×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শববাহিনী নদীবক্ষে গুরুদেব ও মহাত্মা

    বিতান ঘোষ | 01-06-2021

    প্রতীকী ছবি

    দু'জনেই প্রায় সমসাময়িক। দু'জনেই খানিক প্রকাশ্য, খানিক উচ্চকিত আয়োজন-অনুষ্ঠানে মূর্ত, আর বেশিরভাগটাই প্রহেলিকায় ঢাকা। তবু তো তাঁরা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা দুই নক্ষত্র। একবিংশ শতাব্দীর এত বড় বিপর্যয়ে খানিক খেয়ালবশেই যদি ফিরিয়ে আনা যেত তাঁদের? তাঁদের দিয়ে গাইয়ে নেওয়া যেত দুখজাগানিয়া গান? তাঁদের লাঠিতে ভর দিয়ে যদি পেরিয়ে যাওয়া যেত সম্প্রীতির ওই দোদুল্যমান সাঁকোটা?

     

     

    সন 2021, 1428 বঙ্গাব্দ। শান্তিনিকেতনে হাজির মহাত্মা গান্ধী। দেশ, বিশ্বের এত বড় বিপর্যয়ে গুরুদেবের কাছে কিছু পরামর্শ চাইতে এসেছেন। উঠেছেন তাঁর প্রিয় শ্যামলী গৃহে। চিন্তিত মুখে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দুই মেধা জরুরি আলোচনায় বসলেন। ঋজু দেহের কবি, ন্যুব্জ মহাত্মার তুলনায় একটু উঁচুতে বসে। কিন্তু কবিমানস বড় অস্থির। নদীপথে এত মৃতের ভিড় তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাণাধিক প্রিয় মানুষকে একে একে হারিয়েও কবি এতটা মুহ্যমান হননি। অক্লেশে লিখেতে পেরেছেন, "সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর।' তবে কি মৃত্যুর ভয়াবহতা তাঁর কাছে এতটাও প্রকট হয়নি এতকাল? চিন্তার জাল ছিঁড়ে নীরবতা ভাঙলেন মহাত্মাই। বললেন, "কী বুঝছেন গুরুদেব? এত বড় ভুলটা হল কোথায়?'

     

    গুরুদেব সময় নিলেন। তারপর স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন, "ভুল! ভুল তো আগাগোড়াই। মহাত্মা, আধুনিক নেশন স্টেট সমাজজীবনে কতটা মূল্যহীন আমরা দু'জনেই কিন্তু সেটা অনেক আগে বুঝেছিলাম।'

     

    আরও পড়ুন: মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা: বিশ একুশে মনুসংহিতা

     

    মহাত্মা হতাশ হয়ে বললেন, "বুঝেও কি বোঝাতে পারলাম দেশবাসীকে?'

     

    রবীন্দ্রনাথ বললেন, "না পারিনি। সেখানে বড় ভুল হয়ে গেছে আমাদের। এই দেশে আপনাকে আমাকে নিয়ে এত আয়োজন, এত আড়ম্বর। অথচ কেউ আমার স্বদেশী সমাজ’ কিংবা আপনার ‘হিন্দ স্বরাজের’ পাতাগুলো পর্যন্ত উলটে দেখল না।'

     

    মহাত্মা বললেন, "বড় কষ্ট হচ্ছে দেশবাসীর এই কষ্ট দেখে। আমরা এখন সূক্ষ্মলোকে আছি। আর হয়তো আগের মতো পথের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারব না। ঘুমন্ত রাষ্ট্রশক্তির বিবেককে জাগাতে পারব না।'

     

    "যারা জেগে ঘুমোয়, তাদের জাগানো খুব মুশকিল, মহাত্মা', গুরুদেব বললেন। আরও বললেন, আপনি বলেছিলেন স্বয়ংশাসিত গ্রামসমাজের কথা, আর আমি জোর দিয়েছিলাম আত্মশক্তির ওপর। ওসব নেশন স্টেট, সরকার দিয়ে যে এদেশের সমাজে হিতকর কিছু হবে না, তা তো আমরা আগেই বুঝেছিলাম। আমাদের সমাজে যে শক্তি রয়েছে, তাকে অস্বীকার করে আমরা পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, উগ্র জাতীয়তাবাদে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছি দেশবাসীকে। তাঁরই তো পরিণতি এসব।'

     

    মহাত্মা হেসে বললেন, "অথচ এই দেশে আমাদের পরিচয়খানা আদ্যোপান্ত জাতীয়তাবাদী হিসাবেই। এত লোক সামান্য অক্সিজেন, ওষুধের অভাবে কাতরাচ্ছে, আর জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র কেমন হিরণ্ময় নীরবতা নিয়ে বসে রয়েছে, দেখেছেন?'

     

    রবীন্দ্রনাথ বললেন, "এটাই তো উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সীমাবদ্ধতা। ওদের চোখের ঘৃণার আগুন নিষ্প্রভ, নেই কোনও স্বপ্নরাজ্য গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। ওদের হাতে বশীভূত ভারতীয় সমাজ আজ বড় অসহায়। এই সমাজ আত্মশক্তির জাগরণে মনোনিবেশ করেনি। রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করেছে, তার প্রতি অনুগত থেকেছে।'

     

    গান্ধী বললেন, "গুরুদেব যদি কিছু মনে না করেন, তবে বলি, আপনি স্বদেশি সমাজ প্রবন্ধে সমাজগঠনে একজন মসীহার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বীররসের স্তবগীতি আমাদের কী দিল বলতে পারেন?'

     

    আরও পড়ুন: সময়কে শ্বাস বন্ধ করে মারা যাবে না

     

    গুরুদেব বললেন, "স্বীকার করি, সেটা আমার ভুল পর্যবেক্ষণ ছিল। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই এই দেশ, এই সমাজকে বাঁচাতে পারে। একক ব্যক্তির প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা জ্ঞাপন এই দেশের অনেক ক্ষতি করে দিল। এবার এর থেকে বেরোনোর সময় হয়েছে।'

     

    মহাত্মা বললেন, "কী ভীরুতা চারদিকে। দেশের সেবকরা মহামারীর ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকছেন। আমি অসুস্থ শরীরেও বাংলার দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে ঘুরেছি, আপনি সভ্যতার সংকটে আপনার আশঙ্কার কথা লিখে গেছেন।'

     

    রবীন্দ্রনাথ বললেন, "বড় হতাশ লাগে মহাত্মা। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে ক্লেদ রক্ত মাখছি দু'জনে, আর ওরা এসে আপনার আমার মূর্তিতে মালা দিয়ে যাচ্ছে। তাও ভাল আপনি আমার মতো অত গান কবিতা লেখেননি। না হলে ষোড়শপচারে পর্যায়ক্রমে সেগুলো শুনিয়ে অবস্থা খারাপ করে দিত।'

     

    মহাত্মা বললেন, "এতে কি আপনি ক্ষুণ্ণ হন গুরুদেব?'

     

    গুরুদেব বললেন, "আগে হতাম না, এখন হই। আমার সৃষ্টির বাণীকে রাজনেতারা হৃদয়ঙ্গম করলেন না, সস্তার চমক হিসাবে ব্যবহার করলেন। আপনাকেও টাকার নোট আর কিছু সরকারি প্রকল্পে বাঁচিয়ে রাখা হল। এ কি যন্ত্রণার নয়?'

     

    মহাত্মার মরমে প্রবেশ করল গুরুদেবের বলা কথাগুলো। তিনি অস্ফুটে বললেন, "আমাদের থেকে আমাদের ছায়াগুলো আজ অনেক বড় হয়ে গেছে গুরুদেব। সেই ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে কিছু ভন্ড দেশপ্রেমিক। যে জাতিভেদ, ধর্মভেদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ে এলাম, এরা সেই ভেদের রাজনীতিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অবশ্য আপনার মানসলোকে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ যে এমনই ভয়ঙ্কর আকার নেবে কালক্রমে, তার ইঙ্গিত ছিলই। তবু, এই দেশটার এমন বিয়োগান্তক পরিণতি বোধহয় হওয়ার কথা ছিল না। গুরুদেব, আমার প্রিয় সবরমতীর জলেও মৃতদেহ ভাসছে। আমি ওই নিথর ভারতবর্ষের সঙ্গে একটু ভাসতে চাই। আপনি আসবেন আমার সঙ্গে?'

     

     

    গুরুদেব চললেন প্রিয় মহাত্মার সঙ্গে বৈঠা নাড়তে নাড়তে। চারদিকের দৃশ্য দেখে চোখের জল বাধ মানল না মহাত্মার। বললেন, "গুরুদেব কীভাবে সামলাই নিজেকে? আপনার মতো মৃত্যু, বিচ্ছেদকে এত কাছ থেকে আমি কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। আপনি বারবার করেছেন। আমায় শান্ত করুন।' গুরুদেব বললেন, "আজ আমার কোনও সৃষ্টি দিয়ে নয়, আমার প্রিয় বন্ধু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটা গান শোনাই আপনাকে। হয়তো আপনার আবেগরুদ্ধ মন চোখের জলে শান্ত হবে।'

     

    মৃতদেহগুচ্ছের পাশেপাশে নৌকা ভেসে চলে। গুরুদেব গাইতে থাকেন, "আমরা এমনি এসে ভেসে যাই। আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুমগন্ধ রাশির মতন...হওয়ার মতন, নেশার মতন...ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই...।'


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    তোমার শিল্প নেই, সংস্কৃতিও ঘুচতে বসেছে, ভদ্রজন, তাই কি তোমার এই কৌলীন্য রাখার দায়?

    দুর্গাপুজোয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রচারে মত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালির ঈদ নিয়ে আপত্তি ঠিক কোথায়?

    রাজনীতির বল্গাহীন লাটাই কাটাকুটি খেলে গেল, ভো-কাট্টা হল আমাদের ছেলেরা।

    জীবনের সকল অন্ধকারে ভালবাসা আর মমত্বের রোদ্দুর পড়ুক, ক্রান্তিকালে এ'টুকুই তো প্রার্থনা।

    বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই অধোগমনে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিতই হতেন।

    রাজনৈতিক দলকে দানের নামে আর্থিক অনাচার, অস্বচ্ছতার লজ্জাজনক কাহিনি।

    শববাহিনী নদীবক্ষে গুরুদেব ও মহাত্মা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested