×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • স্বর্গীয় কণ্ঠে শাসকেরই তাল!

    বিতান ঘোষ | 09-02-2022

    কোকিল-কন্ঠে রাষ্ট্রেরই সুর!

    উপমহাদেশের অনন্য একটি কন্ঠস্বর। একটি সদ্য স্বাধীন, আগোছালো দেশের কর্মচঞ্চল কর্কশ ধ্বনিসমষ্টির মাঝে তাঁর কোমল স্বরেই জীবনের সুর খুঁজে পেয়েছে জনতা। তিনি লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। যাঁর গান প্রায় সাত দশক ধরে মাতিয়ে রেখেছে উপমহাদেশের অগণন মানুষকে। তাঁর মৃত্যুতে শোকবিহ্বল সারা দেশ, তাঁকে নিয়ে অতীতচারণের পথে হেঁটেছেন সমাজের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মানুষজন। সেই স্মৃতিচারণের সঙ্গী হয়েছে কিছু কালজয়ী গান, যে সমস্ত গানে এখনও মাতোয়ারা হয় আসমুদ্রহিমাচল



    কিন্তু সাংগীতিক সত্তার বাইরে কেমন ছিলেন জন-গণ-মনের সুর-সম্রাজ্ঞী? তাঁর নির্বিকল্প সুরধ্বনির বাইরে দেশের বিবিধ বিষয়ে তাঁর মনোভাব, অবস্থান কি বিন্দুমাত্র রেখাপাত করত না ভারতের জনমানসের ওপর?



    লতা সেই সংস্কারি ভারতবর্ষের জন্য গান গাইতেন, যে ভারতবর্ষ অখণ্ড জাতীয়তাবাদকে যাবতীয় আঞ্চলিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে জানে। লতার আগে ভারতের মহিলা সঙ্গীতশিল্পীদের মন্দ্রিত, জলদগম্ভীর স্বরধ্বনির বিশেষ কদর ছিল। লতা সেই চিরায়ত ছক ভাঙলেন। তাঁর সূক্ষ, সুরেলা কন্ঠস্বর যেমন হয়ে গেল লতার ট্রেডমার্ক, তেমনই বলিউডি প্লে-ব্যাকেও দ্রুত উঠে আসতে থাকলেন লতা-কন্ঠীরা। লতা হয়ে গেলেন এমন এক কাল্টচরিত্র, যিনি এই দেশের জাতীয় ঐক্য ও স্বাভিমান’-এর মূর্ত প্রতীক। স্মরণে রাখতে হবে, প্রায় একই সময়ে কেরিয়ার শুরু করা লতা-ভগিনী আশা ভোঁসলেকে (Asha Bhonsle) দিয়ে সঙ্গীত পরিচালকরা যখন ক্যাবারে গান গাওয়াচ্ছেন, তখন লতাকে সচেতন ভাবেই প্রেমের গান, দুঃখের গান কিংবা ভক্তিগীতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে



    লতা শুধু সংস্কারি ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রতীকই ছিলেন না, ছিলেন মরাঠা জাতীয়তাবাদেরও অন্যতম ধারক ও বাহক। লতা তাঁর বহু আলাপচারিতায় ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও শ্রদ্ধার বিষয়টি লুকোননি। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে, মরাঠি জাতীয়তাবাদের আইকন শিবাজী কিছুটা তত্ত্বগত ভাবে, আর ঊনবিংশ শতকে চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয়ের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ যে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পত্তন ঠিক সেই জায়গা থেকেই হয়েছিল। বাল গঙ্গাধর তিলকরা সেই ধারাকে অনুসরণ করেই স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসেন। এমনকি সংঘের আঁতুড়ঘর নাগপুরেও প্রথম চার দশক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন মহারাষ্ট্রের চিতপাবন ব্রাহ্মণরা



    লতা তাঁর সাঙ্গীতিক সত্তার বাইরে সচেতন ভাবেই সেই সত্তাকে ধরে রেখেছেন। প্রকাশ্যে জানিয়েছেন তিনি সাভারকর ও তাঁর চিন্তার প্রতি অনুরক্ত। এই দেশে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদী জাগরণের অন্যতম অনুঘটক হিসাবে কাজ করে এসেছে বরাবর। আর ক্রিকেট-অনুরাগী হিসাবে লতাকেও বারবার ভারতের জয় নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ক্রিকেটারদের মধ্যে আর এক মরাঠি আইকন সচিন তেন্ডুলকরের প্রতি তাঁর যে একটা আলাদা পক্ষপাত ছিল, লতা তা কখনও লুকোতে চাননি



    এ কথাও অনেকের স্মরণে থাকবে যে, অধুনা দেশের শাসকদল বিজেপির সঙ্গে সুরের রাণী’-র ঘনিষ্ঠতা সেই আটের দশক থেকেই। লালকৃষ্ণ আডবানীর রামরথে যে ভজন বাজত, তা-ও লতারই গাওয়া। আডবানীর অনুরোধেই লতা এই গান রেকর্ড করেছিলেন। এমন নয় যে লতা সম্পূর্ণ রাজনীতি-রহিত হয়ে নিছক পেশাদার শিল্পী হিসাবে এই কাজগুলো করেছেন। আসলে লতা বিশ্বাস করতেন এই ভারতবর্ষের ওপর, যেখানে ধর্মকেন্দ্রিকতা আছে, সংস্কারবোধ আছে। লতা যখন অ্যায় মেরে ওয়াতন গেয়ে দর্শকদের কাঁদাচ্ছেন, তখনও তাঁর মাথায় অবগুন্ঠন, লাল পাড় সাদা রঙের শাড়ি



    ঠিক হোক বা ভুল, তাঁর এই মূল্যবোধের প্রতি শেষদিন পর্যন্ত লতার অটল বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি টুলকিট বিতর্কে ভারতের সার্বভৌমত্বের ভঙ্গুরতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। দেশের অন্যান্য সেলেবদের মতোই তাঁর ট্যুইট-বার্তায় হুবহু একই পঙক্তিতে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ ধরা পড়েছিল। দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের প্রতিও তিনি খুব বেশি সদয় হননি। শেষের দিকে অবশ্য একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই দেশটা যেভাবে বিভিন্ন ক্ষুদ্র পরিচয়সত্তায় বিভক্ত হয়ে পড়ছে, তাতে তিনি ব্যথিত

     

    আরও পড়ুন: ‘এক’ নয়, অনেক ভারতই ‘শ্রেষ্ঠ’ ভারত


    ভাবীকাল যখন লতার মূল্যায়ন করবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই মূল্যায়নে তাঁর কন্ঠ, গান মুখ্য ভূমিকা নেবে। কিন্তু দেশের সুর-সম্রাজ্ঞীর রাষ্ট্রচিন্তা, চলমান নানা বিষয়ে মনোভাবও ভবিষ্যতের মূল্যায়নের পাতায় এক পাদটীকা হিসাবে থেকে যাবেই। লতার লগ জা গলে শুনে যেমন প্রেমিক হৃদয় হিল্লোলিত হবে, তেমনই একবার বিদায় দে মা শুনে চোখের জল ফেলবে জনতা। অলক্ষ্যে লতা থাকবেন, থাকবে তাঁর চিন্তাও। তাঁর খানিক রক্ষণশীল চিন্তার সমর্থক বা সমালোচক কিছু না হয়েও, বোঝা যাবে দেশের সনাতনী সংস্কৃতির প্রতি এক নবতিপর প্রতিভার প্রশ্নহীন আনুগত্য

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।

    বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।

    শ্যামাপ্রসাদ ‘সাম্প্রদায়িকতা' নামক রোগে আক্রান্ত হলে, সেই রোগের উৎস খুঁজে সেটা নির্মূল করতে হবে।

    এককালের নবজাগরিত কলকাতার বহু অন্তর্জলি যাত্রা দেখা নন-এসি মেট্রোর বিদায় হল গীতাপাঠের মাধ্যমে!

    বামপন্থার পুনরুত্থান, নাকি জনপ্রিয়তাবাদের হাত ধরে নব্য নাৎসি দমন; রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত কী?

    ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চের ‘রাজনৈতিক’ পোস্টারে বিজেপিকে রোখার ডাক।

    স্বর্গীয় কণ্ঠে শাসকেরই তাল!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested