সেই মধ্যযুগ থেকেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শাসক যত নিষ্ঠুর আচরণ করেই থাকুন না কেন, তাকে মনোরঞ্জন হিসাবে দেখা হয়। ইতালির কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই কিংবা হাল আমলে দেশের ‘হিন্দু বীর’দের বিধর্মীকে দিয়ে জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো— জনসাধারণের একটা বড় অংশ এ সবকে নিছক আমোদ হিসেবেই দেখেছে।
এই যেমন, ভোট পরবর্তী বাংলায় বিজেপি থেকে যারা তৃণমূলে ফিরছেন, তাদের অনেককেই মস্তক মুণ্ডন করে বা গঙ্গাজলে শুদ্ধ হয়ে পূর্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে৷ পাপটা হচ্ছে, তাঁরা একটি দল করতেন, ঘটনাচক্রে যে দলটি শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ে গো-হারান হেরেছে। তাই তৃণমূলে ফিরতে হলে তাদের পাপমোচন করে, আত্মশুদ্ধ হয়ে ফিরতে হবে! কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার প্রকাশ্যে, নেতামন্ত্রীদের উপস্থিতিতে এই সব দলবদলুদের সারা শরীরে স্যানিটাইজার স্প্রে করে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও এমন কার্যের সম্ভাব্য কারণটি খোঁজা খুব শক্ত কাজ নয়। আমরা আণুবীক্ষণিক ভাইরাস তাড়াতে স্যানিটাইজার ব্যবহার করি। তেমনই এখানে দৃশ্যমান ভাইরাস হল একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ। তাই স্যানিটাইজার বা গঙ্গাজল দিয়ে সেই মতাদর্শকে প্রতীকী অর্থে মুছে ফেলার বার্তা দেওয়া হচ্ছে!
আরও পড়ুন: পূর্ব ভারতে কি ‘দলবদলু'ই ভরসা বিজেপির?
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম এই সব দেখে শুনে একদল মানুষ ভারী উল্লসিত। এদের মধ্যে শাসক তৃণমূলের সভ্য-সমর্থক যেমন আছেন, তেমনই আছেন কিছু ‘অরাজনৈতিক’ মানুষও, যাদের কাছে এই সব ব্যাপার এতটাই গা সওয়া হয়ে গেছে যে, তারা এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছুই দেখছেন না। ভাবখানা এমন, যেন এ সব তো হওয়ারই ছিল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসক একটু বীরত্বপূর্ণ কাজ করবে না?
হিন্দুশাস্ত্রে পিতা-মাতার শ্রাদ্ধে সন্তানদের মস্তক মুণ্ডন করার প্রথা আছে৷ সেখানে অশৌচ অবস্থার অবসানে যাবতীয় অপবিত্রতা দূর করতে সন্তান মাথা কামিয়ে ফেলেন। অবশ্য মনুস্মৃতি অনুযায়ী শূদ্ররা ব্রাহ্মণদের প্রতি আনুগত্যস্বরূপ প্রতি মাসেই একবার করে মস্তক মুণ্ডন করবে। সেখানকার 5/140 শ্লোকে বলা হচ্ছে, ‘ব্রাহ্মণের শুশ্রূষাপরায়ণ শূদ্র প্রতি মাসে কেশ মুণ্ডন করবে।’ অতএব, নিছক প্রাচীন দেশাচার নয়, এর মধ্যে একটা বর্ণবৈষম্যও আছে বৈকি।
আরও পড়ুন: বেশি রগড়ালে চোখ লাল হবে যে!
আর পড়ে রইল স্যানিটাইজেশন। মতাদর্শ সংক্রামক হয়, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে সংক্রামিত হয়। কোনও মতাদর্শই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, সুস্থ গণতন্ত্রে তার পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকবেই। একটি দল, তাদের মতাদর্শ— যতই সমালোচনার বিষয় হোক না কেন, তা কখনওই ভাইরাস-তুল্য নয়! বলশালী শাসক বিরুদ্ধ স্বরকে ভাইরাস হিসাবে দাগিয়ে দিলে, তা গণতন্ত্রের জন্য খুব ভাল বিজ্ঞাপন হবে না। বিরোধী মত যখন জনতার আদালতে সাময়িকভাবে পরাস্ত হয়েছে, তখন তাদের আরও বেশি বেশি করে বলতে দেওয়ার মধ্যেই শাসকের মহত্ত্ব। শাসক যুক্তি দিয়ে, মূল্যবোধ দিয়ে বিপক্ষের মতামতকে খণ্ডন করবে। কিন্তু ভিন্ন মতাদর্শের অনুশীলনকে পাপাচরণ মনে করে ‘স্যানিটাইজ’ করার ঔদ্ধত্য দেখাবে না। আজকের শাসক কালচক্রের নিয়মে আগামীতে বিরোধী হতেই পারে। তখন যদি মতাদর্শ বহন করার দায়ে, তাকে মুণ্ডিত মস্তকে পাপস্খালন করতে হয়, আজকের শাসকের কি ভাল লাগবে?
স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস পদ্মফুল আর লেজার শো দিয়ে তারাই ঢাকতে পারে, যারা সেই সংগ্রামের শরিক নয়।
বুলডোজার ব্যবহার করা হচ্ছে সহনশীলতা, বহুত্ববাদের মতো প্রকৃত ভারতীয় সত্তাগুলিকে ধ্বংস করতে।
মানবাধিকার নয়, নাগরিকত্ব প্রদানও নয়, শাসকদলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নটাই মূলকথা।
উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর স্বরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন দুই সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ
মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নারীবিদ্বেষী কদর্য আক্রমণের শিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনৈতিক দলকে দানের নামে আর্থিক অনাচার, অস্বচ্ছতার লজ্জাজনক কাহিনি।