ইংরাজিতে একটা কথা আছে, আনফিনিশড বিজনেস (Unfinished Business)। করোনার সংক্রমণে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, মানুষ যখন সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে আছে, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যে করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বের কাছে প্রবল সংকট, সেটাই যেন ভারত সরকারের কাছে নিজস্ব কর্মসূচি রূপায়ণের বিরাট সুযোগ!
গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ‘জনতা কার্ফু’ (22 মার্চ) অবধি দেশজুড়ে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন সরকারকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছিল। বিশেষ করে খাস রাজধানীতে শাহিনবাগের সাড়াজাগানো সমাবেশ- যা দিল্লি দাঙ্গার সময়েও অটুট ছিল- সরকারের পক্ষে শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সরকার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। লকডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে তারা কাজ শুরু করে দিল। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ, জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র, মিরন হায়দারকে দিল্লি দাঙ্গার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে পয়লা এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হল। এই মিরন 21শে মার্চ, ‘জনতা কার্ফু’র আগের দিন করোনা প্রকোপের কারণে শাহিনবাগের সমাবেশ তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। কি অদ্ভুত পরিহাস! তাঁরই বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ দেশদ্রোহিতা, খুন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর অভিযোগ আনে। এপ্রিলের দশ তারিখ তারা শাহিন বাগের আরও একজন অন্যতম সংগঠক এবং জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রী সফুরা জরগর-কে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ দিন বাদে তাঁকে তিহার জেলে পাঠানো হয়। সফুরা তখন অন্তঃসত্ত্বা। দুজনের বিরুদ্ধে নির্মম ইউপিএ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং দুজনেরই একাধিক জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। আদালত 25 জুন অবধি তাঁদের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
আরও পড়ুন: |
দিল্লি দাঙ্গায় ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের আরও বেশ কিছু সক্রিয় সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন জামিয়ার শিক্ষার্থী শিফা-উর-রেহমান, আসিফ ইকবাল তানহা, বরখাস্ত আপ কাউন্সিলার তাহির হোসেন, ভূতপূর্ব কংগ্রেস কাউন্সিলার ইশরাত জাহান, জেএনইউয়ের ভূতপূর্ব ছাত্র নেতা উমর খালিদ, পিঁজড়া তোড়(আক্ষরিক অর্থে খাঁচা ভেঙে ফেলো) নামক যে সংগঠন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে গড়ে উঠেছে, সেই সংগঠনের নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতা। শেষোক্ত তিনজনের বিরুদ্ধে ইউপিএ প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া দিল্লি পুলিশ প্রখ্যাত লেখক ও সমাজকর্মী হর্ষ মান্দারের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী একটি জমায়েতে দেশের শীর্ষ আদালতের বিরুদ্ধে অবমাননাকর উক্তি করার অভিযোগ এনেছে। ডিসেম্বরের 16 তারিখে তাঁর একটি বক্তব্যের ভিডিও-র বিশেষ কিছু অংশ উদ্ধৃত করে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, তিনি জনতাকে হিংসা ছড়ানোর জন্য প্ররোচিত করেছেন। বাস্তবে উনি যা বলেছেন তা হল, মহাত্মা গান্ধীর মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা অহিংস পথে লড়াই চালিয়ে যাব। কেউ যদি আপনাদের ঘৃণা এবং হিংসায় প্ররোচিত করে, তাহলে তিনি আপনাদের বন্ধু নন।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞানীরা নয়, লকডাউন বিধি বানিয়েছে সরকার নিজের মতো করে
|
উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। এই মুহূর্তে সোশাল ডিস্ট্যান্সিং-এর জন্য কোনও প্রতিবাদী জমায়েতই সম্ভব নয়। আইনত তার অনুমোদন নেই, সামাজিকভাবেও মানুষ তা চাইবে না। এই সুযোগে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্যদের ফাটকে পুরে দিলে, করোনার বিপদ কেটে যাওয়ার পর আর নতুন করে আন্দোলন গড়ে ওঠার কোনও সুযোগ থাকবে না। এছাড়া অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, যে তিনজন বিজেপি নেতা, কপিল শর্মা, প্রবেশ বর্মা এবং অনুরাগ ঠাকুরের প্রবল উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য দিল্লিতে হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও তাদের ডাকা হয়নি। আশার কথা, এই অস্বাভাবিক ঘটনা দিল্লি আদালতের নজর এড়ায়নি। আদালত বলেছে যে, মনে হচ্ছে দাঙ্গা নিয়ে অনুসন্ধান একটা বিশেষ দিকেই পরিচালিত হচ্ছে এবং এই দাঙ্গায় বিরোধী গোষ্ঠীর ভূমিকা কী ছিল, সেটা তাঁরা পুলিশের কাছে জানতে চান।
আরও পড়ুন: |
করোনার আবহে রাষ্ট্রের অমানবিক ভূমিকার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে অসংগঠিত এবং সংগঠিত শ্রমিক। লকডাউনের কয়েক দিন পর থেকেই দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন, বুভুক্ষু আবালবৃদ্ধবনিতার বিরামহীন চলন সারা দেশকে স্তম্ভিত করে দেয়। স্বাধীনতার পরে এত মানুষের একই সময়ে স্থানান্তরিত হওয়ার দৃশ্য দেখা যায়নি। বহু মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, কমপক্ষে তিনশো জন ঘরে ফেরার তাগিদে নানা ভাবে মারা গেছেন। দু’মাসের জন্য কিছু খাদ্যশস্য এবং শুকনো কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া সরকার আর কিছুই করেনি। এই শ্রমিকদের প্রতি সরকারের যে আচরণ, সেটা কি নিছকই উদাসীনতা বা প্রশাসনিক গাফিলতি, নাকি এর পিছনেও অন্য দীর্ঘমেয়াদী কোনও লক্ষ্য পূরণের পরিকল্পনা আছে? শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ করে দেওযার মধ্যে বিশেষ কোনও অর্থনৈতিক মতাদর্শকে সুবিধা করে দেওয়ার গূঢ় অভিসন্ধি নেই তো? এই সব প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসছে, সরকারের কাজকর্মের বৃহত্তর অভিমুখটা লক্ষ্য করলে।
আরও পড়ুন: নিজেদের বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট উপেক্ষা করে সরকার এক মাস হাত গুটিয়ে বসেছিল
|
দেশের সমস্ত রাজপথ জুড়ে যখন এই অসহায় মানুষদের ঢল নেমেছে, তখন 31শে মার্চ সলিসিটর জেনারেল দেশের শীর্ষ আদালতকে জানাচ্ছেন যে, রাস্তায় আর কোন পরিযায়ী শ্রমিক নেই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আদালত বিনা কোনও অনুসন্ধানে সেটা মেনেও নিচ্ছে! দেশজুড়ে যখন দাবি ওঠে যে এই শ্রমিকদের কিছু নগদ টাকা দেওয়া হোক, যাতে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্যা মেটাতে পারে। আদালত বলল খাবার তো দেওয়া হচ্ছে, পয়সার আর প্রয়োজন কী? যখন ষোলোজন শ্রমিক মালগাড়ি চাপা পড়ে মারা যান, তখন আদালত বলে, রেললাইনের ওপর কেউ শুয়ে পড়লে তাঁকে কী ভাবে আটকানো যাবে! আদালতের এই ভূমিকা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এপি. শাহ যথার্থই বলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্ট পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার করেনি। আর এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন লোকুর বলেন, কোভিড-19-এর সময়ে আদালতের ভূমিকায় তিনি হতাশ। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের অধিকার আদালত যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
অনুমান করা হচ্ছে, লকডাউনের কারণে অন্তত 14 কোটি মানুষের চাকরি চলে গেছে। অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে বহু পরিযায়ী শ্রমিক দেশে ফিরে গেছেন। এটা নিশ্চিত, এঁরা গ্রামে ফিরে গিয়ে সম মজুরির কাজ পাবেন না এবং পুরানো কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হবেন। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। বহু কারখানার মালিক এবং পাঞ্জাবের ধনী চাষিরা নিজেরা যানবাহন পাঠিয়ে শ্রমিকদের আবার ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে অসংগঠিত শিল্পে এক চূড়ান্ত ডামাডোলের অবস্থা। বিশ্বব্যাপী মহামারীর এই প্রবল অনিশ্চয়তার সময়ে সংগঠিত শিল্পে শ্রম আইন সংশোধন করে অস্থিরতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা বিজেপির বহু দিনের অ্যাজেন্ডা। প্রথমবার বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরে তারা শ্রম আইন নানা ভাবে শিথিল করার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সেই চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে, কিন্তু মূলত বিভিন্ন বামপন্থী দল ও ট্রেড ইউনিয়ানের বিরোধিতার কারণে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এখন এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফ্যাক্টরি অ্যাক্টের আপৎকালীন ধারা প্রয়োগ করে, কাজের সময় 8 ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে 12 ঘন্টা করার চেষ্টা হচ্ছে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের অজুহাতে মালিক এখন কর্মীসংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে, এবং সেই অভাব পূরণের জন্য তারা বাকি কর্মীদের 8-এর জায়গায় 12 ঘন্টা কাজ করাতে পারে। ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কাজ করালে দ্বিগুণ মজুরি দেওয়ার যে নিয়ম, সেটাও তারা মানতে নারাজ। এই অতিরিক্ত কাজের জন্য তারা দেবে মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ, শৌচাগার, সুরক্ষা সরঞ্জাম, ক্যান্টিন, সপ্তাহান্তে ছুটি, পানীয় জল ইত্যাদি মালিক দিতে বাধ্য নয়। কারও কাজ সুরক্ষিত নয়, খেয়াল খুশি মতো তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। মধ্যপ্রদেশে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রে হাজার দিনের জন্য শ্রম আইন মুলতুবি। রাজস্থান, গুজরাট, পাঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ একই ভাবে উপরোক্ত রাজ্যগুলির দেখানো পথ অনুসরণ করছে। প্রায় বিনা বাধায় উত্তরপ্রদেশ সরকার অধ্যাদেশ মারফত আগামি তিন বছর সমস্ত ব্যবসায়িক সংস্থার ক্ষেত্রে শ্রম আইন মুলতুবি রাখার কথা ঘোষণা করেছে। শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতার ফলে উত্তরপ্রদেশ সরকার আপাতত এই অধ্যাদেশ স্থগিত রেখেছে। শ্রম আইনের এই সংশোধনীগুলি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে শ্রমিক তার বহুদিনের কষ্টার্জিত অধিকারগুলো হারাবে, মালিকের কথা মতো চলা ছাড়া তার আর কোনও উপায় থাকবে না।
আরও পড়ুন: |
সরকারের যুক্তি হচ্ছে, উহান শহর করোনা ভাইরাসের উৎস হওয়ার কারণে চিন এখন বিশ্ববাজারে কোণঠাসা, অনেক কোম্পানি সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কেন্দ্রীয় সরকার চায় সেই বিনিয়োগগুলো ভারতে আসুক, যার জন্য শ্রম আইনে সংস্কার নাকি প্রাথমিক প্রয়োজন। এটা সম্পূর্ণ অসত্য, শ্রম আইন পরিবর্তনের পক্ষে রাজনৈতিক প্রচার মাত্র। বণিকসভা FICCI-র একটা সমীক্ষা বলছে, ভারতে বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলি ক্রম অনুসারে হল: পরিবেশ ছাড়পত্র, জমি অধিগ্রহণ, বিদ্যুৎ সংযোগ, জলের সরবরাহ এবং তারপরে পঞ্চম স্থানে শ্রম বা লেবার। শ্রম আইনের সংস্কারের অভাবেই বিনিয়োগ আটকে আছে, এমন কথার কোনও ভিত্তি নেই।
এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে সমস্ত বিরোধী স্বর স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে, সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, এবং নিজেদের অ্যাজেন্ডা পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে লকডাউন কার্যত উঠে যাওয়ার পরেও বিরোধী দল, বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন শাসক দলের এই নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
শাহিনবাগের বর্ষপূর্তিতে স্মরণীয় সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের শক্তি
দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘু পীড়ন দেখে যাঁরা চুপ থাকেন, তাঁরা করবেন বিজেপি-সংঘের বিরোধিতা?
কোভিডের সময়ে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন।
স্থানীয় আদিবাসীদের উপর প্রবল প্রভাবের কারণেই স্ট্যান স্বামীকে সরানো রাষ্ট্রের দরকার ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি কিংবা আজকের ভারত— স্থানকাল ভেদে চরিত্র পাল্টায়নি ফ্যাসিবাদের।
উত্তরপ্রদেশে আইনের প্রয়োগ অখন নাগরিকের ধর্মের উপর নির্ভর করে।