×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দুয়ারে তালিবান: ভাষণে সমস্যা মিটবে না

    বিতান ঘোষ | 23-08-2021

    প্রতীকী ছবি।

    উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংকট তীব্রতর হচ্ছে। যারা মনে করছেন হিন্দুকুশের ওপারে কী হল না হল তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, তারা হয়তো বৃহত্তর সম্ভাবনার দিকগুলো খতিয়ে দেখছেন না। ভারতের জন্য সমস্যাটা প্রায় উভমুখী। একদিকে বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে নিজেদের এতদিনকার নৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখার, অপরদিকে কূটনৈতিক ভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করা— দু'টি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফল হতে হবে দেশের শাসকদল বিজেপিকে। 

     

     

    বৃহত্তর বিশ্ব, বিশেষত ডেমোক্র্যাট পরিচালিত আমেরিকা আফগানিস্তানে মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা নিয়ে ভাবিত। অ্যামনেস্টির কর্তারা, মালালা ইউসুফজাই নিরাপদ আশ্রয় থেকে রোজই তালিবানদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন। ভারতের জন্য সংকটটা কিন্তু প্রত্যক্ষ। নিরাপত্তা পরিষদের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ চিন ও রাশিয়া ইতিমধ্যেই তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতার বার্তা দিয়েছে। আমেরিকার ভাবভঙ্গি দেখেও মনে হচ্ছে, তারা আপাতত নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলেই বাঁচে। তালিবান যদি দোহা শান্তি বৈঠকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তবে আমেরিকা আফগানিস্তান নিয়ে আর পরীক্ষানিরীক্ষার পথে হাঁটবে না বলেই মনে হয়। পড়শি রাজ্য পাকিস্তানের অবস্থাটা অবোধের গোবধে আনন্দের মতোই। তালিবান যতই খাইবার প্রদেশে পাক সেনাকে মারধর করুক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এতদিন পর এলেমদার হওয়ার সুযোগ ইমরান খান ছাড়বেন না। তাছাড়া তাঁর ওপরও ঘরোয়া রাজনীতির অনেক চাপ আছে।

     

     

    চিন, রাশিয়া প্রত্যেকেই স্ব স্ব স্বার্থে তালিবান-মিত্র হয়ে যাবে। কিন্তু ভারত কী করবে? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় নির্বান্ধব হয়ে বসে থাকবে? নাকি সীমান্ত নিরাপত্তা মজবুত করে মধ্য-পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য তালিবান বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে অক্ষ তৈরি করবে? সাউথ ব্লকে প্রকৃতপক্ষে কতজন ‘চাণক্য’ আছেন, তা কিন্তু প্রমাণিত হবে এখনই। বিরোধী বিধায়কদের রিসর্ট-বন্দি করা, আর অশান্ত সময়ে সঠিক অভিমুখে দেশের বিদেশনীতিকে পরিচালিত করা এক জিনিস নয়। 

     

     

    উপমহাদেশের ছোট-মেজ জঙ্গি সংগঠনগুলো তালিবানি পুনরুত্থানে উল্লসিত। সীমান্তে এদের দাপাদাপি বাড়বে। ভারতকে ব্যতিব্যস্ত রাখার চেষ্টা হবে। এসব এড়াতে যদি তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয় ভারতকে? ভারত আগাগোড়া বিশ্বাস করে এসেছে সামরিক কায়দায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে ভারত সেই সরকার বা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেবে না। আজ থেকে বহু বছর আগে নির্জোট আন্দোলনের বান্দুং বৈঠক (1955) ও প্রথম আনুষ্ঠানিক বেলগ্রেড সম্মেলনে (1961) আফগানিস্তানের উপস্থিতিতেই ভারত তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। সেই কূটনৈতিক ঐতিহ্য থেকে কি বেরিয়ে আসবে ভারত? বেরিয়ে এলেও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ হিসাবে এটা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মায়নমারের ‘গণতন্ত্রী’ সুকি কথা রাখেননি, তালিবান রাখবে এমন মনে করার বিশেষ কারণ নেই।

     

    আরও পড়ুন: ফতোয়া নয়, প্রেমই মেলাবে

     

    এবার আসি অন্দরের কথায়। দেশের শাসকদলের নেতামন্ত্রীরা ইতিমধ্যেই তালিবানি ভূত দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন। যাবতীয় অ-বিজেপি সরকারকে ‘তালিবানি শাসন’ আখ্যা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। একটা মৌলবাদের ভূত দেখিয়ে অন্য মৌলবাদী ভূতকে ছেড়ে দিলে সাময়িক রাজনৈতিক লাভ হতে পারে, কিন্তু কিছু পরেই সেই বিপদ দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসতে পারে। দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করছেন, স্থানীয় আফগানদের ইচ্ছাতেই তালিবানরা ক্ষমতায় এসেছেন। তাজিক, পশতু, হাজারা সহ বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগানদের কে স্থানীয় আর কে বহিরাগত, তা এখন প্রায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তালিবানদের প্রভাব মূলত পশতুভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া সেখানেও অবস্থানগত প্রশ্নে তালিবান শীর্ষনেতাদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। হাক্কানি পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হাক্কানি নেটওয়ার্ক অবস্থানগত প্রশ্নে অনেকটাই গোঁড়া ও চরমপন্থী। এদের ওপর আবার পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে তালিবানের যে শীর্ষনেতা কাবুলের মসনদে বসতে চলেছেন বলে খবর, সেই আব্দুল গনি বরাদরের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ততটাও সহজ, স্বাভাবিক নয়। পঞ্জশিরে তালিবানি আগ্রাসন রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন প্রয়াত আহমেদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমেদ মাসুদ। দেশের সদ্য প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লা সালেহ্ পঞ্জশিরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে তালিবানের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। স্মরণে রাখতে হবে মাসুদ এবং সালেহ্ দু'জনেই তাজিক গোষ্ঠীভুক্ত এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ অনুযায়ী তাঁরা তীব্র তালিবান বিরোধী, সেই সোভিয়েত আমল থেকেই। তুলনায় ভাবনাচিন্তার দিক থেকেও তাঁরা অনেকটাই উদারমনস্ক। তাজিকরা মূলত তাজিকিস্তানের আদি বাসিন্দা হলেও আফগানিস্তানে তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী— পশতুদের পরেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে করুণ অবস্থা সংখ্যালঘু হাজারাদের, যাঁরা চেঙ্গিজ খানের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কাবুলের সীমানা ছাড়িয়ে বহু প্রান্তবর্তী প্রদেশে তালিবানদের হাতে এই হাজারা গোষ্ঠীর মানুষরা নৃশংসভাবে খুন হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান কুশীলবরা, যাঁরা সংখ্যালঘু অর্থে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আরও স্পষ্ট করে বললে মুসলমানদের বোঝেন, তাঁরা নয়া নাগরিকত্ব আইনে পড়শি দেশগুলোতে ‘ধর্মীয় কারণে উৎপীড়িত’ মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ ধরেই নেওয়া হয়েছে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশগুলোতে বাকি সব ধর্মের মানুষ উৎপীড়িত হলেও মুসলমানরা হবেন না। তাই তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনও সংস্থান রাখা হয়নি। এখন প্রশ্ন হল আফগানিস্তানের অত্যাচারিত হাজারা কিংবা চিনের উইঘুররা কি মুসলমান নন?

     

                                  ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান থেকে নেমে আসছেন আফগান মহিলারা

     

    বিপদটা ক্রমে বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। এ দেশের অনেকেই মনে করছেন, সংখ্যালঘু পীড়নের পাল্টা তালিবানি মৌলবাদ জাস্টিফায়েড একটা ঘটনা এবং এতে অন্য মৌলবাদ ভয়ে গুটিয়ে থাকবে। যদি সত্যিই কেউ এমন উর্বর ভাবনার দ্বারা ভাবিত হন, তাহলে তাঁরা মারাত্মক ভুল করবেন। দু'পক্ষই তখন আরও বেশি দাঁত নখ বের করবে। একটা আগুনে ঘি ঢাললে অন্য আগুন কি নিষ্প্রভ থাকতে পারে, না অতীতে কখনও থেকেছে?

     

     

    আলাদা করে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে বাংলাদেশকে নিয়ে। সে দেশের একাংশ যেভাবে তালিবানি ‘বিজয়ে’ উল্লসিত, তা দেখে রীতিমতো ভয় হচ্ছে। কষ্টও হচ্ছে আরও বেশি। এই কি মৌলানা ভাসানি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ? জানা নেই হাসিনা কীভাবে তাঁর দেশের এই মৌলবাদী আস্ফালনকে রুখবেন। পড়শি ‘বন্ধু’ দেশে গণহিস্ট্রিয়ার মতো এই ভারত-বিদ্বেষ, এবং অ-ইসলাম বিদ্বেষ অত্যন্ত অস্বস্তিজনক। 

     

    আরও পড়ুন: ঘরের পাশেই তালিবান

     

    সোশাল মিডিয়ার কমেন্টবক্সে দু'পক্ষ থেকেই ক্রমাগত প্ররোচনা ছড়ানো হচ্ছে। উপমহাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য প্রায় এক শতক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু আশা ছিল, এখনও হয়তো আছে, এই মৌলবাদ, মৌলবাদী শক্তিরা চিরস্থায়ী নয়। জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। শুধু একটা জায়গাতেই আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কুমিরছানা দেখানোর মতো এক মৌলবাদের ভয়াবহতা দেখিয়ে অন্য পক্ষ যেন অবচেতনেই আমাদের মনে আর এক মৌলবাদকে প্রোথিত না করে দেয়। এক মৌলবাদের অব্যর্থ দাওয়াই অপর মৌলবাদ— বিশ্বের ইতিহাস ঘাঁটলে কোথাও এমন দেখা যাবে না। বরং উল্টো ঘটনাটাই ঘটেছে ভুরিভুরি।

     

     

    আমাদের দেশের শাসকদলের অনেক নেতামন্ত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমরা 70 শতাংশ। বাকিরা একজোট হয়েও আমাদের হারাতে পারবে না।' আফগানিস্তানে মৌলবাদী শক্তির উত্থান হয়তো ঘরোয়া রাজনীতিতে ক্রমশ কোণঠাসা হওয়া শাসককে কিছুটা অক্সিজেন দেবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও পরিমিতিবোধের জ্ঞানটা শাসকের থাকা প্রয়োজন। ভারত কিন্তু সর্বদাই তাঁর পক্ষপাতহীন বিদেশনীতি এবং ন্যায়ধর্মের জন্য বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষভাবে আদৃত হয়েছে। আবার ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ আদর্শে মান্যতা দিয়ে বহু ছিন্নমূল মানুষকেও বিপদের দিনে আশ্রয় দিয়েছে। উপমহাদেশের আকাশে আবারও কালো মেঘ। নৈতিক ও কূটনৈতিক ভাবে ভারত যে এখনও স্বতন্ত্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ হিসাবে তার মুক্তচিন্তা, সৌভ্রাতৃত্ব, অহিংসা নীতির জন্য যে সে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে, তা আরও একবার প্রমাণ করতে হবে দেশের শাসক বিজেপিকেই।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    সরকার বিরোধী মত উঠে আসাতেই কি মন্ত্রীর কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ইন্টারনেট?

    কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই দেশ, আবারও না হয় পরীক্ষা দেবে।

    বিপদের সম্মুখে অসহায় মানুষের আপাত দুর্বল জায়গাগুলো এইভাবেই বুঝি বেআব্রু হয়ে পড়ে।

    যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।

    খাদ্য, বস্ত্র যখন পয়সা দিয়েই কিনতে হয়, সংবাদ নয় কেন?

    ফলাফল যার পক্ষেই যাক, বাংলার সামনে ইতিহাসের হাতছানি স্পষ্ট।

    দুয়ারে তালিবান: ভাষণে সমস্যা মিটবে না-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested