×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • করোনার বাপ ঠাকুর্দা

    বিতান ঘোষ | 01-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    করোনা মহামারী ইতিমধ্যেই বিশ্ব ইতিহাসের এক জলবিভাজিকা বা Water shade হিসাবে চিহ্নিত। যে দুর্নিবার গতিতে এই রোগ তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে করোনা পরবর্তী বিশ্বের খোল-নলচেটাই বদলে যাবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্ত নিরিখেই এক নতুন পৃথিবীতে বাস করব আমরা। মানে আমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা।

     

    2020-র COVID-19 তথা করোনা মহামারীর প্রলয় রূপ যারা দেখছে, তাদের কারও অভিজ্ঞতায় তুলনীয় কিছু নেই। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ বিশ্বব্যাপী এমন মহামারী শেষ হয়েছিল 102 বছর আগে। তারও 20 বছর আগে হয়েছিল আধুনিক ভারতের প্রথম ভয়ঙ্কর মহামারী। ব্যক্তি মানুষের স্মৃতিতে না থাকলেও ইতিহাসের নির্মম স্মৃতিতে করোনার ওই সব পূর্বসূরীদের ইতিবৃত্ত সযত্নে লেখা আছে। ইতিহাস তো শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, একই সঙ্গে সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে। সেই সুবাদেই এই করোনার বাপ ঠাকুর্দার সন্ধান।


    তৎকালীন বম্বে-তে তৈরি একটি প্লেগ হাসপাতালের ছবি


    সময়টা 1897 সাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য যে কখনও অস্তমিত হয় না, এমন প্রত্যয় সর্বত্র মজবুত। আফিম বাণিজ্য, সুয়েজ খালের অবাধ ব্যবহারে ভর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তখন বাড়বাড়ন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির। বোম্বের জাহাজ বন্দরের অদূরে একটি শহরে দেখা মিলল একটা মারণ রোগের। বিউবনিক প্লেগ। রোগের নামটা পরিচিত, মারণক্ষমতাও অজ্ঞাত নয়। চতুর্দশ শতকে এই রোগটাই ইউরোপের একটা অংশকে প্রায় ছাড়খার করে ছেড়েছে। তবে এবার তার উৎপত্তিস্থল চিনের ইউনান প্রদেশ। শতাব্দী পেরিয়ে আজকের নভেল করোনা ভাইরাস -এর উৎপত্তিস্থল উহান প্রদেশ থেকে 1882 কিলোমিটার দূরে যার অবস্থান। তা এই ইউনান প্রদেশে সেই 1850-এর দশক থেকেই হান উপজাতিদের আনাগোনা, এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম ধ্বংস করা থেকেই নাকি এই রোগের প্রাদুর্ভাব।

     

    চিনের সঙ্গে ভারতের আফিম বাণিজ্যের হাত ধরেই হংকং হয়ে ভারতে প্রবেশ করে প্লেগ, ওই একই বছরে, 1897 সালেই। বোম্বে বন্দরের অনতিদূরে মান্ডবি শহরে প্রথম এই রোগের লক্ষ্মণ দেখা যায়। সেই সময় থেকেই বোম্বে ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহর। পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান আর ঘিঞ্জি এলাকার সৌজন্যে দ্রুত বাড়তে থাকে প্লেগ আক্রান্তের সংখ্যা। প্রথমে এই রোগ নিরাময়ে ব্রিটিশরা কিছুটা নিশ্চেষ্টই ছিল। তাদের মধ্যে এই ভয় ছিল, এইসব কারণে পাছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশাল সুযোগটা তাদের হাতছাড়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে তারা নড়েচড়ে বসে। রোগ আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজন রোগীদের আলাদা স্থানে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, কোয়ারান্টাইন কিংবা হোম আইসোলেশন চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন কোনও বিষয় নয়। একশো কুড়ি বছর আগেও চিকিৎসায় তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য ছিল। কিন্তু 'অবাধ্য' ভারতীয়গুলো ব্রিটিশের কোনও বিধিনিষেধ না মেনে আরও বেশি রোগ ছড়াচ্ছে; এই অভিযোগ তুলে এক কড়া আইন প্রণয়নের কথা ভাবল সরকার। প্রণীত হলো এপিডেমিক ডিসিজ অ্যাক্ট, 1897, যে আইনকে বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে আবারও তুলে আনা হয়েছে চলতি COIVD-19 মহামারীর জন্য। প্লেগ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষকে সরকারি বিধিনিষেধ মান্য করাতে স্থানীয় প্রশাসনকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয় উনবিংশ শতাব্দীর ওই আইনে। এই আইনবলে কোনও ব্যক্তি মহামারী মোকাবিলায় সরকারি বিধিনিষেধ না মানলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।

     

     

    এই আইনের পরিকল্পনা যার মাথা থেকে এসেছিল, তিনি ছিলেন পুনার তৎকালীন সহকারী কমিশনার, চার্লস র‍্যান্ড। কঠোর আইন প্রণয়নের দ্বারা মহামারীর প্রকোপকে অনেকটা রুখে দিতে পারলেও, সনাতন হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাদের অভিযোগ ছিল, প্লেগ মোকাবিলায় র‍্যান্ড যেভাবে চরমপন্থা নিচ্ছেন, তাতে হিন্দুদের প্রাচীন আচার আচরণে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। বাল গঙ্গাধর তিলক 'কেশরী' পত্রিকায় এই বিষয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়ে সুদীর্ঘ নিবন্ধ লিখলেন। 1897 সালের 22 জুন মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত চাপেকর ভ্রাতৃত্রয় দামোদর, বালকৃষ্ণ ও বাসুদেও, চার্লস র‍্যান্ড এবং লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্টকে হত্যা করে এর বদলা নিলেন। এই খুনের অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে তিলককে যখন গ্রেপ্তার করা হলো, তখন কোর্টরুমে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর প্রখ্যাত মন্তব্যটি করেছিলেন- "স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমি তা অর্জন করবোই।" আসলে মহামারী মোকাবিলায় চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সনাতনবাদীরা তখনও সন্দেহ ও বিদ্রুপের চোখে দেখতেন, যেমন অনেকে এখনও দেখেন। 

    আরও পড়ুন
    রাতের অন্ধকারে চোরের মতো প্রবেশ


    প্রথমে মনে করা হয়েছিল ইঁদুর থেকেই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ছে। পরে অবশ্য অনেক গবেষণা অনুসন্ধানের শেষে জানা গেল, বিউবনিক প্লেগের বাহক আসলে মাছি। মধ্য এশিয়ার ছোট লোমওয়ালা এক স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীর থেকে মাছির মাধ্যমেই সেটা মানবশরীরে প্রবেশ করে। জীবাণুটির পোশাকি নাম 'ইয়েরসিনিয়া পেসটিস'। 1898-তে বোম্বে, দাক্ষিণাত্য, যুক্তপ্রদেশে বহু জনপদকে নিঃস্ব করে দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করলো প্লেগ। সেইসময় স্বামী বিবেকানন্দের অনুরোধে অসুস্থ মানুষের সেবাকার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন ভগিনী নিবেদিতা।

     

    ভারতের ঘিঞ্জি এলাকায় প্লেগের দ্রুত বিস্তার ও মৃত্যুহারে বিচলিত হয়ে পড়ে ব্রিটিশ সরকার। জনৈক রাশিয়ান চিকিৎসক ওয়ালডেমার হাফকিনকে অনুরোধ করা হয় এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে 1898 সালের পর থেকে তিনি এই প্রতিষেধকের সফল ব্যবহার করতে থাকেন। ভারতে প্রায় এক দশক ধরে, 4 লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে নিয়ন্ত্রণে আনা হয় বিউবনিক প্লেগকে। তারপরেও অবশ্য ইউরোপে তার ধ্বংসলীলা অব্যাহত ছিল। বিউবনিক প্লেগ দেখিয়ে দিয়েছিল, ভারতের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কী অনায়াস ভঙ্গিতে সে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নিমেষে বাড়িয়ে নিতে পারে মৃত্যুর হার। শুধুই কি তাই? স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক ঘরবন্দি মানুষের যে একাকিত্ব? এই একাকিত্বই তো বিধৃত হয়ে আছে আলবেয়ার কামুর প্রখ্যাত ' দ্য প্লেগ' উপন্যাসে। ফ্রান্সের ওরান শহরের পটভূমিকায় এই উপন্যাসটি লেখা হলেও, প্লেগ আক্রান্ত গোটা বিশ্বেই তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল। আজ করোনা বিড়ম্বিত, ঘরবন্দি বিশ্ববাসীর অনেকেই তাই 1947 সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি উল্টেপাল্টে দেখছেন। ঘটনাচক্রে আজও করোনা মোকাবিলায় প্রশাসনের চিন্তার কারণ দেশের ঘিঞ্জি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। যেখানে একবার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে, তা রোখা খুবই কঠিন। তবে আশা করা যায়, 120 বছর আগের প্লেগ মহামারী থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমরা হয়তো আজকের করোনা মহামারীকে রুখে দিতে অনেকটাই সক্ষম হব। তা না হলে মহামারীর ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা বৃথা যাবে।

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত ‘দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই

    জীবনের সকল অন্ধকারে ভালবাসা আর মমত্বের রোদ্দুর পড়ুক, ক্রান্তিকালে এ'টুকুই তো প্রার্থনা।

    হঠকারিতায় বিচ্ছিনতাবাদের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেললে তাকে বন্ধ করা মুশকিল।

    ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।

    বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়র জয়ে প্রমাণ হল শাসক দলে ভিড়লে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হওয়া যায়!

    প্রবাসী সন্তানের অভাব ভুলিয়ে সন্তানের মতোই প্রবীণদের আগলাচ্ছেন তুর্ণীরা।

    করোনার বাপ ঠাকুর্দা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested