×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দুধে এক ফোঁটা চোনা নয়, পুরোটাই গোমূত্র

    বিতান ঘোষ | 24-03-2021

    স্বাধীনতার 75 বছর উপলক্ষে, কেন্দ্রের শাসকদলের তরফে আয়োজিত অমৃত মহোৎসব নিয়েই দেখা গিয়েছে বিতর্ক।

     

    এ এক অদ্ভুত ভোজবাজি। সুকুমারী উইট ধার করলে বলতে হয় রুমালের বিড়াল হওয়ার ঘটনা। কিংবা রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে; এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি।' 2022 সালে দেশের স্বাধীনতা 75 বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। আমাদের আড়ম্বরপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এই উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করতে চান। তার জন্য তিনি 2022 অবধি অপেক্ষা করতে নারাজ। সবকিছু ঠিকঠাক চললে 2021-এর আগস্ট মাসের মধ্যেই এই উদযাপন-পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। এই বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানের পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে অমৃত মহোৎসব

     



    আমাদের প্রধানমন্ত্রী জীবনে অনেক অসাধ্য করেছেন। তাঁর সমর্থকদের অন্তত তেমনটাই দাবি। কিন্তু যে কাজে তিনি ব্রতী হতে চলেছেন, তা তাঁর এবং তাঁর দলের কাছে একটু দুঃসাধ্যই বটে। তাঁরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভূমিকাকে বড় করে দেখাতে চাইছেন। ইতিহাসের অলিগলি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে অবশ্য তারা বুঝেছেন, বাঘের মাথায় সিং গজালেও, সংঘ কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামী হবে না! অগত্যা অমৃত মহোৎসবের বিষয়বস্তু ঠিক করা হয়েছে পরিবর্তিত ভারতকে। যে ভারত স্বাধীনতার লড়াই লড়ল, যে ভারত নামক বহুত্ববাদী ধারণা অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে চলল ভারতবাসীর মরমে, সেই সবকিছুকে অস্বীকার করে আনা হচ্ছে, বদলে যাওয়া ভারতকে। ইতিহাসের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে প্রধানমন্ত্রীর মনে আত্মরতির ভাব জন্মায়নি। তাই তিনি এই মুখটাকেই বদলে ফেলার চেষ্টা করছেন। যাতে কেউ সংঘের আসল মুখটাকে ধরতে না পারে।

     



    সম্প্রতি কেন্দ্রের শাসকদলের এক সাংসদ বলেছেন, সংঘের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রথম সরসংঘচালক কেশব বলীরাম হেডগাওয়ার নাকি মস্ত মাপের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেনতিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলে নাকি আন্দোলনটাই দানা বাঁধত না। দীর্ঘদিন সংঘকে নিয়ে চর্চা করা লেখক, ঐতিহাসিক সামসুল ইসলাম একে ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতিবলে অভিহিত করছেন। এটা ঠিক যে হেডগাওয়ার অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, এমনকি একটা সময় পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসও করেছেন। সে কথা বলতে গেলে দেখা যাবে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালব্যও একসময় কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেওয়া হলে হেডগাওয়ার সাভারকরের হিন্দুত্বের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। 1925 সালে প্রতিষ্ঠা করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। তারপর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী যাবতীয় আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন হেডগাওয়ার। উলটে 1930-এ গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ না দেওয়ার জন্য সংঘের সদস্যদের প্ররোচিত করেন তিনি।

     



    আর এক সরসংঘচালক এমএস গোলওয়ারকরের বর্ণনায় উঠে আসে আর এক ভয়ঙ্কর তথ্য। 1930-32 সালে যখন দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন চলছে, তখন প্রতীকী আইন ভঙ্গ করে একদল ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কারাবন্দি হতে চাইলেন। তাঁরা সংঘকেও অনুরোধ করলেন, সংঘ যাতে দেশের স্বাধীনতার জন্য এই আন্দোলনে সামিল হয়। হেডগাওয়ার সেই ব্যক্তিদের প্রশ্ন করলেন, আপনারা জেলে গেলে আপনাদের পরিবার খাবে কী?’ জনৈক ব্যক্তি বললেন, ‘পরিবার যাতে বছর দু'য়েক খেতে-পরতে পারে, সেই ব্যবস্থা তিনি করে এসেছেন।' হেডগাওয়ার দেখলেন সুবর্ণ সুযোগ। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব পাড়লেন, ‘দেশের জন্য যদি কাজ করতে চান, তাহলে খামোকা জেলে না গিয়ে সংঘের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করুন।' তারপরেও অবশ্য হেডগাওয়ার ব্যক্তিগত উদোগেই আইন অমান্য আন্দোলনে সামিল হয়ে কারাবন্দি হন। এর পিছনেও সংঘের এক নোংরা, সংকীর্ণ রাজনীতির অঙ্ক কাজ করেছিল। গোলওয়ারকরের কথায়, ‘জেলে থাকাকালীন হেডগাওয়ার বহু স্বদেশপ্রেমী, সাহসী যুবককে সংঘের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে, তাঁদের সংঘের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।'

     



    হেডগাওয়ার বড় স্বাধীনতা সংগ্রামী— এই তত্ত্বের আর এক বড় প্রচারক ছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন 1999 সালের 18 মার্চ তিনি হেডগাওয়ারের নামে একটা ডাকটিকিট প্রকাশ করে বলেন, ‘হেডগাওয়ারের স্বদেশপ্রেম অতুলনীয়।' ইতিহাসের সাক্ষ্য বলে খোদ বাজপেয়ীর স্বদেশপ্রেমও তুলনাহীন! বাজপেয়ী তাঁর জন্মস্থান, উত্তরপ্রদেশের আগ্রা জেলার বটেশ্বর গ্রামে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে একটি ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ মিছিলে অংশগ্রহণ করার অভিযোগে তাঁকেও গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ ওঠে, গ্রেপ্তারি এড়ানোর জন্য তিনি সাভারকরের মতোই ব্রিটিশ-রাজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করার শর্তে ছাড়া পান। আরও অভিযোগ ওঠে, ছাড়া পেয়েই তিনি শর্ত মোতাবেক কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামপরিচয় প্রকাশ করে দেন।
     

     


    1942-এর আন্দোলনেও সংঘ ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিবকে চিঠি লিখে বিদ্রোহ দমনে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সরকারের পক্ষে থাকার জন্য বোম্বের প্রাদেশিক সরকার সংঘের ভূয়সী প্রশংসা করে। এই সময় বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর মন্বন্তর দেখা দিলে, গোলওয়ারকর লেখেন জনগণের কৃতকর্মের জন্যই এই মন্বন্তর। তাঁর কথায়, এই বিষয়ে ব্রিটিশদের দোষারোপ করা অনুচিত। আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল, নিজেকে দুর্বল দেখিয়ে সবলের ওপর দোষ চাপানো। এটা ঠিক নয়।' বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এই সময় বাংলার অর্থমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে মন্বন্তরের সময়েও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

     



    1920 সালের পর গান্ধীর নেতৃত্বে যখন ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে গোটা ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেই সময়ও হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কিংবা মুসলিম লিগের মতো সংগঠনগুলি দেশের আগে নিজেদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটিয়েছে। অন্য ধর্মের মানুষকে শায়েস্তা করতে ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝোতা করেছে৷ এই ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী ঢাকবেন কীভাবে? এই প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী, অতীতে বিজেপির জোটসঙ্গী উদ্ধব ঠাকরের খোঁচা, ‘কথায় কথায় ভারত মাতা কি জয় বললেই বিজেপিকে কেউ দেশপ্রেমিক ভেবে নেবে না। কারণ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস আর তার রাজনৈতিক আউটফিট বিজেপি নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশের পক্ষে ছিল।' অনুরূপ মন্তব্য সামসুল ইসলামেরও। তাঁর মতে, ‘নিজেদের হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সংঘ, মহাসভা ভারতকে বহু ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল।' ঐতিহাসিক সুগত বসু যেমন বলছিলেন, ‘বিজেপি এতই দেশপ্রেমিক দল যে, তাদের মন্ত্রণাদাতা সংঘ দীর্ঘসময় ধরে তাদের সদর দফতরে জাতীয় পতাকা না লাগিয়ে নিজেদের পতাকা রাষ্ট্রীয় ধ্বজ লাগাত।'

     

     

    প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল এত গরল কোন অমৃতে ঢাকবেন? এ তো বালতি ধরা দুধে কয়েক ফোঁটা গোরুর চোনা নয়, এ যে বালতি ভরাই গোমূত্র! আর অতীতের ভারতকে মুছে তাঁরা কোন পরিবর্তিত ভারতের কথা তুলে ধরবেন? যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে শুধু ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে একটা মানুষ খুন হয়ে যেতে পারেন? যে উদানৈতিক গণতন্ত্রের ভারতে শুধু রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে কেউ বছরের পর বছর জেলবন্দি থাকেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যদি একটু লজ্জিত হতেন, একটু ইতিহাস পড়তেন! শাসক ইতিহাস পড়লে ভুলের পুনরাবৃত্তি কম হলেও হতে পারে।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    এইসব মানুষগুলোর সুরাহা করে দিতে দেশের ‘অর্থমন্ত্রী' নামক এক চরিত্র তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেবেন বলছেন।

    বহু সঙ্কটেও মানুষকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়ে গেল 2020।

    এত দলের এত খেলায় পাবলিকের দমবন্ধ না হয়ে আসে!

    সন্তানের বাবার নাম জানতে সমাজের যতই নোলা ছকছক করুক, মা তা জানাতে বাধ্য নন।

    সঙ্গীতের মহাকাশে ধ্রুবক হয়েই থাকবেন সন্ধ্যা-তারা।

    করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমে আসলে দু'টো মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হচ্ছে।

    দুধে এক ফোঁটা চোনা নয়, পুরোটাই গোমূত্র-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested