×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ভালবাসার রোদ্দুর

    বিতান ঘোষ | 15-02-2022

    সংগৃহীত ছবি


    বস্তিটায় আলো ঢোকেনি দীর্ঘদিন। হুকিং করে নীল বাক্সওয়ালা টিভিতে মারাদোনার খেলে দেখতে গিয়ে গেলবার হারানের দু'টো ছেলেই মরে গেল। শহরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই বস্তিতে মূলত ওপার বাংলার উদ্বাস্তু ও তাদের উত্তরসূরীরা থাকেন। সবেধন নীলমণি একটিই কলঘরের প্রবেশাধিকার নিয়ে কিংবা এক ঘরের ময়লা অন্য ঘরে ফেলা নিয়ে এখানেই প্রায়ই নানা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে থাকে। এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে বিবেক নিজেকে জড়ায় না। তার মনে পড়ে থাকে পুব বাংলার সেই গাঁয়ে যেখানে তার প্রথম রুবিনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। যেখানে তারা একসঙ্গে বসে জীবনানন্দের কবিতা পড়ত। রক্ষণশীল পরিবারের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে দু'জনে একসঙ্গে ঘর বাঁধবে বলে মনস্থির করেছিল। কিন্তু কুটিল রাজনীতির আবর্তে হারিয়ে গেল তাদের কৈশোরের প্রেম। বাবার সঙ্গে যেদিন লোটাকম্বল হাতে মেঘনার চর ডিঙিয়ে এপারে চলে এসেছিল, সেদিন রুবিনার সঙ্গে শেষ দেখা আর হয়নি। রুবিনা নতুন দেশ পেয়েছিল, তার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আর বিবেক পেয়েছিল নতুন বসতি, নতুন বন্ধু, নতুন সাকিন। 1947-এ বাবা দাদুরা পুরনো আস্তানা ছেড়ে এপারে আসতে চায়নি। পাড়ার রফিকুর কাকুরা বিবেকের দাদু শ্যামলকান্তিকে বলেছিল, ""কীসের ভয় শ্যামল? দিল্লি আর ইসলামাবাদ ওপর থেকে যাই চাপিয়ে দিক, আমরা কি কখনও একে অপরকে ভেন্ন ভেবেছি?'' বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার অন্ধকার ভেদ করে সেদিন কোথাও কোথাও রোদ্দুর উঠেছিল, মানবতার রোদ্দুর।



    বিবেক কৈশোর বয়সে যখন এই নতুন দেশে এল, তখন শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হচ্ছে, "নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ'বিবেক দেখেছিল, গোঁফের রেখা গজানো বন্ধুদের স্কুল-কলেজ ছাড়তে। প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু সোমেশকে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল, এসব করে কী হবে। সোমেশ প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ""বিপ্লব হবে।'' বিবেকের নাছোড়বান্দা মন বলল সেটা কীভাবে হবে আর হয়েই বা কী হবে। বিবেকের স্পষ্ট মনে আছে, সোমেশ বলেছিল, ''রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের স্যাঙাতদের খতম করতে না পারলে তোর আমার এই দারিদ্র ঘুচবে না।'' বিবেক ভাবল এই শহরে কী প্রেম নেই, খালি বিপ্লব আর বিদ্রোহ? এই শহরের ঊষর প্রান্তরে কি প্রেমের গোলাপ ফোটে না? ভেবেছিল এইসব কৌতূহল সে নিবৃত্ত করবে সোমেশকে প্রশ্ন করেই। সোমেশের প্রতি সে একটা আলাদা আকর্ষণ অনুভব করত। এ কি নিষিদ্ধ কোনও প্রেম বা অনুরাগের হাতছানি, বিবেকের অবুঝ মন এসব বুঝত না। কিন্তু একটি ছিন্নমূল হওয়া কৈশোর জীবনের নিকষ অন্ধকারে কিছু সময়ের জন্য রোদ্দুর উঠতে দেখেছিল। সোমেশের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা কম বলত বিবেক, এতকিছু সে বুঝতও না। নতুন দেশ, নতুন আদবকায়দা, সবকিছু হৃদয়ঙ্গম করতেও তো সময় লাগবে। ভেবেছিল সোমেশের থেকেই অল্প অল্প করে সবটা জেনে নেবে সে। কিন্তু সোমেশ একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। পুলিশে ডায়েরি হল, নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনও বেরোল, কিন্তু সোমেশ আর ফিরল না। বিবেকের জীবনে সহসা উঁকি দেওয়া রোদ্দুর নিমেষেই কালো মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে পড়ল।

     

    আরও পড়ুন:স্বর্গীয় কণ্ঠে শাসকেরই তাল!



    বিবেক কলেজের গণ্ডি টপকাল। দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। জুতোর সুখতলা খইয়েও চাকরি জোটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিবেককে। বিবেক খুব মেধাবী না হলেও নিজ পরিশ্রমের গুণে সে স্কুল কলেজে বরাবর ভাল ফলাফল করে এসেছে৷ সে জানত, এত বড় দেশে, এত লোকের ভিড়ে সামান্য গ্রাসাচ্ছাদন করতে হলেও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। উদ্বাস্তু বস্তি ছেড়ে বাবা মা'কে নিয়ে উঠে যেতে হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে, আর একটু ভাল জায়গায়। সোমেশের স্বপ্নের শরিক বিবেক কোনওদিন হয়নি, তবে সোমেশকে নিয়ে তার বয়ঃসন্ধিতে থাকা মন অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। সে সব মনে পড়লে এই বৃদ্ধ বয়সে তার এখনও হাসি পায়।



    জীবন থেমে থাকেনি, সে চলেছে আপন গতিতে। জীবন একদিন অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছিল বিবেকের জীবন থেকে। কেড়ে নিয়েছিল তার জন্মভিটে, তাঁর কৈশোরের বন্ধুত্ব, কৈশোরের প্রথম অনুরাগ সবকিছুকে। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই সময় সবকিছু ফিরিয়ে দিয়ে গেছে বিবেককে। কর্মসূত্রে যখন সে পূর্ত দফতরের বড় চাকুরে, তখনই বিবেক আবিষ্কার করে রুবিনাকে। মুখে সময়ের বলিরেখা, কিন্তু চোখগুলো এখনও সেই কিশোরবেলার মতোই অন্তর্ভেদী, যেন গোটা মনটাকে পড়ে নিতে পারে ওই চোখ দু'টো দিয়ে। রুবিনার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আওয়ামি লিগ করত, পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে রুবিনার বাবা মারা যায়। রুবিনা আর রুবিনার মা প্রাণভয়ে পালিয়ে আসে এই দেশে। শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম। এত মুক্তমনা, প্রগতিশীল একটা শহরেও আস্তানা খুঁজে পেতে বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল রুবিনাদের। রুবিনাও এখন পূর্ত দফতরের কর্মী, বদলি হয়ে যে অফিসে থিতু হয়েছে, সেখানে তাঁর ঊর্ধ্বতন বিবেক, কৈশোরের সেই বিবেকানন্দ ভৌমিক।



    কথায় কথায় বেলা বয়, সময়ও এগিয়ে চলে নিজস্ব গতিতে। রুবিনা এই দেশে এসে আর ঘর বাঁধেনি। দৈব দুর্বিপাকে বারংবার ঘর বদলাতে বদলাতে সে-ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল৷ তাছাড়া দেশের মাটিটা রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, রুবিনার মনে বিবেকের জন্য যে অখণ্ড মানবজমিন ছিল, তা তো কোনও রাজনৈতিক ফলা দিয়েই কর্ষণ করা যায়নি। বিবেকও সব অপ্রাপ্তির জ্বালা জুড়োতে অকৃতদার থেকে গিয়েছিল। রুবিনার মা গত হয়েছেন কিছু বছর আগে, বিবেকের বাবা মা-ও দু'মাসের ব্যবধানে মারা গেলেন এক বছর আগে। কলকাতার এক সুউচ্চ আবাসনে এখন রুবিনা আর বিবেক থাকে। দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত, সত্তরোর্ধ্ব বয়স। এই বয়সেই তো একে অপরকে আরও বেশি করে কাছে পেতে ইচ্ছা হয়। রুবিনার বাতের ব্যথা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় বিবেকানন্দ ভৌমিক, আর তার প্রস্টেট নিয়ে চিন্তায় থাকে রুবিনা। ওদের আবাসনে পুব দিকের জানলাটা সকালবেলা খুললেই আলো এসে পড়ে ভিতরে। প্রভাতি রোদ্দুরে ভিজে গিয়ে চা খায় ওরা৷ দু'জন। এই রোদ্দুর কীসের রোদ্দুর, মানুষের সহজাত প্রেম ও মানবতার নয় কি?



    রুবিনা কথায় কথায় একদিন আবদার করে, বিবেকের পুরনো বস্তিটা একদিন দেখে আসবে। ক্যাব বুক করে বিবেক সেখানে তাকে নিয়ে যায়। বস্তিটা এখন অনেক উন্নত হয়ে গেছে, পানীয় জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে, দাতব্য চিকিৎসালয় হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া হয়েছে। শুধু অভাব ছিল একটা প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রের। বিবেক আর রুবিনার চেষ্টায় সেখানে এখন গড়ে উঠেছে, "সোমেশচন্দ্র স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়'বস্তিতে এখন রোদ্দুর উঠছে, শিক্ষার রোদ্দুর, চেতনার রোদ্দুর। বিবেক ছাড়া জগতের কেউ জানে না, এই রোদ্দুর ভালবাসারও বটে, গোপন, গহীন এক ভালবাসার।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    কাজ দেয় না সরকার, চাকরি হবে কীসে?

    বামেদের শহীদ বেদীর সংখ্যা কমা আর তৃণমূলের ক্রমবর্দ্ধমান 'শহীদ স্মরণ’ সমানুপাতিক!

    এই দ্বীপভূমি ডুবলে ক্ষমতা ও আভিজাত্যের সাতমহলাও সুরক্ষিত থাকবে না।

    প্রতিস্পর্ধা-সঞ্জাত, স্বাতন্ত্রমন্ডিত আলোকবর্তিকাই 2022-এর অন্ধকার দিকগুলোয় আলো ফেলবে।

    শুধুই কি উন্মাদনা, জনারণ্য আর আবেগ? মানুষের রুজিরুটিও তো এসব মেঠো সভা সমাবেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল

    শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।

    ভালবাসার রোদ্দুর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested