×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • জ্ঞান অজ্ঞান একাকার হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের দফারফা

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত, শুভস্মিতা কাঞ্জী ও বিতান ঘোষ | 29-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    জ্যোতিষচর্চার বুজরুকিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার একটা উপাদান হল কম্পিউটার। কোথায় হাতে আঁকা কাটাকুটি খেলার ছক, কোথায় কম্পিউটার গ্রাফিক্সে ফুটে ওঠা ত্রিমাত্রিক ছক, উজ্জ্বল স্ক্রিনে রঙিন সংখ্যার নাচানাচি! দেখলেই সম্ভ্রম জাগে! মনে হয়, এত আড়ম্বরের পিছনে নিশ্চয়ই সারবস্তু কিছু আছে! ঠিক তেমনই কোনও গবেষণাকে পাবলিকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার সহজিয়া পথ আছে। রঙচঙে গ্রাফের ব্যবহার, মাঝে মাঝে দু-একটি ফর্মুলা, এবং পরিশেষে এসে একটা চমকপ্রদ ভবিষ্যদ্বাণী– এই হল সেই সহজিয়া পথ। এই পথের পথিকরা বিলক্ষণ জানেন যে, ‘এরা যত পড়ে, তত জানে, তত কম মানে’ এই আপ্তবাক্যের উল্টোটাও সত্যি। তারা যত কম পড়ে, তত কম জানে, তত বেশি মানে। রাজনীতির কারবারিদের উপর এই নিরিখে সাধারণত যথেষ্ট ভরসা করা যায়, এই বিশ্বাসই সহজিয়া সাধকদের মূলধন। 


    শুধু রাজনীতির কারবারি কেন, কম জানা এবং সেই অনুপাতে বেশি মানার ব্যাপারে ভরসা করা যায় আমজনতারও একটা বিশাল বড় অংশের উপর। হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচারিত ‘জ্ঞান’ অনেকের কাছেই বেদ-বাইবেল-কোরানের তুল্য। এই জ্ঞানসাধকরা তো নিভৃত জ্ঞানচর্চায় বিশ্বাস করেন না, একটি অক্ষর শিখলে তাঁরা দুনিয়াকে শিক্ষা দিতে বেরিয়ে পড়েন। তার ভয়ঙ্কর কিছু উদাহরণ নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। আজ দেখব ভাইরাল হওয়া আরও দুটি জ্ঞানের মণিমাণিক্য– একটি চূড়ান্ত হাস্যকর, অন্যটি আন্তর্জাতিক পরিসরে চিনের সম্পর্কে বিদ্বেষ তৈরি করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা। 


    তবে সে দু’টিই ফিকশন, কল্পিত ঘটনা। তার আগে একটি অতীব সন্দেহজনক গবেষণার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে। এই গবেষণার ফল রবিবার 26 এপ্রিল হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হয় (https://ddi.sutd.edu.sg/)। সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ওই গবেষণায় এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোন দেশে কবে মহামারীর অবস্থা কী হবে তার একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। মহামারী চর্চায় অনেক ধরনের গাণিতিক মডেল ব্যবহৃত হয়। এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল SIR (Susceptible-Infected-Recovered) মডেল। গবেষণাপত্রের শিরোনামটি বেশ খবরের কাগজের শিরোনামের মতো: কখন COVID-19 মহামারী শেষ হবে। ভারতের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস হল 24 মে-র মধ্যে 97 শতাংশ কমে যাবে, 2 আগস্টের মধ্যে পুরোপুরি।

     


    বিজ্ঞানীরা কিন্তু এক বাক্যে বলছেন, এই SIR একটি অতি সরলীকৃত মডেল। এতে মানুষের গতিবিধি, পরস্পরের সংস্পর্শে আসা, সেরে ওঠার পর পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদিকে হিসেবের মধ্যে ধরাই হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভেগের এক অধ্যাপক গবেষণাপত্রটি খতিয়ে দেখে বলেছেন, ‘এতে মূলত ইতিমধ্যেই যে তথ্য আছে সেগুলোতে একটা গ্রাফ ফিট করা হয়েছে। এই ধরনের গবেষণার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট দিনক্ষণের পূর্বাভাস দেওয়া খুবই বিপদজনক। যাঁরা বিশেষজ্ঞ নন, তাঁরা এটাকে বেশি সিরিয়াসলি নিতে পারেন– তাই এই ধরনের গবেষণা প্রকাশ করা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজও বটে।’


    সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ওই গবেষণা গ্রাফ সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কোনও কোনও রাজ্য 21 বা 24 মে-র পর লকডাউনে কিছু গুণগত পরিবর্তনের কথা এখনই শোনা যাচ্ছে। তার ভিত্তি যদি ওই গবেষণা হয়, তবে কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের সম্ভাবনা বিস্তর।


    এহেন সন্দেহজনক বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সোশাল মিডিয়ায় রয়েছে সরাসরি সাজানো মিথ্যা।


    ‘নোবেল পুরস্কারজয়ী জাপানি বিজ্ঞানী তাসুকু হোনজো নাকি দাবি করেছেন করোনা মনুষ্য সৃষ্ট’


    ফেক নিউজে দেখানো হয়েছে: হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভাইরাল মেসেজে তাসুকু হোনজোর বক্তব্য হিসেবে বলা হয় করোনার উৎস প্রাকৃতিক নয়, বরং উহানের ল্যাবরেটরিতে তা বানানো হয়েছে। করোনা ভাইরাস যদি সত্যিই কোনও পশুর দ্বারা ছড়াত তাহলে তা সারা বিশ্বে ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়াত না। বা করোনার প্রভাব বিশ্বজুড়ে এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করত না। এক একটি দেশে এক এক রকমের তাপমাত্রা, ফলে এটা যদি প্রাকৃতিক হতো তবে যে দেশগুলোয় উহানের মতো তাপমাত্রা থাকে সেই সেই দেশেই ছড়াত। আর অন্য কোথাও নয়। অতএব এই ভাইরাসটি আর্টিফিশিয়াল। মেসেজ অনুসারে উহান ল্যাবরেটরিতে হোনজো কাজ করেছেন চার বছর। কিন্তু গত তিনমাস ধরে বহুবার ফোন করার পরেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই উনি 100 শতাংশ নিশ্চিত, করোনা চিনেরই তৈরি, এটা বাদুড় থেকে আসেনি। হোনজো বলেছেন উনি যদি ভুল প্রমাণিত হন তাহলে সরকার ওঁর নোবেল প্রাইজ কেড়ে নিতে পারেন শাস্তি হিসেবে। এই দাবির সঙ্গে সেই মেসেজে হোনজোর উইকিপিডিয়া পেজের লিংক দেওয়া থাকে। 


    তথ্য যাচাই: এটা সম্পূর্ণ ফেক। একজন নোবেল প্রাপক এমন মন্তব্য যদি করতেন তবে তার কোনও না কোনও ভিডিও থাকত বা খবর হত। কিন্তু তা হয় নি। এর সমস্ত তথ্যই ভুল। হোনজোর এক পি.এইচ.ডির ছাত্র মেসেজটির ব্যাপারে জানান, তিনি এমন কোনও মন্তব্য করেননি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। তাসুকু হোনজো কখনই উহানের ল্যাবরেটরিতে কাজ করেননি। তিনি কোনও দিন ভাইরাস সম্পর্কিত কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজও করেননি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন করোনা মনুষ্য সৃষ্ট নয়, এই ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে, পরে খুব সম্ভবত প্যাঙ্গোলিনের মাধ্যমে মানুষের দেহে এসেছে। বিস্তারিত তথ্যের জন্য www.altnews.in দেখতে পারেন।

     

    ‘রাজনীতির বিদ্বেষে যখন কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়’


    ফেক নিউজে দেখানো হয়েছে: বিজেপি সদস্য মেজর সুরেন্দ্র পুনিয়া গত 26 এপ্রিল রাতে নিজের টুইটার হ্যান্ডল থেকে একটি ছবি পোস্ট করেন। সেই ছবিতে ‘ডেকান ক্রনিকল' দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠাটিকে অবিকল তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্গে হেডলাইন, "শহরে কমলালেবু নিষিদ্ধ করল সাইবারাবাদ পুলিশ।’ এবার সেই হেডলাইনের তলায় পুনিয়া নিজের টীকা-টিপ্পনি যোগ করেন। লেখেন, "এখন থেকে সিকিউলারিজিমের দোহাই দিয়ে কমলালেবুরও বদনাম করা হচ্ছে। এভাবেই কিছু রাজ্যের পুলিশ শরিয়তের প্রচার করছে। সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র, টিপ, ওম-কেও নিষিদ্ধ করা হবে। সিকিউলারবাদ জিন্দাবাদ।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই দেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অনেকেই সেকিউলার (বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ) শব্দটিকে বিকৃত করে, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের ‘সিকিউলার’ বলে ব্যঙ্গ করেন। মুহূর্তের মধ্যে সুরেন্দ্র পুনিয়ার সেই টুইটটি 14,000 জন লাইক করেন এবং টুইটটি তুলে নেওয়ার আগে অবধি সেটি 4000 বার রি-টুইট করা হয়। 


    তথ্য যাচাই: ‘ভাইরাল’ হতে যাওয়া পোস্টের ওই ছবিটি যে কম্পিউটারে তৈরি করা একটা বিকৃত ছবি, তার প্রমাণ ওই ছবির মধ্যেই ছিল। এমন লোভনীয় মিথ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যস্ততায় পুনিয়া বোধহয় সেদিকে খেয়াল করেননি। অথবা করলেও, জনগণের চোখ ও নির্বুদ্ধিতার উপর অগাধ আস্থা রেখেছিলেন। ছবিটির উপরে ‘ডেকান ক্রনিকল’ সংবাদপত্রের নাম থাকলেও, নীচের ডানদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল "স্যাটায়ার বাই @theskindoctor13’। অর্থাৎ ওই নামের টুইটার হ্যান্ডল থেকে স্রেফ বিদ্রুপ করার জন্যই এমন ছবি পোস্ট করা হয়েছিল। এমনকি বিদ্রুপের পরিমাণকে আরও বাড়ানোর জন্য লেখা হয়েছিল, "সাইবারাবাদ পুলিশকে সব থেকে বেশি সেকিউলার পুলিশ হিসাবে স্বীকৃতি দিল ইউনেস্কো।’ বেচারা পুনিয়া ছবির শেষের এই লাইনটিকেও খেয়াল করেননি। তাই তাঁর পোস্টে জ্বলজ্বল করছিল, এই কাঁচা কাজের নমুনাখানা। এই ছবির উৎস সন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, ‘দ্য স্কিন ডক্টর’ নামের টুইটার ব্যবহারকারীর আসল নাম নীলম সিং। এর আগেও তিনি ঝাড়খন্ডের একটি ঘটনার সাম্প্রদায়িক অপব্যাখ্যায় অভিযুক্ত। তেলেঙ্গানাতেও এই ধরনের বহু ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এইরকম বিকৃত খবর পোস্ট করে, রাজেন্দ্র নগর পুলিশ থানাকে ‘ট্যাগ’ করায় পুলিশি জেরার সম্মুখীন হয়েছেন সেই রাজ্যের বিজেপি বিধায়ক অরবিন্দ ধর্মপুরী। সুরেন্দ্র পুনিয়ার এই মিথ্যা টুইট কান্ডে ‘দ্য স্কিন ডক্টর’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে সাইবারাবাদ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের খবরকে বিকৃত করা, গুজব ছড়ানো ও প্ররোচনা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হচ্ছে।


    বিস্তারিত তথ্যের জন্য www.altnews.in দেখতে পারেন।

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত, শুভস্মিতা কাঞ্জী ও বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জ্ঞান’ অনেকের কাছেই বেদ-বাইবেল-কোরান তুল্য। সেটাই বাড়াচ্ছে বিপদ।

    জ্ঞান অজ্ঞান একাকার হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের দফারফা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested