লকডাউনের পর থেকে বাড়ির বাইরে বেরনো অনেকটাই কমে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ঘরবন্দি জীবনে বেশ হাঁপিয়েও উঠি। কিন্তু কী করব, নিজের জন্য না হোক, এক বছরের ছেলের কথা ভেবেই রাস্তায় পা দেওয়ার আগে একশো বার ভাবি। তাই বাজার-হাটে বিশেষ যাওয়া হচ্ছে না। বাড়ির সামনে থেকেই যতটা পারছি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে। ইদানিং বাড়ির গলিতেই হাঁক পেড়ে যান বিভিন্ন ফেরিওয়ালা। কেউ মাছ, কেউ ফল, কেউ সব্জি নিয়ে আসেন। প্রয়োজন মতো গেটের ভেতর থেকেই হাত বাড়িয়ে কিনে নিই।
দিন দু’য়েক হল মাছ প্রায় শেষ। ভাবছিলাম বাজারে এ বার যেতেই হবে। নিজের জন্য না হোক, সন্তানকে তো দিনের পর দিন ডিম বা নিরামিষ খাওয়াতে পারি না। বের হওয়ার তোড়জোড় করছি, তখনই গলির এক প্রান্তে শুনতে পেলাম, ‘মাছ লাগবে? কাতলা, মৌরলা, শোল...।’ হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা! যাক আজকেও বাজারমুখো হতে হবে না। তৎক্ষণাৎ বিক্রেতাকে ডেকে নিলাম বাড়িতে। দরদাম করে মাছ কেনাও হল। বিক্রেতা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা এটা কেটে দেবো তো?’ বললাম, সে তো কাটতেই হবে। বাড়িতে মাছ কাটার মতো বটি নেই। বিক্রেতাও বিনা বাক্য ব্যয়ে সাইকেলের পিছনে বাঁধা বটি নিয়ে মাছ কাটতে বসলেন।
যদিও বটি দেখে ঠিক মাছ কাটার বটি মনে হয়নি। অনভ্যস্ত হাত, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ভদ্রলোককে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। মাস্কে ঢাকা মুখ, চোখে চশমা, হালকা ছাই রঙের জামার হাতা গোটানো প্রায় কনুই পর্যন্ত। পরনের চামড়ার চটি খুব একটা কম দামি নয়, পুরনোও নয়। অনেকদিনের না কাচা ডেনিম জিন্সের দিকেও চোখ গেল। ময়লার আস্তরণ পড়লেও বুঝলাম ব্র্যান্ডেড। সাধারণত বাজার করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যাঁরা প্রতিদিন মাছ বিক্রি করেন, তাঁরা কেউ বাজারে বসার সময় ব্র্যান্ডেড জিন্স পরেন না। একই ব্যক্তি বাড়িতে ফেরি করতে এলেও যে এর ব্যতিক্রম হবে, তেমনটা মনে হয় না।
শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, ‘আপনি আদপে কী করেন? মানে আপনার পেশা কী?’ চোখ তুলে এক পলক তাকিয়েই ফের মাছ কাটায় মন দিলেন তিনি। বললেন, ‘স্যার, আমি নামী কনফেকশনারিজ ব্র্যান্ডের একটি শোরুমের ম্যানেজার। লকডাউনের জেরে কাজ বন্ধ, বেতনও বন্ধ। বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে। কী করব বলুন! ওকে তো আর অভুক্ত রাখতে পারি না। লকডাউনের পর কবে শোরুম খুলবে জানা নেই। আদৌ কাজ থাকবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাই সৎ ভাবেই পরিবারের মুখে ভাত তুলে দিতে হাতে মাছ কাটার বটি তুলে নিয়েছি।’ শেষ ব্যক্যটা বেশ কষ্ট করেই বললেন। বারান্দায় আমার ছেলেও দাঁড়িয়েছিল। ওর দিকেও বার কয়েক তাকালেন ভদ্রলোক। হয়তো নিজের সন্তানকেই দেখলেন আমার ছেলের মধ্যে।
আমরা দু’ জনেই বাবা। আমি চিন্তা করছিলাম সন্তানকে নিরামিষ খাওয়াই কী করে! আর ইনি চিন্তা করছেন সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেবেন কী ভাবে...। নিজেকে ওঁর সামনে খুব অসহায়, ছোট মনে হল। ভাবছিলাম ছবি তুলে রাখব কিনা, পরে ভাবলাম ওঁর সামাজিক পরিচয় তাতে ক্ষুন্ন হতে পারে। উনি অপমানিত হতে পারেন। কারণ এ দেশে সব পেশাকে সম্মানের চোখে দেখার মানসিকতা গড়ে উঠতে আরও কয়েক শতাব্দী লাগবে। নিজের সাধ্যমতো ওঁকে সাহায্যের কথাও বলেছিলাম। উনি সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, ‘দাদা, আপনি আমার থেকে মাছ কিনে অনেক উপকার করলেন। যদি পরেও কেনেন তবে উপকার হবে। আমি এর বেশি কিছু চাই না।’
প্রয়োজন না থাকলেও একটু বেশিই মাছ কিনে ফেললাম। বাবা হিসাবে আর এক সন্তানের জন্য এটুকু তো করা যেতেই পারে।
পেটের জ্বালায় মায়ের বুকে হয়তো একটু আশ্রয় খুঁজছিল শিশু মন।
অসহায় চোখে ওরা দেখছিল আর ভাবছিল, যদি ফুলের পাপড়ির বদলে ওগুলো রুটি, বাতাসা, মুড়ি, মিষ্টি হত, তবে...
হঠাৎ কোনও বিপর্যয় বড়সড় মহামারীকেও ভুলিয়ে দিতে পারে। আমপান সেটা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিল।
ওহঃ, একজন পুরুষ বটে! না, তিনি পুরুষ নন, মহাপুরুষ। না হলে এমন কথামৃত মুখ থেকে বার হয়?
ভাল করে বাংলা না বলেও বাংলার মানুষের জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে যাঁর, সেই ঘোষবাবু বদলের সঙ্গে বদলার স্বপ্ন
মাননীয় হঠাৎ আটের আস্ফালন ছেড়ে ৯-এর ঘাড়ে চড়ে বসলেন কেন? কারণ নিশ্চয়ই আছে।