ঠিক যেন দক্ষিণ কলকাতার কোনও প্রভাবশালী নেতার পুজো প্যান্ডেল। থিমে সব ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে আদতে কী প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটাই বোঝা দায়। তবে এ থিম পুজোর প্যান্ডেল নয়, দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান— পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতি উদ্যান। সৌন্দর্যায়নের পোঁচ লাগা জালিয়ানওয়ালাবাগকে দেখলে খানিক থিম পুজোর প্যান্ডেল বলেই ভ্রম হয়।
ইতিহাস বলে 1919 সালের 13 এপ্রিল ব্রিটিশদের কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং এই আইনে সৈফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালের গ্রেপ্তারির বিরোধিতা করে স্থানীয় মানুষজন জালিয়ানওয়ালাবাগে সমবেত হয়েছিল। সেদিন পাঞ্জাবে ছিল বৈশাখি উৎসব। হঠাৎই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার সৈন্যসামন্ত নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢুকে বিনা প্ররোচনায় সমবেত নরনারীর ওপর গুলি চালাতে থাকেন। এই উদ্যানের প্রবেশ পথ এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে, প্রাণ ভয়ে পালাতে চাওয়া বহু মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা যান, কেউ কেউ উদ্যানের মধ্যে থাকা একটা কুয়োয় ঝাঁপ দেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এটি নতুন করে ‘সাজানো’র উদ্যোগ নেয়। সেই সজ্জা যে এমন শোভাবর্ধন করবে, কে জানত! উদ্যানের সরু প্রবেশপথেই বর্শাধারী কিছু ম্যুরাল। তারপর ভিতরের শহীদ কুয়োটাকেও কাঁচের বর্ম দিয়ে ঘেরা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে তার ভিতরে টলটলে স্বচ্ছ জলে পদ্ম ফোটানো হবে। আগে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা যে কুয়ো দেখলে খানিক ভয় ও শ্রদ্ধায় গায়ে শিহরণ খেলে যেত, সেখানে এখন পদ্মের শোভা দেখা যাবে। এ ছাড়াও রাতের আকর্ষণ হিসাবে থাকছে লেজার শো। ডায়ার-বাহিনী গুলির যে দাগগুলো রেখে গিয়েছিল, তা এতকাল সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। এখন সেগুলিকেও মেরামত করে ফেলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: দেশভাগের খণ্ডিত ইতিহাস বিজেপির নতুন হাতিয়ার
সারা বিশ্ব স্তম্ভিত এই কাজে। তবু প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারের তরফে হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার যে সুনির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি আছে, তা যেমন তাঁরা স্বীকার করেন না, তেমনই ইতিহাসের গুরুত্বকেই অস্বীকার করেন। এই যেমন খাস দিল্লিতে জাতীয় সংগ্রহশালার অ্যানেক্স বিল্ডিংকে ভেঙে প্রাসাদোপম সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি করা হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী শাসকদের এই হল গিয়ে একটা মুশলিল। তাঁরা নিজেরা শিক্ষার কদর করেন না, কিংবা তাঁদের সমর্থকদের একটা বড় অংশ একধরনের বিকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হন। তাই সস্তা চমকদারির রাজনীতি করতে গিয়ে দক্ষিণপন্থী শাসকরা বোঝেন না, কোথায় তাঁদের থামা উচিত। ইতিহাস স্থানে অস্থানে পলেস্তরা খসায়, রক্তে ভেজায় মাটিকে— রঙ, সিমেন্ট দিয়ে কি তাকে ঢেকে ফেলা যায়? জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানকে কি শাসক এক ইতিহাস বিচ্যুত প্রেমোদ্যান বানাতে চান, যেখানে প্রবেশ করলে দর্শকের আর ভয়, সম্ভ্রম জাগবে না, রোম্যান্টিসিজম জাগবে?
হননের ইতিহাস মুছে ফেলার এক অদম্য চেষ্টা এক শ্রেণীর শাসকের থাকে। কখনও অবশ্য সাধারণ মানুষই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতিহাসের ভুলগুলো সংশোধন করে নেয়। যেমন বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে এক করেছিল সাধারণ মানুষই। কিন্তু সুপরিকল্পিত ভাবে ইতিহাসের ক্ষতকে ঢাকা দেওয়া যায় না। ভারতবর্ষের বর্তমান শাসক বিজেপি এবং তাদের ছত্রধর সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবিশেষ অবদান ছিল না। সেই কারণেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় স্মারক, সৌধ, স্মৃতিকে বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে নয়া ঐতিহাসিক আখ্যান তৈরি করতে চায় তারা? জার্মানির হলোকস্ট মিউজিয়াম এখনও বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় আমাদের। তেমনই জালিয়ানওয়ালাবাগও মনে করায় দেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামকে। পূর্বসুরীদের রক্তাক্ত বুকে পদ্মফুল ফোটাতে কি কোনও উত্তরাধিকারের ভাল লাগে?
পরিকাঠামো নেই, নেই মেধার যাচাইও, চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেবে কে?
‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চের ‘রাজনৈতিক’ পোস্টারে বিজেপিকে রোখার ডাক।
গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সীমান্ত দ্বৈরথ কেন এমন রক্তক্ষয়ী মল্লযুদ্ধের চেহারা নিল, তার ময়নাতদন্তে..
তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?
বাংলায় বেহাল বিজেপির মোহ কাটতেই তৃণমূলে ফিরছেন নব্যরা, বিমুখ আদিরাও, মহাসংকটে রাজ্য বিজেপি
স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস পদ্মফুল আর লেজার শো দিয়ে তারাই ঢাকতে পারে, যারা সেই সংগ্রামের শরিক নয়।