বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তাঁর নয়া এক তত্ত্বে আবার রাজনৈতিক আসর জমিয়ে দিয়েছেন। এবারে তাঁর তত্ত্বের বিষয়বস্তু বারমুডা! তাঁর অভিযোগ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভাগুলোতে তাঁর ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা বাঁ পা জনসমক্ষে তুলে ধরে অন্যদের অবমাননা করছেন। এরপর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁর ‘সদুপদেশ’, পা যদি দেখাতেই হয় ভাল করে দেখানো উচিত, প্রয়োজনে শাড়ির বদলে বারমুডা পরা উচিত!
দিলীপ ঘোষ বিজেপির দলবদলু কোনও নেতা নন। তিনি আদ্যোপান্ত সংঘের শিক্ষায় শিক্ষিত, সংঘ অনুগত স্বয়ংসেবক। সংঘ ঘনিষ্ঠতার প্রশ্নে তিনি রাজ্য বিজেপির অনেক তাবড় তাবড় নেতাকে বলে বলে গোল গোল দিতে পারেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর ঈষৎ গর্বও আছে। বহুবার তিনি সর্বসমক্ষে বলেছেন, তিনি রাজনীতিক নন, তাঁর নাকি পদের কোনও লোভও নেই। তাই, তিনি শুধু সংঘের দেওয়া দায়িত্বটুকু পালন করতে চান। সংঘ বললে সক্রিয় রাজনীতিকে বিদায় জানাতেও তিনি প্রস্তুত। এ হেন দিলীপবাবুর ‘বারমুডা তত্ত্ব’ মোটেই হেলাফেলার বিষয় নয়। সে যতই আমরা তাঁর বিবিধ বক্তব্য নিয়ে হাসি মশকরা করি না কেন, মাথায় রাখতে হবে দিলীপবাবু সংঘের নির্দেশ ছাড়া এক পা’ও বাড়ান না।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে সংঘের অভ্যন্তরীণ ধাঁচাটার কথা— নাগপুর যতটুকু প্রকাশ্যে এনেছে। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, সংঘের চিন্তাভাবনা একটা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলেই আবদ্ধ। এই ট্রায়াঙ্গল বা ত্রিভুজের একদিকে রয়েছে অনুশাসন, আর একদিকে প্রাচীন বর্ণাশ্রম, অন্যদিকে তীব্র নারীবিদ্বেষ। অনুশাসন সংঘের এক অন্যতম জোরের জায়গা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ও উন্মত্ত, বিশৃঙ্খল জনতাকে বাগে আনতে স্বয়ংসেবকদের মুখে বারংবার শোনা গিয়েছিল, ‘অনুশাসিত হও’ লব্জটা। আর একদিকে রইল বর্ণাশ্রম। স্মরণে রাখতে হবে, সংঘ কিন্তু সম্প্রদায়গত বিভাজন বা ধর্ম নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। তাদের ভাবনা চিন্তার মূলে পরবর্তী বৈদিক যুগের বর্ণাশ্রম প্রথা। সংঘ মনে করে ভারতে একটাই জাতি। আর তাদের সকলেই হিন্দু। সংঘ মুসলমান কিংবা অন্যান্য অ-হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। আর পড়ে রইল নারীবিদ্বেষ। সংঘের সরসংঘচালক গুরু গোলওয়ারকর মনে করতেন, ‘পুরুষকে সুখ দেওয়ার মধ্যেই নারীর যাবতীয় মোক্ষ।' বর্ণভেদ প্রথায় বিশ্বাসী গোলওয়ারকরের নিদান ছিল, ‘শূদ্র নারীকে কুমারিত্বের পরীক্ষায় ব্রাহ্মণ পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে হবে। সেক্ষেত্রে সেই নারীর প্রথম সন্তান ব্রহ্মগুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারবে।'
দিলীপবাবু প্রমাণ করলেন সংঘ এখনও তাদের এই ট্রায়াঙ্গল থেকে বেরোতে পারেনি। দিলীপবাবুর কথা শুনে আমরা হাসি, শহুরে কসমোপলিটান আবহে, আমাদের নবজাগরণ সমৃদ্ধ চেতনা দিলীপবাবুদের এসব কথাকে আমল দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। তাতে অবশ্য সংঘ এবং তার একনিষ্ঠ স্বয়ংসেবকদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের কর্তব্যে অবিচল, বরাবরের মতোই। তীব্র পুরুষকারের পূজারি সংঘ তাই সমাজ জীবনের যে কোনও পরিসর থেকেই মেয়েদের টেনে নামাতে চায়। সেই মেয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেও তাদের কুছ পরোয়া নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন ক্রেপ ব্যান্ডেজ পরে তাঁর বাঁ পা’টাকে একটা উঁচু জায়গায় তুলে রাখেন, তা এতদিনে আমরা সকলেই জেনে গেছি। এই ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, একজন ব্যক্তিমানুষ হিসাবে নিজের সুবিধার্থে তাঁর একটি পা-কে উঁচুতে তুলে রাখার অধিকার আছে। সংঘের আদর্শের বিরোধী বলে আর লিঙ্গপরিচয়ে একজন মহিলা বলেই দিলীপবাবু তাঁর অবমাননা করতে পারেন না।
অনেকে অবশ্য ব্যঙ্গ করে বলছেন, দিলীপবাবুরা বহুকাল সংঘের শাখায় খাঁকি হাফপ্যান্ট পরেই অনুশীলন করতেন। ইদানীং, তাদের পরনের হাফপ্যান্ট ফুলপ্যান্ট হয়েছে। তাই, দিলীপবাবুরাই ভাল জানবেন কী পরলে পা’টা বেশি ভাল দেখানো যাবে! অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীরও যদি ইচ্ছা হয়, তিনি অন্যদের পা দেখাবেন, নিশ্চিতভাবে তিনিও বারমুডা পরতে পারেন। তার জন্য দিলীপবাবুর সদুপদেশের প্রয়োজন বোধহয় তাঁর নেই।
ফেমিনিজম বা নারীবাদের ধারণা জন্ম নিয়েছিল সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিকে কেন্দ্র করে। আমরা যারা নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী সিমোন দ্য বোভেয়ার কিংবা ভার্জিনিয়া উলফের রচনা পড়েছি, তারা তো জেনেছি কত কঠিন তপস্যায় মেয়েরা পুরুষ শাসিত রাজনৈতিক পরিসরে ঢুকতে পেরেছে। মমতা একজন রাজনীতিক, তাঁর এবং তাঁর দলের পক্ষে বিপক্ষে মত আছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মমতা বর্তমানে দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, পাশাপাশি দেশের অন্যতম বিরোধী মুখ। স্বয়ংসেবক দিলীপবাবুরা যে তাঁকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করবেন, সেটাও স্বাভাবিক। এই আক্রমণের কারণ কিন্তু শুধু রাজনৈতিক ভিন্নতা নয়, নারী আপন ভাগ্য নিজেই জয় করছে— সংঘ এটা কখনও দেখতে চায় না। নিজের ঘরের অন্দরেও দেখতে চায় না, বাইরেও দেখতে চায় না। তাই, এই একবিংশ শতকেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলেই আটকে আছে দিলীপবাবুদের চিন্তা ভাবনা।
শীতের ফুটিফাটা শরীরেও প্রেম আসে, আসে দ্রোহও, শাসক তাই বসন্তকে ভয় পায়।
লাল ফিতের ফাঁসে রুদ্ধ আমলাতন্ত্রের মুক্তির নামে বাংলায় এখন চলছে আসলে ব্যক্তির একক শাসন।
সংবিধান দিবসের স্মরণ: নাগরিকের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র এই নথি।
এতকাল ভুল করত বিরোধী দল, পড়শি রাষ্ট্র, অবশেষে তিনিও ‘ভুল’ করলেন, তা স্বীকারও করলেন!
সেনেগালকে সারা বিশ্ব চিনত বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, ক্ষুধাপীড়িত দেশ বলে
বাংলায় বেহাল বিজেপির মোহ কাটতেই তৃণমূলে ফিরছেন নব্যরা, বিমুখ আদিরাও, মহাসংকটে রাজ্য বিজেপি