মুখ্যমন্ত্রী অমন মন্তব্য করে গর্হিত অন্যায় করেছেন। এই অন্যায় অমার্জনীয়। এইটুকু না বলে নিলে সমস্যার গোড়ায় যাওয়া যাবে না। সোশাল মিডিয়া মন্থনে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি শুধু ধিক্কারবানীই উঠে আসছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি নিন্দাবাক্য বর্ষণ করলে অথবা কলকাত্তাইয়া বুদ্ধিজীবীদের ইস্যুভিত্তিক হিরণ্ময় নীরবতা নিয়ে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিলেই কি আমাদের শুভবোধ প্রবলভাবে জাগ্রত হবে?
এ কথা ভুললে চলবে না যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জনমোহিনী রাজনীতির অন্যতম সফল মুখ, পপুলিজম-ই তাঁর রাজনীতির প্রধানতম অভিজ্ঞান। গড়পড়তা রাজনীতিক বা স্বঘোষিত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের তুলনায় তিনি রাজ্যবাসীর হাঁড়ির খবর একটু বেশিই ভাল রাখেন— এই প্রত্যয়, প্রচ্ছন্ন অহমিকা তাঁর মধ্যে আছে। তিনি অক্লেশে বলেছেন, সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে বলেছেন, হাঁসখালির মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল কিনা, যার জন্মদিন উপলক্ষ্যে মেয়েটির অকুস্থলে যাওয়া, সেই ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির "লাভ অ্যাফেয়ার' ছিল কিনা, তা-ও তিনি যাচাই করতে চান। নির্যাতিতা নারীর সঙ্গে বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, নাকি তারও এমন ইচ্ছা ছিল— এমনটা যাচাই করার স্পৃহা কি আমাদের সমাজের একটা বড় অংশেরও নেই? "লাভ অ্যাফেয়ার' থাকলে, কিংবা শাস্ত্রমতে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করলে নারী শরীরের ওপর অখণ্ড আধিপত্য স্থাপন করা যায়, এই দেশের অধিকাংশ নারীও তো তেমনই মনে করে থাকেন। এই যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-বুনন, সেখানে কমবেশি উলকাঁটা হাতে বসে আছি আমরা সবাই। মমতা তো সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী, বিপুল জনগোষ্ঠীর দলনেত্রী, তিনি হঠাৎ এর উল্টো কথাগুলো বলতে যাবেন কেন?
আরও পড়ুন:আহা রে, প্রেমের ধর্ষণ!
অন্তঃসত্ত্বা নারী মানে ইতিপূর্বেই সে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। তারপর বারংবার যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হতে সে কার্যত বাধ্য, সেখানে তার সম্মতি বা অসম্মতির কোনও স্থান নেই। একবিংশ শতকের ভারতেও সিংহভাগ মানুষ তাঁদের মনে এমন ধারণা লালন করে থাকেন। এর মধ্যে অবশ্যই কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো কার্যত নিয়মকেই প্রমাণ করে। স্বয়ং জাতির জনকও যৌন সঙ্গমকে কেবল সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসাবেই দেখেছেন। আজকের রাজনীতিকরা আরও একধাপ এগিয়ে মনে করেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীর সঙ্গে জোরপূর্বক সম্পর্ক স্থাপন করলেও তা "বৈধ'।
বিরোধীরা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলছেন, এমন সরকার আর সরকারের এমন কর্ণধারকেই কি আপনারা চেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের মধ্যেও খানিক ফাঁকি আছে। আসলে এই দেশে কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে কিংবা কর্মসূচিতে লিঙ্গ সাম্য কিংবা যৌন শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। গড়পড়তা মানুষের কাছে বিয়ে, যৌনতা এবং সন্তানধারণ এমন একটি সূক্ষ সরলরেখায় মিলে যায় যে, মনে হয় এগুলোর একটি অপরটির পরিপূরক। পরিতাপের বিষয়, পসকো-র মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে তেমন সচেতনতাই গড়ে তোলা যায়নি। মমতার কথাতেও স্পষ্ট, তিনি আইনের ছাত্রী, এবং এককালের সক্রিয় আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও এই নিয়ে বিন্দুমাত্র ধ্যানধারণা রাখেন না।
রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনে তবু একটা ক্ষীণ আশা জেগেছিল। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির তীব্র পুরুষকারের বিপ্রতীপে মমতা নারী ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিকে উস্কে দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে কার্যত হোমোজেনাস একটা গোষ্ঠী হিসাবে ধরে ভোটপ্রাপ্তির সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ যতটা চলেছে, কাজের কাজ ততটা হয়নি। তাই আলোর বৃত্ত ছাড়ালেই এখনও নিকষ অন্ধকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের নেত্রী আসলে সেটাই বলছেন, যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ দীর্ঘকাল ধরে শুনতে অভ্যস্ত, ভাবতে অভ্যস্ত। মুষ্টিমেয় "বুদ্ধিজীবী' নাম্নী লোকজনের সখের মোমবাতি মিছিলে এই আঁধার সহজে ঘুচবে না। আমাদের আরও নিবিড় প্রয়াস জরুরি এই আঁধার ঘোচানোর জন্য। ততদিন অবধি, "এমন তো কত হয়েই থাকে', কিংবা "ছোট ঘটনার' পুনরাবৃত্তি ও পুনরুদ্ধৃতি ঘটতেই থাকবে!
মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নারীবিদ্বেষী কদর্য আক্রমণের শিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নীলকন্ঠ পাখি ওড়াতে গিয়ে যারা নীলকন্ঠ হল যারা, তাদের প্রণাম।
ঈশ্বরী পাটনি কি মা অন্নপূর্ণার কাছে দুধভাতের আবদার না জুড়ে ফুটেজের আবদার জুড়েছিলেন?
ভরসা নেই মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিতে, রাজ্যে বিজেপিকে রুখতে নাগরিক শপথ শহরে।
জীবনের সকল অন্ধকারে ভালবাসা আর মমত্বের রোদ্দুর পড়ুক, ক্রান্তিকালে এ'টুকুই তো প্রার্থনা।
বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।