×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মরিচঝাঁপি: গণহত্যার কাহিনি এখন সাম্প্রদায়িক মলাটে

    রাতুল গুহ | 02-02-2022

    নিজস্ব ছবি

    দেশভাগ পরবর্তী সময়ের উদ্বাস্তু ইতিহাসে এক রক্তলেখার নাম মরিচঝাঁপি। জনমানসে সুন্দরবনের প্রান্তিক দ্বীপটির পরিচিতি ঘটে দলিত উদ্বাস্তু বাঙালিদের গণহত্যার সূত্রে। মরিচঝাঁপির গণহত্যা দীর্ঘ বামফ্রন্ট জমানায় মূল ধারার ইতিহাসে অনালোচিত থেকেছে। থেকেছে কারণ শাসক চায় না তাঁর শ্বেত বস্ত্রে রক্তের দাগ লাগুক। মরিচঝাঁপির দলিত ছিন্নমূল মানুষগুলিকে নিয়ে উদাসীন থেকেছে শহর-মফস্বলের কলোনিগুলিও। প্রভু সংস্কৃতি, উচ্চবর্ণীয় অবস্থান চেতনে-অবচেতনে ভাগ করেছে ছিন্নমূল বাঙালিকে। 

     

     

    এ যেন বিভাজনের মধ্যে বিভাজন। জাত-বর্ণের বিভাজন সর্বোপরি উদ্বাস্তু আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। '47 পরবর্তী সময়ে যে "বামপন্থীরা' (CPIM, UCRC) উদ্বাস্তু অধিকার আন্দোলনের ধ্বজা উর্ধ্বে তুলেছিলেন , তাঁরাই শাসক হয়ে গুলি আর কাঁদানে গ্যাস দিয়ে প্রাণ কাড়ল মরিচঝাঁপির ভুখা তৃষ্ণার্ত মানুষগুলোর। শাসক সাময়িক ভাবে সেই রক্তলেখা চাপা দিয়েছিল বটে, কিন্তু অমীমাংসিত থেকে গেছে বহু প্রশ্ন। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে দাঙ্গা বিপর্যস্ত দুই বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছিল উদ্বাস্তু জনতা এবং তাদের অধিকারের লড়াই ও ভাষা আন্দোলন। আর, ইতিহাসের পথচলায় উদ্বাস্তু হত্যাকাণ্ডই সাম্প্রদায়িক শক্তির পুঁজি। হিন্দুত্ববাদের নির্মাণে মরিচঝাঁপির দলিত ছিন্নমূল মানুষেরা তকমা পান "হিন্দু' দলিতের। উচ্চবর্গের আর নিন্মবর্গের ভাগ অদৃশ্য হয়ে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইতিবৃত্ত মুছে, তাই আজ মরিচঝাঁপি "হিন্দু' বাঙালির গণহত্যার এক দলিল

     

     

    1963 সালে পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা পরিস্থিতিতে বহু হিন্দু ও দলিত, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষেরা ভারতে আশ্রয় নেয়। 1964 সালে যারা পশ্চিমবঙ্গে এলেন, তাঁদের জন্য কোন ক্যাম্প খোলা হল না। রিসিভিং সেন্টার থেকে চিরকূট হাতে নিয়ে তাঁদের গন্তব্য হন দণ্ডকারণ্য। এঁরাই হলেন ভারত রাষ্ট্রের বোঝা। নানান শিবিরগুলোতে এদের জেল–খানার আসামীদের চেয়েও চরম অব্যবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছিল। উড়িষ্যার কোরাপুট ও ছত্তিশগড়ের বস্তারের তপ্ত লৌহমৃত্তিকা অঞ্চলে উদ্বাস্তুরা বাস করতে শুরু করেন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে। বাকি গ্রামগুলিতে কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটলেও মালকানগিরি অঞ্চলে গড়ে ওঠা 23টি গ্রাম ছিল অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত৷ এই অঞ্চল থেকেই মরিচঝাঁপির দিকে যাত্রা শুরু করেন উদ্বাস্তুরা।

     

    মরিচঝাঁপি , সাম্প্রদায়িক মলাটে

     

    1978 সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই শুরু হয়ে গেল সুন্দরবন যাওয়ার প্রস্তুতি। দণ্ডকারণ্য সহ অন্যান্য সকল অঞ্চলে সমিতির মাধ্যমে খবরাখবর হয়ে গেল, "এবার আমাদের সুন্দরবন রওনা হতে হবে। যেভাবে পারেন সুন্দরবন যাত্রা করুন।' তৎকালীন সিপিআইএম নেতা ও রাষ্ট্রমন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ অভয় দিয়েছিলেন সুন্দরবনে পুনর্বাসনের বিষয়ে। অশোকবাবু বলেছিলেন, আমাদের ডাক এলেই আপনারা পশ্চিমবাংলায় চলে আসবেন। বঞ্চনার শেষে বাংলার বুকে আশ্রয় পাবেন, এই আশায় হাজার হাজার উদ্বাস্তু পরিবার কয়েকদিনে উপস্থিত হলেন মরিচঝাঁপিতে। দেখা দিল জল ও খাদ্যের সংকট। সময়টা  24 জানুয়ারি, 1979 পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার পুলিশ পাঠিয়ে অবরুদ্ধ করে মরিচঝাঁপি, খাবারের অভাবে একসময় গাছের পাতা চিবোতে থাকেন অভুক্ত মানুষ। লবণাক্ত যদুঘাসকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন "জ্যোতি পালং'। সত্যই যেন এই বুভুক্ষু মানুষগুলোর সঙ্গে নিষ্ঠুর ঠাট্টা করছিলেন "উদ্বাস্তু আন্দোলন'-এর নেতা, সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী। 

     

    আরও পড়ুন: নয়া নাগরিকত্ব আইন আদৌ বাস্তবায়িত হবে?

     

    শক্তিশালী শাসকের নির্মিত ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রয়োজন হয় নথি। এক্ষেত্রে "উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতি'-র প্রচারপত্র চাপা পড়ে থাকা ইতিহাসের সাক্ষ্য। প্রচার পত্রের পাতা থেকে: "পুলিশের লঞ্চ দিনরাত আমাদের চারিদিকে টহল দিয়ে ফিরছে। খাদ্যের অভাবের তাড়নায় মানুষ গাছের পাতা চিবিয়ে খাচ্ছে। ওই অবরোধের ফলে ইতিমধ্যে অনাহারে 81 জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। সরকারের বক্তব্য দণ্ডকারণ্যে ফেরত না গেলে আমাদের না খাইয়ে শুকিয়ে মারা হবে।'  কেবল অনাহারে রেখেই ক্ষান্ত হয়নি শাসক, মেয়েদের জল আনার নৌকা ডুবিয়ে দেয়, বর্ষণ করে টিয়ার গ্যাস। 30 তারিখ পুলিশ এসে জানতে চায়, উদ্বাস্তুরা দণ্ডকারণ্য ফেরত যাবে কিনা। সমবেত প্রতিবাদে নদীপাড় থেকে আওয়াজ ওঠে, "আমরা জান দেব, কিন্তু দণ্ডকারণ্য যাবো না।' শুরু হয় পুলিশি তৎপরতা। 31 তারিখ সকাল থেকে গ্রাম ঘিরে ফেলে গুলি চলে, চলে টিয়ার গ্যাস। এভাবেই জ্যোতি বসু সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে উদ্বাস্তুদের প্রতি। 

     

     

    বামফ্রন্ট শাসনকাল অতীত, কিন্তু ছাইচাপা আগুন হয়ে ধিকধিক জ্বলে চলেছে মরিচঝাঁপি। বছর বছর মরিচঝাঁপি গণহত্যা দিবস পালন করে বিজেপি। হিন্দুত্বে ভর করে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিতে, ভোটব্যাংক বৃদ্ধির আশায়। আর এ কারণেই প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসের পাঠ।  রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের লিখন, হিন্দুত্ববাদের দৃষ্টিকোণকে মোকাবিলা করতে যা সাহায্য করবে। বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও হেড লাইনে স্থান পাচ্ছে উদ্বাস্তু, শরনার্থী ইস্যু। আজও প্রশ্নটা নিন্মবর্ণের বঞ্চনার। সংখ্যালঘু, প্রান্তিক মানুষের বিপন্নতার।

     


    রাতুল গুহ  - এর অন্যান্য লেখা


    এপ্রিলে দেশের বেকারত্বের হার ছুঁলো 7.83 শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে সংকট ক্রমশ উর্ধ্বমুখী 

    রেলস্টেশনের চাতালে লকডাউনে স্কুলছুট কিশোরী রুকুর জীবন যেন সভ্যতার প্রদীপের তলার পোড়া পিলসূজ।

    বন্ধু বা আস্থাভাজন সঙ্গীর দ্বারা ধর্ষণের প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে ক্রমবর্ধমান হচ্ছে ভারতের সমাজজীবনে।

    রাজস্থানের করৌলিতে দাঙ্গা পরিস্থিতি, দেশে সর্বত্র হিন্দুত্ববাদের ঘৃণার রাজনীতি চলছে।

    সাম্প্রতিক ইউক্রেন সংকট তুলে ধরল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতকেই। 

    কাজের জগতে ইংরেজির বিকল্প নেই এই সত্যি কথাটা মানতে না পেরে সোশাল মিডিয়ায় ক্ষেপে উঠল সেন্টিমেন্টাল আত

    মরিচঝাঁপি: গণহত্যার কাহিনি এখন সাম্প্রদায়িক মলাটে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested