×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সেনসাসে দেরি হচ্ছে কেন?

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 22-05-2022

    ভারতে সেনসাস বা আদমশুমারির 150 বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবার যথাসময়েতথ্য সংগ্রহ করা হল না। 1872 সালে প্রথমবার ভারতে জনগণনার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অতীতে1941 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেও তথ্য সংগ্রহ করা গিয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ হতে দেরি হয়েছিল,1971এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনও ভারতের আদমশুমারির গণনা হয়েছে এবং সঠিক সময়ে  প্রকাশিতও হয়েছে2021 সালে কোভিডের জন্য বাড়িবাড়ি লোক পাঠিয়ে গণনা করা যায়নি।

     

    কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে2024 এর আগে আদমশুমারি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু 2024-ই কেন?

     

    প্রশ্ন উঠছে, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও কেন এখন সেই কাজে হাত দেওয়া হচ্ছে নাএবারের তথ্য সংগ্রহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হওয়ার কথা। তাতেও এত দেরি হওয়ার কোনও কারণ আছে কী?

     

    কোভিডের কারণেই যদি আদমশুমারির কাজ পিছিয়ে থাকে, তাহলে এই সময়ে কী করে পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য রাজ্য যেমন বিহার, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সম্ভব হল? প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার গিয়ে এই বিভিন্ন রাজ্যে প্রচার করেছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে। মানুষ ঘুরতে গেছে, নানান উৎসবে যোগ দিয়েছে, মিটিং মিছিল করেছে। তাহলে আদমশুমারিতে সমস্যা কোথায়? 

     

    আদমশুমারির বিকল্প নেই, তাও কেন দেরি?

     

    অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী এই বিষয়ে বলেন, ‘’সেনসাসের গুরুত্ব অপরিসীম, এর কোনও বিকল্প হয় না। কারণ এখানেই একমাত্র দশের প্রতিটি মানুষের থেকে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বাকি যে সমস্ত পরিসংখ্যান আমরা পাই, তা সবই নমুনার ভিত্তিতে (স্যাম্পল সার্ভে)।‘’ আদমশুমারির তথ্যের ভিত্তিতেই সরকার কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করে, নানান পরিকল্পনা বা বাজেট তৈরি করে। বিভিন্ন স্যাম্পল সার্ভে থেকে দেশের একটা সামগ্রিক ছবি উঠে আসেকিন্তু একেবারে গ্রাম স্তরে গিয়ে সেখানকার মানুষের সম্পর্কে নিখুঁত তথ্য (যেমন সেখানে নারী পুরুষের অনুপাত কত, কাজ করতে সক্ষম, কতজন কাজ করছেন ইত্যাদি) যদি কেউ চান, তবে একমাত্র আদমশুমারি থেকেই তা পাওয়া সম্ভব।

     

    এই তথ্য সরকারেরই সবথেকে বেশি দরকার। তা-ও কেন সেনসাসে দেরি করা হচ্ছে? অচিন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘’ঠিক সময়ে সেনসাস প্রকাশ না করার পিছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতেই পারে। বিজেপি দাবি করে ভারতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বাড়ছে। একটা সময় হিন্দুরা এ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে এমনটা চললে। কিন্তু আদমশুমারি প্রকাশিত হলে বোঝা যাবে এই দাবি সত্য নয়। বরং ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী মুসলিমদের জন্মহার কমছে।‘’

     

    সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ীর মতে লোকসভা ভোটের আগে সরকার আদমশুমারি প্রকাশ না করার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল এই যে এবারের জনগণনার ভিত্তিতেই লোকসভার আগামী আসন পুনর্বণ্টন বা ডিলিমিটেশন হওয়ার কথা। তাঁর ব্যাখ্যা, জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভায় রাজ্যগুলোর আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে উন্নয়ন কম হয়েছে এবং জনসংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে উন্নয়নের পাশাপাশি জনসংখ্যা কমেছে। ফলে দেখতে গেলে যেখানে উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে আসন সংখ্যা কমবে এবং যেখানে হয়নি সেখানে বাড়বেআগামীদিনে এই বিষয় নিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হবেই। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তাই সেই বিতর্ক এড়াতে, স্থিতাবস্থা বজায় রাখতেই আদমশুমারির প্রকাশ পিছিয়ে দিচ্ছে।

     

    এই যুক্তির একটা ভয়ঙ্কর খারাপ দিকের কথা উল্লেখ করে সাংবাদিক সুদীপ্ত সেনগুপ্ত বলেন, ‘’এটাকে কিন্তু রাজনীতিকদের দিক থেকে এভাবেও দেখা যায় যে, আমার রাজ্য অনুন্নত থাকলে লোকসভায় আমাদের রাজ্যের আসন সংখ্যা বাড়বে। অর্থাৎ উন্নয়ন না করাটাই সুবিধাজনক।” অর্থনীতির ভাষায় অচিন চক্রবর্তী বলেন, “উন্নয়নের শাস্তি বা ডিসইনসেন্টিভ। এই রকম হলে রাজনৈতিক দলগুলো সচেতন ভাবে উন্নয়ন এড়িয়ে যাবে। 

     

    উন্নয়ন কী ভাবে বদল আনে তার একটা ছবি ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট থেকেই বোঝা যাচ্ছে। টোটাল ফার্টিলিটি রেট অর্থাৎ একজন মহিলা গড়ে কতজন বাচ্চার জন্ম দিতে পারে সেই রেট পশ্চিমবঙ্গে যখন 1.7 শতাংশ, উত্তরপ্রদেশে সেটা 2.9 শতাংশ। কেরলের মুসলিম মহিলাদের মধ্যে সংখ্যাটা যখন 1.7 শতাংশ তখন উত্তরপ্রদেশের হিন্দুদের মধ্যে সেটা 3 শতাংশ। অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ নয়, উন্নয়নই ঠিক করে দেয় সবটা। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো যে উন্নয়নে বেশ পিছিয়ে সেটা এই তথ্য থেকেই প্রমাণ হয়। 

     

    সেনসাস সঠিক সময়ে না হলে কী কী সমস্যা হতে পারে? 

     

    প্রথমত প্ল্যানিংয়ে অসুবিধা হবে সরকারের। কৃষি নিয়ে ভাবতে গেলে, উন্নতি করতে গেলে আগে তো তথ্য পেতে হবে যে কৃষির উপর কতজন নির্ভরশীল। উন্নয়নের সঙ্গে কৃষির উপর নির্ভরশীল এমন মানুষের সংখ্যা কমবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না। সেনসাস প্রকাশিত হলে সঠিক ছবি পাওয়া যাবে। 

     

    দ্বিতীয়ত, শিক্ষা সংক্রান্ত নানান তথ্য পাওয়া যাবে না সেনসাস প্রকাশিত না হলে। বয়স অনুযায়ী সমস্ত তথ্য দেয় আদমশুমারি। এখান থেকেই করোনার কারণে স্কুল ছুটের সংখ্যা বোঝা যেত। 

     

    তৃতীয়ত, কোভিডের কারণে সমাজে যে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে তার চিত্রটা সেনসাস হলেই একমাত্র পুরোটা পাওয়া যাবে। বিভিন্ন সার্ভে এবং রিপোর্ট অনুযায়ী কিছু টুকরো ছবি উঠে এসেছে এই দুই বছরে। যুবরা যেমন কাজ হারিয়েছে বা কাজ থেকে মুখ ফিরিয়েছে তেমনই কর্মরত বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প বা রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য বা অন্য যে কোনও কারণে সচেতনতা তৈরি হওয়ার ফলে কন্যা ভ্রূণ হত্যা কমেছে। তাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু এগুলো তো টুকরো ছবি। সেনসাস আমাদের বয়স ভিত্তিক একটা সামগ্রিক ছবি দেখায়। 

     

    সরকার বলছে 2024 সালে ভারতের প্রথম ডিজিটাল আদমশুমারি প্রকাশিত হবে। কিন্তু ডিজিটাল আদমশুমারি করতে খরচ এবং সময় দুই কম লাগার কথা, কিন্তু তা-ও এখনও এত সময় লাগছে কেন? প্রক্রিয়া শুরু করতে সরকার কেন এত সময় নিচ্ছে তাই স্পষ্ট নয়।

     

    চিন, আমেরিকা, ব্রিটেন রীতিমত পর্যুদস্ত হয়েছিল করোনার কারণে তবুও তারা সঠিক সময়ে আদমসুমারির তথ্য সংগ্রহ ও তা প্রকাশ করেছে। তাহলে ভারত পারছে না কেন? করোনা যে কারণ নয় তা স্পষ্ট। তবে কী কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছার অভাব? আদমশুমারি 2024 -এর ভোটে ঠিক কী প্রভাব ফেলবে তা সময়ই বলবে। কিন্তু সেনসাস একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়। তাই এটাকে যথাসময়ে গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করা উচিত ছিল। সরকার যদি তা না করে তবে দরকার পড়লে তার জন্য লড়াই করতে হবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী। 

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    সচেতনতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা দিয়ে সিকদামাখাই গ্রামের মানুষ রুখে দিল করোনাকে।

    দূষণ যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা কে জানত!

    হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামকে ছাপিয়ে সিগন্যাল এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

    বঙ্গের অবস্থা দেখে মা দুর্গা নেহাতই চিন্তিত যে!

    গত বছরের শ্রমজীবী ক্যান্টিন থেকে এবারের রেড ভলেন্টিয়ার্স, মানুষের পাশে বামপন্থী তরুণ দল।

    এই বিপদে জনপ্রতিনিধিরা ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে, নাগরিকরাই একে অন্যের পাশে থেকে কঠিন লড়াই লড়ছে।

    সেনসাসে দেরি হচ্ছে কেন?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested