পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি তুলে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন বিজেপির দুই সাংসদ জন বার্লা এবং সৌমিত্র খাঁ। প্রথমজন স্বতন্ত্র উত্তরবঙ্গের দাবি তুলেছেন, অন্যজন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, জঙ্গলমহলকে নিয়ে স্বতন্ত্র রাজ্যের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। দল হিসেবে বিজেপি অবশ্য তাদের দুই সাংসদের বক্তব্য থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। এমন মন্তব্যের জন্য ওই দু'জন দলের অন্দরে ভর্ৎসিত হয়েছেন বলেও খবর। এর আগে রাজ্যে স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে দীর্ঘ দিন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়েছে, কোচবিহার জেলাকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিতে গ্রেটার কোচবিহার এবং মালদা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বৃহৎ উত্তরবঙ্গ এবং অসমের বাঙালি অধ্যুষিত জেলাগুলিকে নিয়ে কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে কামতাপুরী আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে এমন স্বতন্ত্র উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহল রাজ্যের দাবি ওঠেনি।
স্বাধীনতার পর ভারতের রাজ্যগুলির প্রশাসনিক সীমারেখা টানা বেশ দুরূহ একটা কাজ ছিল। গান্ধী সহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা মনে করতেন, রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন দেশের ঐক্যকে আরও মজবুত করতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই দেশভাগ, দেশভাগ উত্তর সাম্প্রদায়িক হিংসা এই ব্যাপারে কংগ্রেস নেতৃত্বকে "ধীরে চলো' নীতি নিতে বাধ্য করে। স্বাধীনতার পর 1948 সালে গণপরিষদ এই ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বিচারপতি এস কে দরের নেতৃত্বে "ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন' তৈরি করে। এই কমিশন সেই সময়ের জন্য রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের পক্ষে মতামত দেয়। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে দক্ষিণ ভারত ক্রমশ হিন্দিভাষী উত্তর ভারতের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে— এটি লক্ষ্য করে নেহরু একটি ভাষাভিত্তিক কমিটি গঠন করলেন। এই কমিটির অবস্থান ছিল, কোনও জায়গায় ভাষাভিত্তিক দাবি জোরালো হলে এবং সেখানে অন্য কোনও ভাষাগোষ্ঠীর কোনও আপত্তি না থাকলে, স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিকে মেনে নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: ভুলে না যাই 25 জুন
ভাষার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাজ্য গঠনের দাবিতে প্রথম সোচ্চার হন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত তেলুগু ভাষাভাষী মানুষরা। তাঁরা মাদ্রাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তেলুগুভাষীদের জন্য স্বতন্ত্র অন্ধ্র রাজ্যের দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছিলেন। ওই কমিটি এই দাবির প্রতি নমনীয় হলেও, মাদ্রাজ শহর কোন এলাকায় পড়বে, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। অন্যদিকে স্বতন্ত্র অন্ধ্রের দাবিতে একের পর এক প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সর্বোপরি গান্ধীবাদী পট্টি শ্রীরামালুর আন্দোলনে, সরকার কার্যত বাধ্য হয়ে 1953-য় স্বাধীন অন্ধ্রপ্রদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেও নেহরু মন থেকে এই বিভাজন মেনে নিতে পারেননি। সখেদে জানিয়েছিলেন, তাঁরা "ভীমরুলের চাকে' ঢিল মেরেছেন। তাই এই প্রবণতাকে ভবিষ্যতে রোখা মুশকিল হবে। নেহরুর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে পরবর্তী দুই দশকে একাধিক নতুন রাজ্য গঠিত হল। মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত পৃথক দু'টি রাজ্য হিসাবে উঠে এল৷ মালয়লমভাষী ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন যুক্ত হয়ে কেরালা স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে মহীশূর থেকে পৃথক হয়ে গেল। এমনকী তেলুগুভাষী হওয়া সত্ত্বেও অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানার জন্ম হল নেহরুর মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পর।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনে জটিল সমস্যা ছিল পঞ্জাবকে নিয়ে। পঞ্জাবের সমস্যাটা নিছক ভাষার সমস্যা ছিল না। একই সঙ্গে এই সমস্যা একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক চেহারা নিল। পাঞ্জাবের শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষরা চাইলেন গুরুমুখী লিপিতে লিখিত পাঞ্জাবি ভাষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজ্য৷ আবার হিন্দিভাষী হিন্দুরা চাইলেন স্বতন্ত্র রাজ্য। পাঞ্জাবের উত্তরে কাংড়া প্রদেশে পাহাড়ি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধল। এইসবের সূত্রে যে শিখ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিল, তাতে নেতৃত্ব দিল যথাক্রমে অকালি দল এবং হিন্দু মহাসভা। ইন্দিরা গান্ধী এই সংকট নিরসনে পাহাড়িভাষী কাংড়া প্রদেশকে হিমাচলপ্রদেশ, হিন্দুপ্রধান পাঞ্জাবের উত্তরাংশকে হরিয়ানা এবং দক্ষিণাংশের শিখ প্রধান পাঞ্জাবকে পাঞ্জাব— এই তিনটি রাজ্যে বিভক্ত করলেন। এতে কিন্তু সমস্যার সুরাহা বিশেষ হয়নি। ইন্দিরা জীবনের শেষদিনেও এই সমস্যার জন্য চরম মূল্য চুকিয়ে গেছেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা-পুত্র রাজীবকেও অনেকটা সময় পাঞ্জাব সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।
ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে, যেখানে নাগরিকের একাধিক পরিচিতিসত্তা বর্তমান, সেখানে খণ্ড জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার আগে যথেষ্ট বিবেচনাবোধ থাকা জরুরি। যে ধৈর্য এবং প্রজ্ঞা নেহরু দেখিয়েছিলেন। তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনে তিনি দায়বদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়ে অহেতুক তাড়াহুড়ো করতে চাননি। ক্রমে সমস্যাটা ভাষার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, রাজ্যে রাজ্যে একাধিক পরিচিতি সত্তার মধ্যে লড়াই বেঁধেছে। এই প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার নেতৃত্বে "বিহারি খেদাও' আন্দোলনের কথা অনেকেরই মনে থাকবে।
যে কোনও সত্তারই বিকাশ ঘটতে সময় লাগে। বিচ্ছিনতাবোধও তৈরি হয় দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহের ঘাত প্রতিঘাতে৷ নিছক প্রণোদনা সাময়িক উত্তেজনাই তৈরি করতে পারে মাত্র, চিরস্থায়ী পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। বিজেপি দাবি করে, তারা ছোট রাজ্যের পক্ষে। কিন্তু স্বতন্ত্র উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল রাজ্যের জন্য তাদের এর আগে সরব হতে দেখা যায়নি। ভোট-রাজনীতির সুবাদে কিছু সময়ের জন্য গোর্খাল্যান্ড কিংবা কামতাপুরী আন্দোলনের পাশে তারা দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু এই ব্যাপারে স্থানীয় মানুষদের সমর্থন তারা কতটা আদায় করতে পেরেছে, তা পরীক্ষিত নয়। বিজেপি বিধানসভা ভোটের আগে এই দাবি তোলেনি। বিজেপির অবশ্য দাবি, তাদের এই দাবি সাধারণ মানুষের বহুদিনের দাবির অনুসারী। সেক্ষেত্রে বিধানসভা ভোটের হিসাবে দেখা যাবে উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে বিজেপির সাফল্য নিরঙ্কুশ নয়। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, মালদা, দুই দিনাজপুরে তৃণমূল যথেষ্ট ভাল ফল করেছে— যারা আগাগোড়া বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে। আবার জঙ্গলমহলের অন্তর্গত ঝাড়গ্রাম জেলা থেকে বিজেপি পুরো সাফ হয়ে গেছে। অতএব, এইখান থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতাবোধ অনেক আগে থেকেই ছিল।
আরও পড়ুন: জরুরি অবস্থা ঘোষিত বা অঘোষিত
উত্তরবঙ্গ বলতে সাধারণভাবে ভাগীরথীর উত্তর দিককে বোঝায়। গোটা উত্তরবঙ্গে একাধিক জাতি উপজাতির মানুষ আছেন, নানা দিক থেকে উত্তরবঙ্গ কোনও সমগোত্রীয় একটা ইউনিট নয়। জঙ্গলমহলের আদিবাসী পরগণাও নানা ভাবে বিভক্ত। তাছাড়া এই ধরনের আন্দোলনের জন্য একটা প্রেক্ষাপট লাগে। এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া কৌম (clan) বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-অতীত সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। নিছক কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ তুলে এমন আন্দোলনকে পুষ্ট করা কার্যত অসম্ভব। তেলেঙ্গানার তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (TRS), কিংবা তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (DMK) এই আন্দোলনগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিগুলির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পেরেছে। অখণ্ড হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলা বিজেপির পক্ষে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মুশকিল। আবার পৃথক রাজ্যের দাবিতে "গোর্খামুক্তির সূর্যশিখা' হয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (GJM)-র মতো জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলাও দেশের শাসক বিজেপির পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে নির্বাচনোত্তর বাংলায় নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে নয়া চমকের ঢেউ তুলতেই বিজেপির দুই "পাগলা জগাই' এমনতর দাবি করছেন। কিন্তু তাঁদের এই সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি বড় কোনও বিভাজনের পথ প্রশস্ত করবে না তো, ভীমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়ার যে ভয় নেহরু পেতেন? ইতিমধ্যেই বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের দাবিতে আদিবাসীদের একাংশ সোচ্চার হয়েছেন। আবার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাবেক মানভূমের বাংলাভাষী বাসিন্দারা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবি তুলেছেন। একবার বিচ্ছিন্নতাবোধের এই আগল খুলে গেলে তাকে বেঁধে রাখা বড় কঠিন। বহুক্ষেত্রেই শিব গড়তে গিয়ে বানর গড়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল।
নারী সুরক্ষায় বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত মোটেই মডেল নয়।
অখ্যাত মফঃস্বলের আরও অখ্যাত নদী বয়ে নিয়ে গেছে পুরনো স্মৃতিদের, তবু উৎসব ফিরিয়ে আনে এদের সকলকে।
ফলাফল যার পক্ষেই যাক, বাংলার সামনে ইতিহাসের হাতছানি স্পষ্ট।
প্যালেস্টাইনে আবারও নরমেধ যজ্ঞে কতটা নজর দিতে পারবে মহামারীতে বিপর্যস্ত দুনিয়া?
খাদ্য, বস্ত্র যখন পয়সা দিয়েই কিনতে হয়, সংবাদ নয় কেন?
শতবর্ষ পরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নয়, আদিত্যনাথের হঠযোগ পড়বে ভারত!