×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মুখোশ খুলে দেওয়ার বই ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ

    বিতান ঘোষ | 17-02-2021

    গত 13 ফেব্রুয়ারি বইয়ের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন বিশিষ্টরা (বামদিকে)। বইয়ের প্রচ্ছদ (ডানদিকে)।

    ভাবি আমার মুখ দেখাব, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।' কবি শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত এই কবিতার পংক্তিটি অবিকল মিলে যায় আজকের ফেসবুক শাসিত সমাজের সঙ্গে। ফেসবুক শাসিত’? পাঠকের ভ্রুকুঞ্চন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলে নেওয়া ভাল কেন কবিতাংশটির সঙ্গে ফেসবুককে মেলালাম। আমরা যারা ফেসবুককে আপন মতামত প্রতিষ্ঠার এক জগৎজোড়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মনে করি, তারা অনেক সময়ই বিস্মৃত হই যে, ফেসবুকও একটি আদ্যোপান্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রযুক্তি-দৈত্য সংস্থাটি নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়িক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তাদের কর্মপদ্ধতি পরিচালনা করে। সেখানে ন্যায়নীতি, ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের খুব একটা স্থান নেই। আর তাদের এই ব্যবসায়িক মুনাফায় দাবার বোড়ে হই আমরা। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন আমরাই— যারা ভাবি ফেসবুক দয়াপরবশত আমাদের জন্য এক ভুবনডাঙার মাঠ উন্মুক্ত করে দিয়েছে, সেই মাধ্যমে আমাদের যথেচ্ছ বক্তব্য রাখার জন্য। আদতে ওরা বিপণন করছে আমাকে, আপনাকে, বিপণনের কৌশলও তৈরি করছে আমাদের দিয়েই। ফেসবুক নিয়ে আমাদের এরকম অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটাবে সদ্য প্রকাশিত ফেসবুক: মুখ ও মুখোশবইটি।

    আমরা কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কোন রঙ দেখে বিরক্ত হচ্ছি— এ সবকিছুর সুলুকসন্ধান ফেসবুকের কাছে আছে। আমরাই স্বেচ্ছায় আমাদের ব্যক্তিজীবনের মহার্ঘ্য তথ্যগুলি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। ফেসবুক তার তথ্যভান্ডারে সব জমিয়ে রাখছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিমানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করছে। তার মনোলোকের অতলে পৌঁছে যেতে চাইছে। বিপদটা ঠিক এখানেই। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে ফেসবুক। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাধারণ নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। এ দেশেও বিরোধীরা বারবার অভিযোগ করেছেন, 2014 সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর লার্জার দ্যান লাইফভাবমূর্তি তৈরিতে ময়দানে নেমেছিল ফেসবুক। মার্কিন মুলুকেও নেটিজেনদের ট্রাম্পবিরোধী মন্তব্য সরিয়ে দেওয়া, ট্রাম্পের বিদ্বেষমূলক মন্তব্য প্রচারের পরেও ব্যবস্থা না নেওয়া, ইত্যাদি নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত মার্ক জুকারবার্গের সংস্থা।

    ভারতের ক্ষেত্রে বিপদটা আরও বহুমাত্রিক ও বিস্তৃত। ভারতের মতো বিপুল আকার ও জনসংখ্যার দেশ ফেসবুকের কাছে এক লোভনীয় বাজার। ডিজিটাল মিডিয়ার অগ্রগতির এই যুগে ঠিক-ভুলের সীমারেখাটাই ঘুচে যেতে বসেছে। তাছাড়া এই দেশে খবরের সত্যতা যাচাই বা ফ্যাক্ট চেকে এখনও অনেকেরই অনীহা রয়েছে। ফেসবুকই সত্য, জগৎ মিথ্যা; এটিকেই আপ্তবাক্য মনে করেন অনেকে। তাই দিল্লিদাঙ্গায়, করোনাকালে একাধিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়ানোভুয়ো খবরে বিভ্রান্ত হয়েছেন মানুষ। বহির্বিশ্বের রোহিঙ্গা নিধন থেকে এ দেশের দিল্লি দাঙ্গা— কীভাবে মিথ্যা খবর এবং গুজবের ধাত্রীভূমি হয়ে উঠেছে ফেসবুক, তার পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ ইতিবৃত্ত রয়েছে এই বইয়ে। এই বইয়ের লেখকত্রয়— স্বনামধন্য সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সিরিল স্যাম এবং অর্ক দেব তাঁদের বহু পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ে দেখিয়েছেন, ফেসবুকের নিরীহ মুখোশের আড়ালে কী ভয়ঙ্কর একটা মুখ লুকিয়ে রয়েছে। তথ্য ও পরিসংখ্যান সহযোগে ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে এই বইতে এমন কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যা আমাদের নতুন করে ভাবায়, খানিক ভয়ও জাগায়।

    অতীতেও পাঠকদের সামনে ফেসবুকের মুখোশ খুলে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা এবং সিরিল স্যাম, তাঁদের ইংরেজি বই ‘The Real Face of Facebook in India’ গ্রন্থে। এবার এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হল ফেসবুক: মুখ ও মুখোশশিরোনামে। তবে এই বই কোনও নিছক মূলানুগ অনুবাদকীর্তি নয়। বইয়ের সহলেখক অর্ক দেব এ রাজ্যে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় ফেসবুকের ভূমিকাকে জরিপ করে দেখেছেন। পাঠকদের দেখিয়েছেন কীভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি ফেসবুকের সাহায্যে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে মানুষকে হিংসায় প্ররোচিত করছে, জাতিদাঙ্গায় মদত জোগাচ্ছে। আর ফেসবুক সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকের যাবতীয় ভুল’, ‘অন্যায়কে মাফ করে দিলেও, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মতকে দমিয়ে রাখছে। এক্ষেত্রে ফেসবুকের অস্ত্র তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড নীতি। সরকার-বিরুদ্ধ মতকে এই স্ট্যান্ডার্ডের পরিপন্থী দাগিয়ে দিয়ে ফেসবুক সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের এই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের মানদণ্ড কী, তা এখনও স্পষ্ট করতে পারেনি মার্কিন সংস্থাটি। বইয়ের একস্থানে আলোচনায় এসেছে অধুনা ফেসবুকের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপের কথাও। দেশের জনৈক প্রভাবশালী রাজনীতিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে তৈরি করাখবর ছড়িয়ে দিতে বলছেন— সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই বইয়ে।

    ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা কেমব্রিঅ্যানালিটিকাকে উপভোক্তাদের তথ্য পাচার কিংবা সম্প্রতি ধূলাগড় দাঙ্গায় ভুয়ো সাম্প্রদায়িক খবর ছড়ানোয় নীরব প্রশ্রয় জোগানো— ফেসবুক নিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে এই বইয়ে। শিয়রে বঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে এই বই তর্কপ্রিয় বাঙালিকে অনেক রসদ জোগাবে। বাংলার পাঠক পাঠিকারাও এবার ফেসবুকের অন্দরমহলের রূঢ় বাস্তবটা সম্পর্কে অবগত হবেন। আজকের ইনফোডেমিকে আক্রান্ত বিশ্বে, ফেক নিউজে ভরা ভারতে এই বই যে আমাদের অনেককেই এই বিষয়ে সমৃদ্ধ করবে, সচেতন করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত, এই বিষয় নিয়ে অতীতে বাংলা ভাষায় এমন গবেষণাধর্মী কোনও কাজ হয়নি। তদুপরি, প্রাঞ্জল গদ্যে, অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে আপাত জটিল বিষয়গুলিকে এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ধন্যবাদ প্রাপ্য সাংবাদিক অর্ক দেব, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সিরিল স্যামের। একই সঙ্গে এই বইয়ের প্রকাশক গুরুচন্ডা৯’- প্রকাশনীও ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।


    ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ
    অর্ক দেব, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সিরিল স্যাম
    প্রকাশক- গুরুচন্ডা৯
    মূল্য- 160/-

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?

    সেনাকে বুকে গুলি করার নিদান দেন যে দলের নেতারা, সেই দল উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ছাঁটতে চ

    যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত ‘দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই

    বুকের মাঝে আস্ত একটা দেশকে যারা লালন করতে ব্যর্থ, তারাই ভাগাভাগির কথা বলে।

    এইসব মানুষগুলোর সুরাহা করে দিতে দেশের ‘অর্থমন্ত্রী' নামক এক চরিত্র তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেবেন বলছেন।

    হঠকারিতায় বিচ্ছিনতাবাদের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেললে তাকে বন্ধ করা মুশকিল।

    মুখোশ খুলে দেওয়ার বই ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested