প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদদের ইতিহাস-জ্ঞান এমনিতেই খুব প্রখর। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশ কয়েকবার তার আভাস পেয়েছি। নিজের যাবতীয় কৃতকর্মকে 'ঐতিহাসিক' আখ্যায় ভূষিত করতে স্বচ্ছন্দ প্রধানমন্ত্রী এবার রামমন্দির আন্দোলনকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে বসলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশের আপামর জনগণের সুদীর্ঘ সংগ্রাম কীভাবে একটি ধর্মীয় আন্দোলনের সমতুল্য হতে পারে, তাই নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ইতিহাসের কারবারিদের অনেকেরই মত, হয় প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস জানেন না, নয়তো প্রধানমন্ত্রী কোনও কারণে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বকে লঘু করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী যে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছেন, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকাটা রীতিমতো বিতর্কিত (ভদ্রভাবে বললে) অথবা লজ্জাজনক (সোজাসাপ্টা বললে)। অধুনা, কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশপ্রেমের ধারায় দেশবাসীকে ভাসিয়ে দিলেও, তাদের ছত্রধর সঙ্ঘ কিংবা হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠনগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামে একপ্রকার শাসক ব্রিটিশের পক্ষ নিয়েছিল। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এই অস্বস্তিকর সত্যিটাই উঠে আসে।
1925 সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আরএসএস-এর জাতীয় আন্দোলনে ভূমিকা অনেকটা নীরব দর্শকের মতোই। দেশে ঔপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করার থেকেও তাদের অগ্রাধিকারে ছিল ‘বিজাতীয়’ সংগঠন কংগ্রেসের থেকে হিন্দুদের বের করে আনা। 1942 সালে বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে যখন 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' শুরু হল, গান্ধী বুঝলেন জনগণের হাতে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুভার এবার তাঁকে ছাড়তেই হবে। ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ শ্লোগানে দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করেও, গান্ধী আশা রাখলেন যে দেশবাসী হিংসার পথ নেবে না। কিন্তু আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনার আগের দিন, 8 আগস্ট, গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, প্যাটেলের মতো শীর্ষনেতারা গ্রেপ্তার হলে আন্দোলনের রাশ চলে গেল জনসাধারণের হাতে। গান্ধী নেই, কংগ্রেসের শীর্ষনেতারাও কারাবন্দি, তবু তাদের নামে আন্দোলন চলছে। বাংলার তাম্রলিপ্তে সতীশচন্দ্র সামন্তর নেতৃত্বে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এই আগস্ট মাসেই। সুশীল ধারা, অজয় মুখোপাধ্যায়রা রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংগঠিত করছেন। কিন্তু তখন কোথায় ‘জাতীয়তাবাদী’ বিজেপির প্রাণপুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়? তিনি তখন বাংলায় ফজলুল হক মন্ত্রীসভার মান্যবর অর্থমন্ত্রী। সেই মিলিজুলি সরকারের তিন শরিক, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লিগ এবং শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের বিনিময়ে ইংরেজ সরকারের তরফে কোনও বিশেষ ঘোষণা, পারতপক্ষে কেন্দ্রে অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার অনুমতি না মেলায় কংগ্রেস 1939 সালেই সমস্ত প্রাদেশিক সরকার থেকে পদত্যাগ করে। এতে উৎফুল্ল জিন্না মুসলিম লিগকে সারা দেশে ‘মুক্তি দিবস’ পালনের ডাক দেন। সিন্ধ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বাংলায় হিন্দু মহাসভা সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক মেরুর মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ে। সম্প্রদায়গত রাজনীতিতে যুযুধান দুই দলের তখন অভিন্ন লক্ষ্য, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গড়ে তোলা। এমনকী যে হিন্দু মহাসভা এখন অখণ্ড ভারত গড়ার ডাক দিচ্ছে, সেই হিন্দু মহাসভাই 1943-এ সিন্ধ প্রদেশে মুসলিম লিগ সরকারের শরিক হয়েছে। মুসলিম লিগ নেতা জি.এম সৈয়দ যখন ব্রিটিশদের জানাচ্ছেন, দেশের মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র 'নেশন'-এর প্রয়োজন, তখনও কিন্তু হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্রব ত্যাগ করেনি। এই গোলমেলে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতেই কি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে রামমন্দিরের তুলনা? শ্রীরামপুর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক, জিষ্ণু দাশগুপ্তর মতে, ‘দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ এবং মহাসভা আগাগোড়া অনুপস্থিত থেকেছে, কখনও কখনও তারা আন্দোলনে পার্শ্ব খলনায়কের চরিত্রেও আবির্ভূত হয়েছে। এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতেই বোধ হয় তারা কোনও কল্পিত পরাধীনতার কথা বলে, নিজেদের সেই স্বাধীনতার ভগীরথ হিসাবে দেখাতে চায়।‘ বাংলার তৎকালীন ছোটলাট লুই মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমনে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, স্মরণ করিয়ে দিলেন, অধ্যাপক দাশগুপ্ত।
1943-এও অবশ্য হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে বিনায়ক দামোদর সাভারকর ব্রিটিশের সঙ্গে ‘সক্রিয় সহযোগিতা’-র নীতি নিয়ে চলার কথা জানান। দলের কর্মীদের কাছে তাঁর এই ‘বাস্তব রাজনীতি’-র স্বপক্ষে যুক্তি ছিল কংগ্রেস একটি আধা-জাতীয়তাবাদী সংগঠন। তাই জনগণের স্বার্থেই নাকি মহাসভার সদস্যদের ব্রিটিশের পাশে দাঁড়ানো উচিত। সাভারকর, মুঞ্জে কিংবা শ্যামাপ্রসাদরা যখন দেশকে হিন্দু নেশন হিসাবে গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছেন, গান্ধী দ্বিধাহীনভাবে বারবার জানিয়েছেন এই দেশে বসবাসকারী সকল মুসলমানদেরও এটা ‘হোমল্যান্ড’। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ভর দিয়ে সাফল্য পেতে চাওয়া, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপামর জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে খাটো করতে চাওয়া সংগঠনের উত্তরাধিকাররা কীভাবে রামমন্দির আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জুড়তে পারেন? মুঘল ইতিহাসের অধ্যাপিকা মৌমি বন্দ্যোপাধ্যায়, এক্ষেত্রে একটা গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘200 বছরের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সঙ্গে কীভাবে রামমন্দির আন্দোলন তুলনীয় হতে পারে? তবে কি কেন্দ্রের শাসকদল বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রামমন্দির নির্মাণটাকেই কোনও ঔপনিবেশিক সংগ্রাম হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন?’ আশঙ্কার সুরে তাঁর আরও বক্তব্য, ‘দেশের মুসলমানদের এই আরোপিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে কোণঠাসা করার চেষ্টা হতে পারে।‘
মঞ্চসফল একটা নাটকের প্রধান চরিত্র অপর এক চরিত্রকে বলেছিল, ‘সময়টা আসলে কার, সেটা কি তুমি বা আমি ঠিক করব? ঠিক করবে ইতিহাস।‘ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দল, এবং তাঁর পুরনো সংগঠনের সদস্যরা যদি ইতিহাসের দর্পণে সেই ফেলে আসা সময়টাকে ধরতে চান, তাহলে হয়তো 5 আগস্টের ওই বক্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে লজ্জিত হতে হবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার লজ্জিত হন, তা বোধহয় আমরা কেউই চাই না।
ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।
‘সৃষ্টিছাড়া’ বাংলায় লক্ষ্মী-সরস্বতীও দিদি-বোন হয়ে যায়।
নীলকন্ঠ পাখি ওড়াতে গিয়ে যারা নীলকন্ঠ হল যারা, তাদের প্রণাম।
সংবিধান দিবসের স্মরণ: নাগরিকের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র এই নথি।
দেশের পূর্ব প্রান্তে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের বিরোধ প্রায় দুই দেশের সংঘর্ষের চেহারা নিচ্ছে
বাপের বাড়ির হালফিলের খবরে বিচলিত মা দুর্গা।