ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের সদর্প উক্তি "আমিই রাষ্ট্র' (I'm the state) ইতিহাসে চরমতম অহংবোধের নজির হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের প্রায় আড়াই শতক পরেও বিশ্বের প্রায় নানা প্রান্তে শাসক এই ‘আমিত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়।
রামপুরহাটের বগটুই-হত্যাকান্ড (Bogtui Massacre)-এর পর পুলিশ প্রশাসন, শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের যা যা করণীয় ছিল, সেগুলো প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই করে ফেললেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তাঁর প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা বুঝতে আর একটু সময় লাগবে। তবে তিনি মনে করলেন, যোমন আগেও বহুবার করেছেন, যে তিনিই একমাত্র যাবতীয় গুরুতর সমস্যার ওয়ান স্টপ সলিউশন। এটা তাঁর নিজের কর্মদক্ষতার প্রতি অবিচল বিশ্বাস, নাকি প্রশাসনের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের প্রতি নিদারুণ অবিশ্বাসের প্রতিফলন, তা বোঝা দুষ্কর।
বগটুই-এর পৈশাচিক ঘটনা ঘটার পর মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা থেকে সটান কর্তৃবাচ্যে বলে দিলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্র ওসি ও এসডিপিও-কে সরিয়ে দিয়েছি। এক্ষেত্রে মানানসই হত, "সরিয়ে দেওয়া হয়েছে' পদটা। কারণ কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে অধঃস্তন পুলিশ আধিকারিকদের সরাবেন জেলা পুলিশ সুপার, তাঁর কাছ থেকে রিপোর্ট নেবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এবং মুখ্যমন্ত্রীর যা কিছু নির্দেশ, তা রাজ্যে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র মাধ্যমে নীচের স্তরে পৌঁছবে – এমনটাই দস্তুর। বর্তমান জমানায় অবশ্য এটা ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: নেই রাজ্যের বাসিন্দাদের বিরোধের নিষ্পত্তি হিংসাতেই হতে বাধ্য
মুখ্যমন্ত্রী বগটুই গ্রামে গিয়ে বেমালুম বলে দিলেন "আনারুলকে গ্রেফতার করো, ওকে কেন এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি?' ভাগ্যিস এখানে তিনি বলেননি যে, কেন এখনও আনারুলকে গ্রেফতার করিনি! এই গ্রেফতার করতে না পারার অপারগতাটুকু পুলিশমন্ত্রী হিসাবে তিনি তাঁর পুলিশের ঘাড়েই চাপিয়েছেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তাই মুখ্যমন্ত্রীর এমন নির্দেশের অনতিকাল পরেই বীরভূম জেলা থেকেই গ্রেফতার হলেন তৃণমূল রামপুরহাট 1 ব্লকের সভাপতি আনারুল। এই আনারুলের বিরুদ্ধে যখন এত অভিযোগ, তখন আনারুলকে গ্রেফতার করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি জেলা পুলিশ? স্থানীয় পুলিশ কি ক্ষীরপুতুল, যে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া তাঁরা বুঝতেই পারেন না তদন্তের স্বার্থে কাকে গ্রেফতার করা উচিত বা অনুচিত?
নিহতদের স্বজনরা বলছেন, আনারুলকে বারংবার বলা সত্ত্বেও আনারুল তাঁদের জন্য কোনও পুলিশি ব্যবস্থা করেননি। প্রশ্ন এখানেও যে, একজন ব্লক সভাপতির নির্দেশের অপেক্ষায় মুখে চুষিকাঠি এঁটে বসে থাকবেন উর্দিধারীরা? গ্রামে টহল দেওয়ার সময় এই নারকীয় ঘটনা ঘটল, আর পুলিশ তাঁদের করণীয় কী, তা-ই স্থির করতে পারল না! এর চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর উপস্থিত বুদ্ধি তো নার্সারির শিশুদেরও থাকে। তবে মতি যদি বন্ধক দেওয়া থাকে, তবে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাই বৃথা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অত্যন্ত সফল আঞ্চলিক দলের প্রধান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই দলে তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না, এহ বাহ্য। দিনের শেষে এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্র্যান্ড ইক্যুয়িটি প্রশ্নাতীত। কিন্তু বীরপুজোর এই দেশে জনমোহিনী রাজনীতিতে ব্যক্তির যে পরাক্রম, সেই পরাক্রম প্রায়োগিক গণতন্ত্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য অতীব ভয়ঙ্কর। প্রতিযুক্তিবাদীরা বলতেই পারেন, এতে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্তি মেলে। বাস্তবে লাল ফিতের ফাঁসে রুদ্ধ আমলাতন্ত্রের মুক্তির নামে এ আসলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারের লাল ফাঁস, যা নীচ থেকে উপর পর্যন্ত গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবনে বাধার সৃষ্টি করে! স্তরীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মন্ত্রী সান্ত্রী আমলাকে কার্যত তালপাতার সেপাইতে পর্যবসিত করে সর্বক্ষেত্রেই একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার "সখ' আদতে স্বেচ্ছাচারিতারই আগল খুলে দেয়। প্রশাসনের নীচুতলার মধ্যেও এই মর্মে অনাস্থা জন্মায় যে, স্বয়ং প্রশাসনিক প্রধান তাঁদের প্রতি ভরসা রাখেন না। আর একক ব্যক্তির নানা সীমাবদ্ধতাও থেকে থাকে, বিশেষত যিনি একজন সর্বক্ষণের রাজনীতিকও বটে। তাই তিনি সবকিছু অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবেন, এমনটা তিনি ও তাঁর অনুগত কর্মীরা মনে করলেও, বাস্তবে তা হয় না। এতে চমক থাকতে পারে, বাস্তববোধ একেবারেই থাকে না।
আরও পড়ুন: এত রক্ত কেন? বাংলার রক্তেই কি রক্তের নেশা?
বগটুই কান্ড আরও একবার প্রমাণ করল, মুখ্যমন্ত্রীর জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আনারুলদের মতো বহু স্থানীয় ‘মুখ্যমন্ত্রী’ তৈরি হয়ে গেছেন, যাঁরা ঠিক করে দেন কখন কোথায় পুলিশ যাবে। জেলার অবিসংবাদী নেতা পুলিশকে বুঝিয়ে দেন কীভাবে মামলা সাজাতে হবে! এঁরা প্রত্যেকেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ‘অনুপ্রাণিত’। এবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যদি নাট্যমেলার অনুষ্ঠানসূচী থেকে জেলার অমুক পুলিশ অফিসারের বদলি, সবটাই স্বহস্তে সম্পাদন করেন, তবে তাঁর সুযোগ্য চ্যালারাও যে এমন মেগাল্যোম্যানিয়াক, ক্ষমতাধর হয়ে উঠবেন, সেটা তো জানা কথাই।
এক বছরও হয়নি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল জনাদেশ নিয়ে রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। বছর ঘোরার আগেই বিভিন্ন ঘটনায় তারা যেভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে, তাতে বেশ অবাক হতে হয়। বিরোধীদের ছড়ায়, স্লোগানে, মিছিলে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দাগা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী লার্জার দ্যান পার্টি কিংবা লার্জার দ্যান ব্যুরোক্রেসি হয়ে উঠলে এই সমস্যার মুখে তাঁদের পড়তে হবেই। জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে স্থানীয় নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় বিরোধীরা শাসক বামফ্রন্টের মুণ্ডুপাত করলেও, সরাসরি জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে স্লোগান, দেওয়াল লিখন কালেভদ্রেই হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু একক স্কন্ধে নেওয়ার প্রবণতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমল থেকে কিছুটা শুরু হয়েছিল। তারই চূড়ান্ত এবং অদৃশ্যপূর্ব রূপ দেখছে আজকের বাংলা। প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন তাঁর পদাধিকারের বাইরে বেরিয়ে সবটা দেখভাল করতে চাইছেন? প্রশাসনের বেতনভুক কর্মচারীদের কর্মদক্ষতার ওপর ভরসা না রেখে কেন নিজের মানসিক ও কায়িক শ্রম বাড়াচ্ছেন? রাজ্য পরিচালনায় শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মহাভার তো রাজ্যবাসী তাঁর হাতেই সঁপেছে, তাঁর কাজ তো শুধু এটা দেখা যে যোগ্যতম ব্যক্তিকে দিয়ে যথার্থ কাজটি করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে কিনা। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অধঃস্তনদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া, ‘কাজ করা’ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ হলেও হতে পারে। অ্যাক্টিভ নয় প্যাসিভ, মুখ্যমন্ত্রীর ভয়েস চেঞ্জ করা জরুরি।
প্রতিস্পর্ধা-সঞ্জাত, স্বাতন্ত্রমন্ডিত আলোকবর্তিকাই 2022-এর অন্ধকার দিকগুলোয় আলো ফেলবে।
পোশাক দেখে অপরাধী চিনে ফেলা ক্ষমতাসীনই, তার মতানুসারে চালাতে চায় সকলকে।
রাজনীতির বল্গাহীন লাটাই কাটাকুটি খেলে গেল, ভো-কাট্টা হল আমাদের ছেলেরা।
এই দ্বীপভূমি ডুবলে ক্ষমতা ও আভিজাত্যের সাতমহলাও সুরক্ষিত থাকবে না।
নেহরু অনেকদিন বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কালান্তরেও তাঁর ভাবনায় বার্ধক্য আসেনি।
বারমুডা পরা খারাপ কিছু নয়, তবে সেটা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।