×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দলের মৌষলকালে একী সর্বনাশা ‘কৌশল’?

    বিতান ঘোষ | 14-03-2022

    পদ আঁকড়ে থাকার কৌশলেই কি অন্তর্জলি যাত্রার দিকে এগোবে শতাব্দীপ্রীচীন কংগ্রেস?

    পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলাফল কংগ্রেসের জন্য কোনও কুশল বার্তা আনেনি। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘কৌশল’-এর পথে হাঁটলেন দলের অন্তবর্তীকালীন সভাপতি সনিয়া গান্ধী! তবে একটু তলিয়ে দেখলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে, এ আসলে কৌশল নয়, শত ব্যর্থতার পরেও পদাসীন থেকে যাওয়ার মরিয়া প্রয়াস মাত্র।
     


    গত বছর বাংলা, অসম, কেরালা সহ বিভিন্ন রাজ্যের ভোটে এক তামিলনাড়ু ছাড়া কোথাও বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি কংগ্রেস। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র কিংবা ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস যে ক্ষমতার অংশীদার হিসাবে রয়েছে, তা মূলত জোট শরিকদের বদান্যতায়। আম আদমি পার্টির সম্মার্জনীর ঘায়ে পঞ্জাব হারানোর পর একক ক্ষমতায় কংগ্রেস রইল শুধু রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে। রাজস্থানেও অশোক গেহলোট আর সচিন পাইলটের দ্বন্দ্বে রাজ্যপাট যখন যায় যায়, তখন মূলত পোড়খাওয়া গেহলোটের কৌশলেই মরু-রাজ্য রক্ষা করতে পেরেছিল কংগ্রেস। কিন্তু এখানেও প্রশ্নটা সেই একই, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড নামক প্রতিষ্ঠানটি তবে করছেটা কী? পঞ্জাবে সিধু-ক্যাপ্টেন কিংবা রাজস্থানে গেহলোট-পাইলট দ্বন্দ্ব সামলাতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব শুধু ব্যর্থই নয়, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গলিঘুঁজি সম্পর্কেও তারা বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। পাঞ্জাবেই যেমন হাইকম্যান্ড (রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা) উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হরিশ রাওয়াতকে বিবাদ মোকাবিলায় বিশেষ পর্যবেক্ষক করে পাঠিয়েছিলেন। দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদ ঘুচিয়ে ফাটল তো মেরামত তিনি করতেই পারেননি, উলটে নিজের রাজ্য উত্তরাখণ্ডেই পরাজিত হয়েছেন! বোঝাই যায় হাইকম্যান্ড কত বিচক্ষণতার সঙ্গে এই সব বিচক্ষণী ক্রাইসিস ম্যানেজারকে চয়ন করে!
     


    কংগ্রেসের অভ্যন্তরের বিবাদ-বিসংবাদ মেটানোর দায়ভার রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা স্ব-স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু পদাধিকার মোতাবেক তারা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মাত্র। কিন্তু পঞ্জাবে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, কোনও রাজ্যে কে প্রদেশ সভাপতি হবেন, তা মূলত ঠিক করছেন এঁরা দু'জনেই। দশ জনপথের অন্তরালে থাকা সনিয়া যেন ফিরে গিয়ে নয়ের দশকের সেই দিনগুলিতে, যখন তিনি রাজনীতি এবং কংগ্রেস সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ ছিলেন।
     


    উত্তরপ্রদেশের পূর্ব প্রান্তকে বিশেষ নজরে রেখে প্রিয়ঙ্কা দীর্ঘদিন সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। যোগী আমলে ঠাকুর সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে ক্ষুণ্ণ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ভোট ফেরাতে চেষ্টার কসুর করেননি ইন্দিরা-পৌত্রী। প্রিয়ঙ্কা এটা অন্তত সম্যক বুঝেছিলেন উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক মূলত ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষরাই। মণ্ডল রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই দলিত, পিছড়েবর্গ ও অনগ্রসর শ্রেণীকে কংগ্রেসের প্রতি নিরাসক্ত করেছে, আর রামমন্দির আন্দোলনের ‘সুফল’ হিসাবে উচ্চবর্ণের ভোটও ক্রমে পদ্মশিবিরে গিয়ে ভিড়েছে। প্রিয়ঙ্কা তাই নারী ক্ষমতায়নের কথা বলে মহিলা ভোটকে কংগ্রেসের অনুকূলে আনতে চেষ্টা করেছিলেন। ভোটের ফলাফল বলছে প্রিয়ঙ্কা ও কংগ্রেসের এই যাবতীয় চেষ্টা বিফলে গেছে। সংগঠন তৈরি করার ধকল না নিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ ‘কৌশল’ রচনায় মনোনিবেশ করাতেই, কংগ্রেস ভোটবাক্সে কোনও সুফল পায়নি। রাহুলকে বিদগ্ধ সমাজে কিংবা ট্যুইটারে যতটা স্বচ্ছন্দে দেখা গেছে, উত্তরপ্রদেশের মতো মিশ্র রাজ্যের ধূলোবালি ভরা নির্বাচনী ময়দানে ততটা দেখা যায়নি।
     


    যে কোনও সফল রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানেই সংস্থা দেউলিয়া হয়ে গেলে, তার কর্ণধার যাবতীয় দায়ভার স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। রাজনৈতিক দেউলিয়াগ্রস্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের শিরোমণিরাই বা এই নিয়মের ব্যতিক্রম হবেন কেন? 137 বছরের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে পুঁজি করে এমন শোচনীয় টার্নওভার দিলে যে কোনও কোম্পানি উঠে যেতে বাধ্য! অবশ্য কংগ্রেসে কে কর্ণধার সেটাই যেহেতু স্পষ্ট নয়, তাই কার কানে টান পড়লে মাথা ঝুঁকবে, থুড়ি সংগঠন বলশালী হবে, তা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। কিন্তু নেপথ্যে থেকে দলের যাবতীয় কর্ম সম্পাদনে রাহুল ও প্রিয়ঙ্কাকেই দেখা যাচ্ছে। তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছা নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করছে না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। একমাত্র পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কর্ণধার চরম ব্যর্থ হলেও তিনি নেহাত অনিচ্ছাভরেও পদ আঁকড়ে থাকেন। কিন্তু কংগ্রেস তো তেমন কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। শতাব্দী প্রাচীন এই দলটি দেশের বহু মানুষের আবেগ, ভালবাসা, পরিশ্রমের দানে পুষ্ট, নিছক এই গান্ধী-ত্রয়ীই কেন বারবার কংগ্রেস দলের ভাগ্যবিধাতা হিসাবে উঠে আসবেন, এই প্রশ্ন এখন না উঠলে দলের অন্তর্জলি যাত্রা ঠেকানো মুশকিল।
     

    আরও পড়ুন: দেড়শো বছরের প্রাচীন দলের ভরসা 75 বছরের অসুস্থ বৃদ্ধাই, ভারতবাসীর ভরসা কে হবে?


    সনিয়া ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে জানিয়েছেন, দলের কল্যাণে তাঁরা, অর্থাৎ তিনি এবং রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা সব পদ থেকে সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত। এখানে দু'টি প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়। সনিয়ার পুত্র ও কন্যা বয়স ও অভিজ্ঞতায় যথেষ্ট সাবালক এবং তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও বটে। তাই তাঁরা দু'জন কী করবেন, তা তো তাঁদের দু'জনেরই জানানো উচিত। সনিয়া কি দলের অন্দরে তিনজনকে আলাদা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে রাখেন, নাকি মনে করেন রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা একক ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ?
     


    কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ তথাকথিত জি-23 গোষ্ঠীর অবস্থা আরওই করুণ। তাঁরা মাঝেসাজেই গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে কামান দাগেন, তারপর সনিয়ার বকুনি খেয়ে অনুগত শিষ্যের মতোই রণে ভঙ্গ দেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগে কত কথাই না শোনা গেল, এবার নাকি রাহুলের কাছে কৈফিয়ত তলব করবেন গুলাম নবি আজাদ কিংবা আনন্দ শর্মার মতো বিক্ষুব্ধ নেতারা। কিন্তু সনিয়ার মুখে বৈরাগ্যের কথা ও তাঁদের তিনজনের পদত্যাগ করার ইচ্ছাপ্রকাশের পরেই তাঁদের হৃদয় এত বিগলিত হয়ে গেল যে, তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘কভু, যেতে নাহি দিব’! মানে আস্ত একটা দিন দেশবাসী ও মিডিয়ার অ্যাড্রিনালিন রাশ ও অসীম কৌতূহলের পর, কংগ্রেস তার পৌনঃপুনিকতার ধারা বজায় রাখল। জনৈক মুখপাত্র জানিয়ে দিলেন, সনিয়া গান্ধীই দলের ‘মার্গদর্শন’ করাবেন। অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো সেই মার্গ থুড়ি পথ যতই ভুল হোক, সেই পথেই এগিয়ে যাবে কংগ্রেস। সুদূর অতীতে নরসিংহ রাও, পরবর্তীকালে সীতারাম কেশরীর পর দলের মধ্যে এমন কোনও বিরুদ্ধ স্বর নেই, যে অন্তত নেহরু-ইন্দিরার উত্তরাধিকারদের সামনে নিছক হালুম হুলুম নয়, কিঞ্চিৎ আঁচড় কাটতেও পারে।  বিজেপি যেখানে সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ কৌশলে একটার পর একটা রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখছে, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিসর থেকে ক্রম অপসৃয়মান একটি জাতীয় দলের মাথারা ‘কৌশল’ করে পদ আঁকড়ে থাকছেন। এমন কৌশল স্বখাত সলিলে ডুবে মরারই নামান্তর।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বাঙালির সুকুমারি মন, ননসেন্স রাইমস লিখেও এখানে প্রফেট হওয়া যায়, গবেট নয়।

    বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।

    বামপন্থার পুনরুত্থান, নাকি জনপ্রিয়তাবাদের হাত ধরে নব্য নাৎসি দমন; রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত কী?

    আসামের ফর্মুলায় বাংলা-জয় হল না বিজেপির।

    বিশ্বের পুরুষ প্রধানরা আজ সঙ্কটের দিনে যখন দিশাহীন, তখন সঠিক পথ দেখাচ্ছেন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানই।

    ছিন্নমূলের দেশ নেই, সমাজ নেই, আছে জেদ আর কল্যাণকামী রাষ্ট্রের তাচ্ছিল্য ও করুণা।

    দলের মৌষলকালে একী সর্বনাশা ‘কৌশল’?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested