রিয়া চক্রবর্তী। রূপ কানোয়ার। দু'টো নাম। প্রথমজনের পরিচয় নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই। বরং পরিচয় করা যাক দ্বিতীয় নামটির সঙ্গে। জনশ্রুতি, 1987 সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্থানের দেওরালায় রূপ কানোয়ার নাম্নী এক রমণী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। কাঁসর-ঘণ্টা সহযোগে গোটা গ্রামের মানুষ রূপ কানোয়ারকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তুলে দিয়েছিলেন। নিজের গ্রামে তো বটেই, সে সময় গোটা দেশে রূপ কানোয়ার ‘সতীসাধ্বী' স্ত্রীর ‘গৌরব' লাভ করেছিলেন। এখনও সেই গ্রামে রূপ কানোয়ার পুজো পান। ভক্তরা আভূমিনত হয়ে প্রণাম জানায় তাদের সতীমাতাকে।
‘সতী' হওয়ার মানদণ্ড কেমন হতে পারে, সেটা দেখার জন্য খুব পিছনে হাঁটার দরকার নেই। দেশের আধুনিক মননের তরুণ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর শাসনকালের মেয়াদ তখন মাত্র তিন বছর। সেই সময়েই ঘটেছিল এই রূপ কানোয়ারের ঘটনা। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হেঁটেছে দেশ, বিশ্বায়নের পাকে বাঁধা পড়েছে বিশ্ব। সতী-সাবিত্রীর দেশে তবু ‘পতিব্রতা' নারীর গুরুত্ব কমেনি! এক্ষেত্রে রিয়া পতিব্রতা নন। যদিও তাঁর সীমন্তে সিঁদুর নেই, গলায় মঙ্গলসূত্র নেই, কিন্তু অমন অপাপবিদ্ধ একটা পুরুষ সঙ্গী তো তাঁর ছিল! তিনি নিশ্চয়ই পারতেন তাঁর প্রেমিককে সঠিক পথে নিয়ে যেতে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে। রিয়া পারেননি। আচ্ছা, রিয়া পুণ্যিপুকুর ব্রত করেছেন? নিজের খোলা চুল দিয়ে প্রেমিকের চরণ মুছিয়ে দিয়েছেন? এসব সনাতন সংস্কারজ্ঞান না থাকলে ‘সংস্কারি' ভারতে কল্কে পাওয়া মুশকিল। অন্যথায় সমাজ ব্যভিচারী ভাবতে পারে। রিয়া কি সেটা জানতেন না?
রূপ কানোয়ারের ঘটনার পর দেশের একটা বড় অংশ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। তাতে অবশ্য ‘সংস্কারি' ভারতের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। সেই ভারত বহাল তবিয়তে এগিয়ে চলল। 1988 সালে প্রতি রবিবার টিভিতে রামায়ণ দেখানো শুরু হল। ভক্তির ধারাস্রোতে ভেসে গেল দেশ। দেশের প্রাচীন পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কারের পাঠশালা বসল টেলিভিশনে। স্মরণে রাখতে হবে, তখনও কিন্তু বাবরি মসজিদের তিনটে গম্বুজই অক্ষত রয়েছে, যেগুলো আরও চার বছর পরের এক দ্বিপ্রহরে ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু সেটারও ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল এই সময় থেকেই। স্বামী অগ্নিবেশের মতো আর্য সমাজীরা যখন রূপ কানোয়ারের ঘটনা নিয়ে সরব হলেন, তখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি সতী প্রথার সমর্থনে দেশজুড়ে মিটিং-মিছিল করে চলল। হিন্দু নারীকে সতীত্ত্বে উত্তরণের পথে বাধা দেওয়া হবে কেন?— এই ছিল তাদের প্রশ্ন।
তারপর উদারীকরণের হাত ধরে দেশে হরেক নতুন বেসরকারি চ্যানেল তৈরি হল। সেখানে নারীকেন্দ্রিক ধারাবাহিকগুলিতেও সংস্কারের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা দেখা গেল না। সেখানকার নারী চরিত্রগুলি অনতিক্রম্য বাধাকেও হেলায় ডিঙিয়ে যায় ঠিকই, তবে তাকে অনেক ‘পরীক্ষা'ও দিতে হয়। যত বেশি পরীক্ষা, তত বেশি সহানুভূতি। আর তত বেশি টিআরপি। নিমাই সন্ন্যাস যাত্রাপালায় দর্শকরা যেমন নিমাই চরিত্রের মুখে ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া গো' শুনে কেঁদে ভাসাতেন, তেমনই ধারাবাহিকগুলোতে ‘ওগো আমার প্রাণনাথ' আর্তিতে দর্শকের চোখে জল নামায়। এই সময়কার চলচ্চিত্রেও দেখা যেতে লাগল, স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে শিবলিঙ্গের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থাতেও মাথা ঠুকে রক্ত বার করছেন স্ত্রী। আবার সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে সহসা সেটা নিভে গেলে পতিদেবের অমঙ্গলের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন স্ত্রী, এমনটাও ঘনঘন দেখানো হতে থাকল।
এই যে সমাজনির্মাণ তার বাইরে একবিংশ শতকের ভারতও বেরোতে পারেনি। হয়তো বেরোনোর কথাও ছিল না। তাই অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের জীবনে দুই নারী, অঙ্কিতা লোখান্ডে এবং রিয়া চক্রবর্তী জনতার চোখে সুয়োরানি এবং দুয়োরানি হয়ে গেছেন। অঙ্কিতার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে সুশান্ত মারা যাননি। উল্টে তখন তাঁর কেরিয়ারগ্রাফ নাকি ঊর্দ্ধমুখী ছিল। মানে সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য হয়েছিল আর কী! কিন্তু রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীনই সুশান্ত মারা যান। অভিনেতার মৃত্যুর পিছনে যে কারণই থাক, ‘সংস্কারি’ ভারত রিয়াকেই দোষী ঠাহর করেছে। ওই যে, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, নারী নরকের দ্বার, আবার স্বর্গেরও পথপ্রদর্শক। রিয়া সতীসাধ্বী হলে নিশ্চয়ই প্রেমিককে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন! রিয়ার টি-শার্টে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার যে ডাক ছিল, তা ক'জন দেখেছেন জানা হয়নি, তবে রিয়ার বক্ষবিভাজিকা আর স্তনের মাপজোক নিয়ে অনেক চটুল কথা শুনলাম সোশাল মিডিয়ায়। দুঃখের বিষয়, যারা এগুলো বলছেন, তাদের অনেকেই নারী। তাদেরও নিশ্চয়ই প্রেমিক কিংবা স্বামী আছে।
দীর্ঘ ঘরবন্দিতে ক্লান্ত ভারত আপাতত এক গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই দেখতে বসেছে। ঘন ঘন তালি বাজছে, পৈশাচিক উল্লাসে নেচে উঠছে জনতা। হুহু করে বাড়ছে টিআরপি। রিয়া নাম্নী একটা মেয়ে রূপ কানোয়ারের মতো চিতায় উঠছে না ঠিকই, তার চারধারে অজস্র লোক কাঁসর ঘণ্টা বাজাচ্ছে না ঠিকই, তবে সেই পৈশাচিক উল্লাস আর পরীক্ষায় নামা নারীর আর্তি ঢাকার ঝংকারই যেন শোনা যাচ্ছে দিকে দিকে। রিয়া রূপ কানোয়ার নন, তিনি ‘মরিয়া' অমরত্বের প্রমাণ দিতে পারবেন না। হয়তো বাকি জীবনটা তাঁকে সমাজে ধিক্কৃত হয়েই বাঁচতে হবে। আইনি লড়াইয়ে তিনি জিতবেন কি না তা অবশ্য দেশের আইন আদালত ঠিক করবে। কিন্তু সমাজ নির্মিত ‘খুনি' হিসাবে একাকী রিয়াকে যে অসম লড়াইটা লড়তে হচ্ছে, সেই লড়াইয়ে সংহতি থাকবে। প্রিয় রিয়া, এই দেশে ‘সতী' হওয়ার চেয়ে ‘ডাইনি' হওয়া ভাল। মরে গিয়ে মন্দিরের দেবী হওয়ার চেয়ে, let's smash the patriarchy বলে গর্জে ওঠা ভাল।
বাঙালিকে রবীন্দ্র-কবিতা না শুনিয়ে, প্রধানমন্ত্রী ‘খেলা’র মন্ত্র শেখালে জাতির উপকার হতে পারে!
সেনেগালকে সারা বিশ্ব চিনত বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, ক্ষুধাপীড়িত দেশ বলে
প্যালেস্টাইনে আবারও নরমেধ যজ্ঞে কতটা নজর দিতে পারবে মহামারীতে বিপর্যস্ত দুনিয়া?
শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।
বিশ্বের পুরুষ প্রধানরা আজ সঙ্কটের দিনে যখন দিশাহীন, তখন সঠিক পথ দেখাচ্ছেন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানই।
‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!