×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ধ্বংসের মাঝে করোনা ভুলেছেন মানুষ!

    রজত কর্মকার | 26-05-2020

    নিজস্ব ছবি

    21 মে বৃহস্পতিবার, ভোর সাড়ে পাঁচটা

    গোটা রাতের তাণ্ডবের পর সকাল সকাল বাইরে বেরিয়েছিলাম। গলিতে বেরিয়েই চোখ গেল সামনের বাড়ির আমগাছটায়। হাওয়ার দাপটে হেলে পড়েছে বিদ্যুতের তারের উপর। গাছের ধাক্কায় ভেঙেছে পাঁচিল, গেটের উপরের শেড। প্রত্যেক বছর নিয়ম করে ভদ্রলোক বাড়িতে গাছের আম পাঠাতেন। সামনের বছর থেকে সে নিয়ম পাল্টে যাবে। একটু সামনে চোখ রাখতেই ধ্বংসের আরও চিহ্ন দেখা গেল।

     

    খানিকটা কাজের তাগিদেই মুখে মাস্ক পরে হাতে মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ধ্বংসের ছবি-ভিডিও ক্যামেরাবন্দি করছিলাম। ঝড়ের ভয়াবহতা কত ছিল, তার প্রমাণ জড়ো করে রাখছিলাম। কতক্ষণ সময় লাগতে পারে? বড়জোর 1-2 ঘণ্টার ব্যাপার। পায়ে হেঁটে গোটা অঞ্চলের সামান্য কিছু অংশের ছবি তুলতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা লেগে গেল! তা-ও পুরোটা শেষ করা গেল না। ভাঙাচোরা পরিবেশে বহু মানুষের উপস্থিতি, তাঁদের কণ্ঠস্বর থাকলেও আলাদা করে সে সব কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। ধ্বংসের আবহে বাতাস ভারী হয়ে ছিল।

     

     

    ছেঁড়া তার আর ভাঙা গাছের জাল সরিয়ে হাঁটতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। পুরনো দেওয়াল চাপা পড়ে স্থানীয় দুই ঝুপড়িবাসীর মৃত্যুর খবর পেয়ে সেখানে ছুটেছিলাম। ভিডিও তুলতে গিয়ে রীতিমতো বাধা পেতে হল। স্থানীয় কিছু মাতব্বর, এলাকার কঙ্কালসার চেহারা দেখাতে খুব একটা রাজি ছিল না। তাদের সঙ্গে খানিক বচসাও হল। কিছু মিথ্যের আশ্রয়ও নিতে হল। কিন্তু কাজ না করে ফেরার প্রশ্ন ছিল না। রিজেন্ট পার্ক থানার ঢিলছোঁড়া দূরত্বেই দুর্ঘটনাস্থল। কিন্তু কোনও উর্দিধারী চোখে পড়েনি। না পড়েছে পুলিশ লাইনে ঘিরে রাখা পিষে যাওয়া ঝুপড়িটা। বোধ হয় আইনের রক্ষকরা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কারণ এ অঞ্চলের ‘অভিভাবকরা’ যথেষ্ট সক্রিয়। তারাই ‘ম্যানেজ’ করে নেবে গোটা ব্যাপার।

     

    এখানেই দেওয়াল চাপা পড়ে দু'জনের মৃত্যু হয়

     

    সকাল সাড়ে দশটা

    বাড়িতে ফিরতেই মনে পড়ল, পানীয় জল জোগাড় করতে হবে। বিদ্যুৎ যে দিন দু’য়েক থাকবে না তা পরিস্থিতি দেখেই আঁচ করেছিলাম। জল খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা অবস্থা। কোনও দোকানেই বড় জলের জার নেই। বাড়িতে ছ’জন মানুষ রয়েছেন। একদিনে নিদেনপক্ষে 12-14 লিটার জলের ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু জল কোথায়? ঝড়ের কারণে সে দিন সকাল থেকেই সমস্ত পরিষেবা বন্ধ ছিল। দুধ নেই, ডিম নেই, জল নেই, পাউরুটি নেই, সংবাদপত্র নেই...। যত সময় গড়াল, ততই নেই-এর তালিকা দীর্ঘতর হল। বাইক নিয়ে গোটা এলাকার যতটা যাওয়া সম্ভব গেলাম। অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও 10 লিটারের বেশি পানীয় জল সংগ্রহ করা গেল না। সমস্ত জায়গায় হাহাকার।

     

    বেলা সাড়ে বারোটা

    স্থানীয়দের সঙ্গে ভেঙে পড়া গাছ সরাতে সাহায্য করতে রাস্তায় বেরোলাম। দুর্যোগ কেটে যাওয়ার 12 ঘণ্টা পরেও না প্রশাসন, না উদ্ধারকারী কোনও দল, না বিদ্যুৎ বিভাগের কোনও কর্মী চোখে পড়েছে। যতটা সম্ভব রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে গাছের বড় বড় ডালপালা সরিয়ে দিলেন স্থানীয় অধিবাসীরাই। কিন্তু যেখানে বনস্পতি উপড়ে গিয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আরও অন্য কোনও উপায় ছিল না। মেট্রো লাইনের পাশেই কয়েক শ’ বছরের পুরনো একটি অশ্বত্থ গাছ ভেঙে টালি নালায় পড়ে ছিল, সঙ্গে ছেলেবেলার বেশ কিছু স্মৃতিও। আমপানের হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে। সেই গাছের কিছু ডাল মেট্রোর লাইনের উপরও পড়েছিল।

     

     

    সন্ধে সাতটা

    বিকেলের পর থেকেই বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিসে খোঁজ খবর করা হচ্ছিল। তাঁরা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আজ বিদ্যুৎ ফেরার কোনও আশা নেই। পানীয় জলের সমস্যা সাময়িক মিটলেও বাকি সমস্ত কাজের জল অমিল। বিদ্যুৎ না ফিরলে জলের আশাও নেই।

     

    22 মে শুক্রবার, সকাল সাড়ে ছ’টা

    কলকাতা পুরসভার নির্ঘণ্ট মেনে জল এল। অন্তত কিছুটা হলেও স্বস্তি। বালতি হাতে বিভিন্ন রাস্তার পাশে পুরসভার লাগানো টাইম কলে লাইন পড়ল। ধনী-দরিদ্র কোনও ভেদ নেই। ঝড়ের দাপটে সে সব ঘুচে গিয়েছে। সকাল থেকেই গাছ কাটানোর লোক খুঁজতে হিড়িক পড়ে গেল। গাছ ছোটখাটো হলে কাটানোর লোক কোনও ক্রমে মিলে গেল। কিন্তু তাতে সমস্যা বিশেষ মিটল না। মূলত বড় রাস্তায় যে সব বিরাট বিরাট গাছ পড়েছিল, তা না কাটানো পর্যন্ত বিদ্যুৎ ফেরার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেগুলি কাটার জন্য বড় যন্ত্রের প্রয়োজন।

     

    23 মে শনিবার, সকাল আটটা

    রোদের তাপের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার পরিস্থিতিও ক্রমশ উত্তপ্ত হল। বিদ্যুৎ-পানীয় জল না পেয়ে বহু মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেন। আশপাশের অঞ্চল থেকে রাস্তা অবরোধ করার খবরও কানে আসছিল। কোথাও আবার স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে ক্লাবে বসিয়ে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ। শর্ত ছিল, সিইএসসি-র গাড়ি এলে তবে নিষ্কৃতি মিলবে। কিন্তু তাতেও পরস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

     

    24 মে রবিবার, সকাল দশটা

    বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্মীরা কাজে আসেন। তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকেন এলাকার মানুষ। টানা কাজ করার ফলে ক্লান্তির ছাপ কর্মীদের চোখে-মুখে। চড়া রোদে ক্রমাগত কাজ করে অনেককেই অসুস্থ মনে হল। কিন্তু মানুষের তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। সে সব কিছুই আর তাদের চোখে পড়ছে না। সারা দিন কাজ করার পর সন্ধে সাতটায় বিদ্যুৎ ফিরল। একরাশ উল্লাসে এলাকা মুখরিত হয়ে উঠল। তার সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই জলের পাম্প চালানোর শব্দ।

     

    চার দিন ধরে রাস্তায় প্রায় বহু ক্ষণ কাটানোর সুবাদে একটা জিনিস লক্ষ করেছি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব মানুষকে অত্যন্ত ডেসপারেট করে তোলে। ঠিকই তো, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ আর কীই বা করবে! মৃত্যুভয়ও সেখানে অতি নগন্য। না হলে এত বড় একটা মহামারীর কথা ভুলে কোনও রকম মাস্ক বা রুমাল ছাড়া দিনের পর দিন রাস্তায় মানুষ বের হলেন কী ভাবে? চায়ের দোকান বিদ্যুৎ নিয়ে চর্চায় সরগরম হয়ে ওঠে কী ভাবে? আসলে এটা বোধহয় মনস্তত্ত্ব। হঠাৎ কোনও বিপর্যয় বড়সড় মহামারীকেও ভুলিয়ে দিতে পারে। আমপান সেটা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিল। করোনা আক্রান্তের তালিকায় ভারত এখন দশ নম্বরে। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যু রেকর্ড গড়ছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিনপ্রতি গড়ে হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাত হাজার ছুঁইছুঁই। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।

     

    পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরছেন। এটা যথেষ্ট সুখবর। বাস-ট্রেন-বিমান পরিষেবা ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। এটাও অনেকের কাছে স্বস্তির। কিন্তু করোনা সেই স্বস্তিকে অস্বস্তিতে পরিণত করছে। শহর এবং জেলার বেশ কিছু জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ-জল অমিল। সেখানে করোনার ভয়ে মানুষ গুটিয়ে নেই। কিন্তু করোনাও ক্রমশ ডালপালা ছড়াচ্ছে। যথেষ্ট সাবধান না হলে জল এবং বিদ্যুৎ চাইতে গিয়ে অনেকেই করোনা চেয়ে বসতে পারেন। অন্তত এইটুকু মাথায় রাখুন।


    রজত কর্মকার - এর অন্যান্য লেখা


    পোশাক এবং গড়ন দেখে যে কেউ একবাক্যে বলবেন, মধ্য বয়সি এই ভদ্রলোক আফগানিস্তানের বাসিন্দা।

    যারা গণধর্ষণে অভিযুক্ত, যারা দু’ জন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল, তারা জামিন পায় কী ভাবে?

    করোনার কালো গ্রাসে এ বছর সবই গিয়েছে। না রয়েছে বিক্রেতাদের পসার, না হয়েছে মেলা, বাতিল হয়েছে বাউল গান

    গরুর পেছনে গ্লাস নিয়ে ঘোরা মহাপুরুষদের মুখে বাণী নেই। কষ্টে প্রাণটা ফেটে যাচ্ছে।

    দেশের প্রধান সেবকের অনুগামীর সঙ্গে এমন চরম বালখিল্য আচরণ মানা যায়?

    অভিনেতাদের ক্রিটিকদের প্রশংসাতেই সুখী থাকতে হয়। ইরফান সেই প্রবাদের মুখে ঝামা ঘসেছিলেন।

    ধ্বংসের মাঝে করোনা ভুলেছেন মানুষ!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested