×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘দিদি’র কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলেন প্রধানমন্ত্রী

    বিতান ঘোষ | 07-05-2021

    পথের পাঁচালীর সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য।

    ‘দিদি ও দিদিইই...।' বাংলার নির্বাচনে বিজেপির রাজনৈতিক স্বপ্নের যে অকালমৃত্যু, তার এপিটাফে কি এই তিনটে শব্দই লেখা থাকবে? গত 1 এপ্রিল রাজ্যে ভোট-প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি’ বলেই সম্বোধন করেছিলেন। তবে, অনেকেরই মতে সেই সম্বোধনে ছিল বিদ্রুপ। তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল, প্রধানমন্ত্রী ইভটিজারদের মতো কথা বলছেন। তারপর একমাস এই ভঙ্গ বঙ্গদেশ অনেক রাজনৈতিক রঙ্গ দেখল। নির্বাচনের ফলাফলে প্রধানমন্ত্রীর দল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হল সেই ‘দিদি’র কাছেই।

     

     

    প্রধানমন্ত্রী বঙ্গ-বিজয়ে আগাগোড়া বাঙালি সাজার চেষ্টা করেছেন। বাঘা বাঘা কিছু কবিতাও মুখস্থ করে আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু বাংলার মননকে তিনি ছুঁতে পারেননি। ভোটের ফলাফল কাটাছেঁড়া করতে বসে বিজেপি নেতৃত্ব হয়তো এই সারসত্যটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন। বাংলার দিদি-ভাই-বোনের যে আদি অকৃত্রিম সম্পর্ক, প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মিতার আড়ালে তাকেই নস্যাৎ করতে বসেছিলেন। মনে আছে ‘পথের পাঁচালী’র সেই দৃশ্যপট? জ্বরাক্রান্ত দিদি দুর্গাকে অপু বলছে, ‘তুই কিছু মনে করিস নে দিদি, আমি তোকে ফেলে আর কক্ষনও টেরেন দেখতে যাব না।' নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে বাবা-মার সঙ্গে অপু যখন ট্রেনে করে কাশি-বেনারসের পথে, তখনও সে ট্রেনের জানলা দিয়ে গ্রামের বাঁকে মৃত দিদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। দিদিকে ফেলে অতদূর চলে যাওয়ার জন্য দুষেছে বাবা-মাকে। 

     

     

    ‘পথের পাঁচালী’ তো কোনও নগরকেন্দ্রিক গল্প নয়, বাংলার নদ, নদী, শাপলা, ওলকচুর সঙ্গে মিশে থাকা এক গ্রাম্য গল্প, যা বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা ভাই-বোনের সহজ সাবলীল সম্পর্কের কথা বলে। শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’ গল্পের কেষ্টাও তো রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মেজদিদির কাছেই মাতৃত্বের আস্বাদ পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বাংলা ও বাংলা ভাষা নিয়ে এত হোমওয়ার্ক করলেন, অথচ ‘দিদি’ ডাকের এই আবেদনটা বুঝলেন না? 

     

     

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ‘দিদি’ ডাকে বাংলা হয়তো আন্তরিকতা খুঁজে নিত। কিন্তু আপনার দলের কাজকর্মে বাংলা একটু বেশিই ভয় পেয়ে গেল। আপনারা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণে মদত জোগালেন। মুসলমান মানুষদের ‘জেহাদি’ বললেন। ভুলে গেলেন, এই বাংলায় রাখীবন্ধন নিছক ধর্মীয় কোনও উপাচার নয়, ভাই-বোনের, সাম্প্রদায়িক মিলনের প্রতীকস্বরূপ এক সামাজিক উৎসবও বটে। পুরাণ ঘেঁটেও দেখুন দুর্গা আদৌ লক্ষ্মীর মা নন, আর সরস্বতীও লক্ষ্মীর বোন নন। এঁরা প্রাচীনত্বে, মহাবিদ্যায় প্রত্যেকেই প্রায় সমতুল। বাংলায় এসে এঁরা একই পরিবারে মিশে গেছেন। তাই, এখনও বাংলার ঘরে ঘরে ভাইবোনের নাম হয় লক্ষ্মী, কার্তিক, গনশা, সরস্বতী। 

     

     

    সম্ভবত অলস, নিশ্চিতভাবেই অ-বানিয়া বাঙালি হয়তো নিশ্চিন্তে নিদ্রা সুখে সময় কাটাচ্ছিল। এত ঢক্কানিনাদে তার ঘুম ভেঙে গেল। মুখ্যমন্ত্রীকে কখনও বারমুডা পরার নিদান দিয়ে, ভরা সভায় মহিলা প্রশ্নকর্তাকে মহিলা হয়ে সহানুভূতি আদায়ের জন্য ভর্ৎসনা করে, প্রধানমন্ত্রীর দল বাংলাকে বিচলিত করল। এনআরসি, সিএএ-র খুল্লমখুল্লা বিভাজন নীতিতে বাংলা সিঁদুরে মেঘ দেখল। তারা অসহায় হয়ে কোনও এক রাজনৈতিক ‘দিদি’কেই বেছে নিল, বলা ভাল বাধ্য হল। মাতৃহারা ছোট ক্ষুদিরামকে তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে নিজের কাছে আগলে রেখেছিলেন তাঁর দিদি, তাই তাঁর নাম ক্ষুদিরাম। এই হল বাংলার ইতিহাস, ভূগোল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সেই বহুশ্রুত কবিতার দু’টি পঙক্তি মনে আসে। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই, মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?’ অসহায় ভাই-বোন বিপদে দিদির কাছেই তো আশ্রয় খোঁজে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে এতটা অসহায় নাই করতে পারতেন, ‘দিদি’ ডাকে পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন নাই দেখাতে পারতেন। বাংলার ভাইবোনেরা যে দিদির অপমানে কষ্ট পায়, এটা কি আপনি জানতেন না?


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    পদক জিতলে দেশের গর্ব, না হলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচতে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতকে।

    নিউ নর্মাল সময়ে মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেলেও বাঙালির এই চিরায়ত অভ্যাসে বদল আনতে পারেনি।

    বীরপুজোয় মত্ত শাসক এবং ভক্তরা ইতিহাস-বিস্মৃত হলে তাদেরই চরম মূল্য চোকাতে হবে।

    প্রকারান্তরে, তামিলনাড়ু বা কর্নাটকের মতো রাজ্যের দুই-ভাষা নীতিতেই সিলমোহর দিল কেন্দ্র।

    উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর স্বরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন দুই সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ

    শহরের বৈচিত্র্যময় মিছিলে বিভাজন রোখার ডাক।

    ‘দিদি’র কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলেন প্রধানমন্ত্রী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested