত্রগতভাবেও গত মহালয়াগুলির থেকে আলাদা। মাতৃমূর্তির চক্ষুদান নেই, কুমোরটুলিগুলো থেকে বারোয়ারিগুলোর ঠাকুর বেরোনোর দৃশ্যও নেই। পটুয়াপাড়া এখনও বিশ্বকর্মার অঙ্গসজ্জায় ব্যস্ত। মায়ের আসতে যে এবার অনেকটাই বিলম্ব হবে। এমনকী ভাদ্রের শেষদিনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে শুনতে হবে "আশ্বিনের শারদ প্রাতে'...এর চেয়ে বড় টেকনিক্যাল ফল্ট আর কী হতে পারে? মাতৃপক্ষের সূচনা হবে অথচ নতুন পূজাবার্ষিকীগুলো পর্যন্ত হাতে এসে পৌঁছবে না। এমনটা কি কখনও হয়েছে? মহালয়া মানেই তো পড়াশোনা, কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে পাড়ার পুজোমণ্ডপের সামনে কারণে-অকারণে ঘুরঘুর করা। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে চোখ বুলোনো। কিন্তু এবার তো মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিমার কাঠামোটাই অবয়বহীন। সেটা কবে আকার পাবে আমরা কেউই জানি না। হয়তো তার আকার আড়ে-বহরে অনেক ছোট হবে, তবু উমা ঠিকই বাপের ঘরে আসবেন।
সব অন্ধকারের শেষেই তো একটা আলোকবিন্দু থাকে। এক আকাশ স্বপ্ন দেখা ছেলেটা হয়তো বিশ্বকর্মা পুজোর দিন রঙিন ঘুড়িটা আকাশে ভাসিয়ে দিয়েছে। দূরে আরও দূরে পৌঁছে যাবে সেই ঘুড়ি। তারপর হয়তো কোনও দমকা হাওয়ায় অচেনা পথে হারিয়েও যাবে সেটা— হইহই শব্দে তাকে কুড়িয়ে নেবে অন্য পাড়ার ছেলের দল। মহামারী আসার অনেক আগে থেকেই তো এই খুশির রেশ মারাত্মক রকমের সংক্রামক। দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়েছে এভাবেই। কোনও বিমল হয়তো তার প্রিয় জগদ্দলকে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন নতুন রেক্সিনের কভার দিয়ে সাজিয়ে তুলছে। অনেক কিছু বদলে যাওয়া এই সময়েও রেডিওতে ভোর চারটেয় "মহিষাসুরমর্দিনী' শুরু হয়েছে। জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষক নিয়মমাফিক জানিয়েছেন, "ভাষ্যরচনায় বাণীকুমার, গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র...।' তারপর যথাক্রমে অমুক সংস্থা এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছে। এই টালমাটাল সময়ে কতগুলো সংস্থা কালজয়ী "মহিষাসুরমর্দিনী'-কে স্পনসর করবে তা নিয়ে একটা সংশয় ছিল। কিন্তু দেখা গেল দেশি-বিদেশি বহু সংস্থাই মহিষাসুরমর্দিনীর আগে পরে নিজেদের নাম জুড়েছে। আসলে তারাও জানত, এই ভুবনায়িত সময়েও বাঙালি প্রতিবারের মতোই রেডিওতে কান পেতে থাকবে। ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়ছিল সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে বহুশ্রুত, "বাজল তোমার আলোর বেণু'। সেই সুরমূর্চ্ছনায় যেন কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল, কোথাও কোনও রোগ-জরা-ক্ষয়— কিচ্ছুটি নেই। নিউ নর্মাল সময়ে মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেলেও বাঙালির এই চিরায়ত অভ্যাসে বদল আনতে পারেনি। ভাদ্রর শেষ প্রভাত জানান দিয়ে গেল, মহামারী পীড়িত সময়েও অসুরদলন করতে মা আসছেন। অসুরটার নাম এবারের জন্য মহিষাসুর না হয়ে করোনাসুর হোক, আপাতত এ'টুকুই সকলের প্রার্থনা।
সৃষ্টি আর লয় হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়, তবু আমরা বর্ষার জলে ভিজতে চাই, ভাসতে চাই।
এই কঠিন সময়ে বিরোধীরাও দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই!
বারমুডা পরা খারাপ কিছু নয়, তবে সেটা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে
বিশ্বে ট্রেন নিয়ে অনেক গল্পগাথা আছে। কত গল্প প্রাণ পেয়েছে ট্রেনের কামরায়।
গুগলাং শরণং গচ্ছামি করা পাঠককে বুঝতে হবে একমাত্র বই-ই নির্ভুল ও বিস্তৃত তথ্যের আধার।