শিয়াল ধোপাখানার নীলজলে পড়ে গেলে তবু তার গা থেকে নীল রঙ উঠতে সময় লাগে। রাজনীতিকদের সেটুকু সময়ও লাগে না। পূর্বকৃত কাজের সকল দায় থেকে তাঁরা যেন অক্লেশে মুক্ত হয়ে যান। যেন ভোটে জিততে পারলে অতীতের সাত খুন নিঃশেষে মাফ। ভাবখানা এমন যে, ‘কবে কোথায় কী করেছিলেম, মনে রেখো না।'
এনআরসি-র হয়ে সোচ্চার হওয়া, সংখ্যালঘু তরুণকে তার ‘নিজের দেশ’ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, নিজের লোকসভা কেন্দ্র আসানসোলের জাতিদাঙ্গায় পরোক্ষে মদত দেওয়া বাবুল সুপ্রিয় খাস কলকাতার বিধানসভা নির্বাচনে জিতলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দলের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ প্রার্থী হয়ে জিতলেন। বালিগঞ্জের মতো মিশ্র এলাকায় গত বিধানসভা ও পুরসভা নির্বাচনের নিরিখে তাঁর ভোট বেশ কিছুটা কমল। বোঝা গেল সংখ্যালঘুরা মায় তাঁর দলের চির-নিবেদিত ভোটের একটা বড় অংশও তাঁর বিপক্ষে গেছে। কিন্তু সে সবে তাঁর কুছ পরোয়া নেহি। তিনি স্বমুখেই বহুবার স্বীকার করেছেন, পদ পাননি তাই বিজেপি ছেড়েছেন। অতএব নতুন দলের হয়ে ভোটে জিতে একখানা পদ পেয়ে গেলেই আপাতত মোক্ষলাভ। এরপরেও কোন নাদান তাঁকে সংঘের খাস লোক বলে কে জানে! সংঘের খাস লোক আর যাই হোন, এভাবে পদের মায়ায় এদিক ওদিক করবেন না। বাবুল আদতে সুযোগসন্ধানী। শাসকের চোগা চাপকান চাপিয়ে শাসকসুলভ আচরণ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। চোগা চাপকান একটু ঢিলে হলেই পোশাক নয়, সটান সাজঘর বদলে নেন।
বাবুল সুপ্রিয় বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে বাম প্রার্থী সায়রা হালিমকে হাজার কুড়ি ভোটে পরাস্ত করে জয়যুক্ত হয়েছেন। বাবুলের দল ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী বলে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই দল বিজেপিকে পরাস্ত করেছে। রাজ্যের মধ্যে এই দলের ভোট মেশিনারিকে মোকাবিলা করা বর্তমানে কার্যত অসম্ভব। তাই বিরুদ্ধ স্বর চাপা পড়ে যায় বাবুলের 20 হাজারি জয়ে। কিন্তু ব্যক্তি বাবুল কি পরাজিত-ও হননি এই নির্বাচনে? উপনির্বাচনে ভোট কম পড়েছিল, তবুও ওই কেন্দ্রে তাঁর পূর্বসূরী সুব্রত মুখার্জির প্রাপ্ত ভোটের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি বাবুল। কার্যত তাঁর সৌজন্যেই তাঁর বর্তমান দলের ভোট শতাংশের হার 2009-উত্তর পর্বে প্রথম নিম্নমুখী হল।
বাবুল ও বাবুলের দল কি আত্মানুসন্ধানে মগ্ন হবেন? বাবুলের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, তাঁকে জেতানোই তো জনগণের পবিত্র কর্তব্য ছিল। সেটা জনগণ করেছেন। বাবুল সুপ্রিয় নামটি উচ্চারিত হলেই ইদানীং মনে পড়ে নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লা রশিদির কথা। প্রথমজন যেখানে তাঁর কথায় কাজে হিংসার বীজ রোপণ করেছেন, দ্বিতীয়জন সেখানে শান্তির বারি সঞ্চিত করেছেন। নিজের নাবালক পুত্রকে হত্যার পরেও শান্তির বার্তা দিয়ে, সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে ইমদাদুল রশিদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এটাই গান্ধী-কবীরের ভারতবর্ষ— যে ভারতবর্ষ অনেক সংগ্রাম শেষে, যাবতীয় বিদ্বেষ-হিংসাকে সিন্ধু আর ইছামতীর পাড়ে ফেলে এসেছে বেশ কয়েক দশক আগে। বাবুলের পুরনো দলের যাবতীয় বিদ্বেষ-প্রয়াসের সামনে এক একজন ইমদাদুল দাঁড়িয়ে আছেন ভারতের প্রতিটি মোড় মাথায়।
আমাদের সাবালক গণতন্ত্রের বড় দুর্ভাগ্য এই যে, ইমদাদুল রশিদিরা এই দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ ভাবে স্রেফ সাক্ষীগোপাল হিসাবে অংশ নেন, সক্রিয় ভাবে অংশ নেন না। সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে সাজঘর পালটে জিতে যান বাবুলের মতো বহুরূপীরা। জনাদেশ বাবুলদের বাধ্য করে না দেশের বহুত্ববাদে কুঠারাঘাত করার জন্য নতমস্তকে ক্ষমা চাইতে। অবশ্য বার্তা থাকে, তোমায় আমি পছন্দ করছি না। কিন্তু বার্তা পড়ার ধৈর্য ও সহনশীলতা কি বাবুলদের থাকে? রাজছত্রের তলায় দাঁড়িয়ে এঁরাই তো বিরুদ্ধস্বরকে পিষে দিয়ে গণতন্ত্রের জয়রথকে এগিয়ে নিয়ে যান। আর আমরা সমুদ্র সমান দেশে ডুবতে ডুবতেও গণতন্ত্রের কূল খুঁজে বেড়াই: ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ।'
বিপদের সম্মুখে অসহায় মানুষের আপাত দুর্বল জায়গাগুলো এইভাবেই বুঝি বেআব্রু হয়ে পড়ে।
বহু সঙ্কটেও মানুষকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়ে গেল 2020।
সন্তানের বাবার নাম জানতে সমাজের যতই নোলা ছকছক করুক, মা তা জানাতে বাধ্য নন।
শত্রুকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে গ্রহণ করে সাদা ও কালোর পুনর্মিলন ঘটালেন ডেসমন্ড টুটু।
বেআইনি পথে উপার্জিত বিপুল অর্থের বখরা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি রামপুরহাটের মতো হিংসার পথেই হবে।
বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?