স্বাধীনতা প্রাপ্তি থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ 75 বছরে তাঁর জাতির জনক থেকে ‘চতুর বানিয়া’য় উত্তরণ ঘটেছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে তাঁর আঘাতক্লিষ্ট হে রাম-এর দ্বিগুণ রবে শোনা গিয়েছে জয় শ্রী রাম কিংবা লং লিভ অফ নাথুরাম। তাঁর স্বপ্নের রামরাজ্য হয়নি এই দেশ। পাশ্চাত্যের সংসদীয় গণতান্ত্রিক মডেলের উপর তাঁর যতই বিরাগ থাক, তাঁর অন্যতম আস্থাভাজন নেহরু সেই সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরেই নবজাতক ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। দিকে দিকে তাঁর আদর্শের এত বিপর্যয়, তাঁকে ঘিরে এত বিস্মরণ ও বিভ্রান্তি, তবুও তিনি এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহের সেই নির্বিকল্প মডেলেই তো তাঁদের দাবি ছিনিয়ে আনলেন দেশের কৃষকরা।
মহাত্মা গান্ধী। ন্যুব্জ শরীর, গোল ফ্রেমের চশমা, খদ্দরের কাপড়, হাতে লাঠি। আর একটি সুবিশাল মতাদর্শ, যা দেশ কাল ভেদে বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েও এখনও বহু গণআন্দোলনের মৃতসঞ্জীবনী। গান্ধী যখন ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছেন, তখন নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে আড়াআড়ি ভাবে বিভাজিত জাতীয় কংগ্রেস। চরমপন্থীদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপে সাহসিকতার ছাপ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও, সেই আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা গেল না। আর নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ তাঁদের পাশ্চাত্য শিক্ষালালিত চেতনায় যা-ই বলেন, তা-ই সাধারণের বোধগম্যের অতীত বলে মনে হয়। এই অবস্থায় ঔপনিবেশিক আন্দোলনকে জনগণের মাঝে নিয়ে এলেন গান্ধীজি। এ ক্ষেত্রে তাঁর দুই অস্ত্র হল অহিংসা ও সত্যাগ্রহ। সত্যের পথে থেকে নিজের প্রখর চেতনা ও নৈতিকতার জোরে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উপায়েও যে প্রবল পরাক্রমী শাসকের বুকে কাঁপন ধরানো যায়, তা সফল ভাবে করে দেখালেন গান্ধী।
তার পর সবরমতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। গান্ধীর অহিংসার নীতিতে অনাস্থা জানিয়েছেন বহু মানুষ। নিজের অহিংস নীতিতে অটল থেকে জীবন দিয়ে তাঁর সব ব্যর্থতার মূল্য চুকিয়ে গিয়েছেন মহাত্মা। তাঁর রামরাজ্যের পথ আর আধুনিক ভারতের পথটা স্পষ্টতই দু’টি বিপরীত দিকে বেঁকে গিয়েছে। তবু, সেই পথ দু’টির প্রায় প্রতিটি মোড়মাথায় এসে দাঁড়াচ্ছেন সেই ন্যুব্জ, অর্ধনগ্ন মানুষটি। বিনোবা ভাবের ভূ-দান আন্দোলনের সামনের সারিতে অদৃশ্য হয়ে তিনি রয়েছেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকেও তিনি অন্তরালে থেকে প্রেরণা জোগাচ্ছেন। তিনি প্রেরণা জোগাচ্ছেন চিপকো আন্দোলনের সুন্দরলাল বহুগুণাদের, ঠিক যেমন পথ দেখাচ্ছেন মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলাদের। প্রতিস্পর্ধী শাসকের সামনে তাঁর হাতিয়ার কখনও বদলায়নি। শত প্ররোচনাতেও তিনি তাঁর আদর্শের অনুসারীদের কখনও হিংসাশ্রয়ী হতে দেননি। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়েও একলা জ্বলতে বলেছেন।
প্ররোচনা এ দিকেও বিশেষ কম ছিল না। বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকেরা তবু স্থৈর্য হারাননি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এঁদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলেছেন, শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা ‘খলিস্তানি’, ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি বলে যৎপরোনাস্তি গাল পেড়েছেন। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে গাড়ি চাপা দিয়েছেন, গুলি ছুটিয়েছেন অন্নদাতাদের বুক লক্ষ্য করে। মিথ্যা মামলা, অভিযোগ তো রয়েছেই। তবু দেশের অন্নদাতারা এত বার রক্তাক্ত হয়েও কি পাল্টা হিংসার পথে গিয়েছেন? কৃষক সংগঠনগুলির মধ্যে একাংশ সেই পথে হাঁটতে চাইলেও, আন্দোলনের যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিসান মোর্চার তরফে বার বার তাঁদের রাশ টেনে ধরা হয়েছে। প্রত্যয়ী গলায় ওই সত্যাগ্রহের জোরেই বোধহয় কৃষকরা অক্লেশে বলতে পেরেছেন, আমাদের মেরে ফেললেও আমরা আমাদের অবস্থানস্থল থেকে নড়ব না। রাষ্ট্রের ভ্রুকুটির সামনে নিরস্ত্র হয়ে বসে থাকাও যে শাসককে শঙ্কিত করে, এই পাঠ তো গান্ধীই আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। আমরা কেউ কেউ তার অনুবর্তী হয়েছি মাত্র।
আরও পড়ুন: ‘দেশসেবক’ চেয়ারম্যান, তবু কদর নেই দেশনায়কের!
স্বাধীনোত্তর ভারতে বহু বৈপ্লবিক গণআন্দোলন সমকাল ও ভাবীকালকে প্রেরণা জুগিয়েছে। সাতের দশকের বাংলায় দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছে নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ। কিন্তু বসন্তের সেই বজ্রনির্ঘোষও কালের নিয়মে তাঁর প্রভাবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেনি। আন্দোলনের গণ-খতমের লাইন সাধারণের মনে ভয় উদ্রেক করেছে, বহু অসহায় প্রাণ নিঃশেষিত হয়েছে। গান্ধীর পথ এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে। এই পথে বিচ্যুতি আছে, আছে স্থৈর্যের অসীম পরীক্ষা, তবে এই পথ কালোত্তীর্ণ। নিজের নৈতিকতার জোরে যে বা যারা অটল, যারা অনমনীয় জেদে শাসকের চোখরাঙানির সামনেও নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল, তারা এই পথে সফল হবেই; যেমন আন্দোলনকারী কৃষকরা হলেন।
এই পথেও কি তবে কৌশল নেই? আছে বৈকি। প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক গণ-আন্দোলন মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলে, সেখানে পাল্টা পেশী আস্ফালন দেখানো পরাজয়ের নামান্তর। কিন্তু অহিংসার পথে হেঁটেও, শাসকের নরম-গরম প্ররোচনায় পা না দিয়েও যে অহিংস উপায়ে প্রতিস্পর্ধা দেখানো যায়, কোনও দিন স্বগতোক্তি বা আত্মসমালোচনার ধার না ধরা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে দিয়ে ভুল স্বীকার করানো যায়, তা দেশের কৃষকেরা দেখিয়ে দিলেন। বর্তমান বিজেপি সরকার জাতীয় জীবন থেকে মহাত্মার আদর্শ, পরিকল্পনাকে সর্বতো ভাবে মূলোচ্ছেদ করার চেষ্টা করলেও, এই ভুবনায়িত সময়েও মহাত্মা তাঁর খর্ব শরীর, অথচ দীর্ঘকায় ছায়া নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অতি বড় গান্ধী সমালোচকের পক্ষেও এই ছায়া থেকে সহজে বেরোনো সম্ভব নয়।
যৌনপল্লীর কেউ কেউ এখন স্থানীয় হাটে সবজি নিয়ে বসেন। কেউ আবার বুধবার করে ফুল, বেলপাতা, আমপল্লব নিয়ে।
জীবনের সায়াহ্নে এসে পরিচিত মানুষদের শঠতা, কৃতঘ্নতায় আঘাত পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।
নিজেদের দুর্বলতা কাটানোর দাওয়াই খুঁজে না পেলে অন্যরা দল ভাঙাবেই।
সরকার বিরোধী মত উঠে আসাতেই কি মন্ত্রীর কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ইন্টারনেট?
দেশের ইতিহাসে এক প্রহেলিকাময় চরিত্র হয়েই রয়ে যাবেন পিভি।