শুধু সংঘ পরিবারকে দুষলেই হবে না, দেশে আজ কমবেশি সব দলই হিন্দুত্ববাদী। অনেকে রামনবমীর মিছিলে তৃণমূলী ও সংঘী নেতাদের গলায় গলায় ভাব দেখে ভুরু কোঁচকাচ্ছেন? এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিল না! যেন কলির কেষ্ট, চোখে ঠুলি লাগিয়ে বসে আছে। সেই 2018 থেকে তো বাংলায় এটাই দড়। কে কত বড় হিন্দু সেটার প্রতিযোগিতা! সেই বছর তৃণমূল জাঁকজমক করে রামনবমীর মিছিল বার করেছিল এবং তাতে অবশ্যই তাদের নেত্রীর সায় ছিল। নির্বাচন ও হিন্দু ভোট বড় দায়। বিজেপি ঢাল তলোয়ার নিয়ে শ্রীরামের জন্মোৎসব পালন করা শুরু করার পর থেকে রাজ্যের শাসক দলের ঘুম ছুটে গেছে। চারিদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব! ভোটে মেরুকরণ হয়ে গেল, অবিলম্বে একে আটকাও। আটকানোর উপায়টা কী? না, ততোধিক উৎসাহ নিয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বাজার মাতিয়ে দাও। হিন্দুদের দেখিয়ে দাও ধর্মপালনে আমরা কোনও ভাবেই কম যাই না। আমাদেরও বলতে হবে ‘গর্ব সে কহো হাম হিন্দু হ্যাঁয়’।
প্রথম যখন সংঘ পরিবার বাংলায় রামনবমী উদযাপন করা শুরু করেছিল, তখন প্রশাসন তাদের নানা ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বিজেপি দাবি করে হিন্দুদের ধর্মপালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাস ভয়ে লেজ গুটিয়ে গেল, তারপর থেকে শুধু মিঁউ মিঁউ করে প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখানোর বিরোধিতা করা হল। এখন সেটাও নেই, ধর্মীয় বিধানকে অজুহাত করে তৃণমূলীরা নিজেরাই এখন অস্ত্র নিয়ে মিছিল করছে। এই বছর বিভিন্ন জেলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে যুযুধান দু’পক্ষের নেতারা পাশাপাশি হেঁটেছেন, একই সঙ্গে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে আওয়াজ তুলেছেন। বলা হচ্ছে যত গণ্ডগোল সবই নাকি শুধু গুজরাত আর মধ্যপ্রদেশেই হয়েছে, বাংলা রামনবমীতেও নাকি শান্তির নীড়! হাওড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং বাঁকুড়ায় গণ্ডগোল হয়েছে, সেটা কতটা গুরুতর তা জানার কোনও উপায় নেই।
হিন্দুত্ব কী? হিন্দু ধর্মের আগ্রাসী, বিকৃত একটা রূপ, যা অপরকে বরদাস্ত করে না; এই অপর বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম মানুষজন তো বটেই, নিম্নবর্ণের মানুষ এবং বামমনস্ক, কমিউনিস্ট-ও (সেই প্রজাতি যদি বিলুপ্ত না হয়ে থাকে) বটে। এই অপরকে হিন্দুত্ব অবদমিত করে রাখতে চায়, তথাকথিত সাচ্চা হিন্দুদের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত করতে চায়। এই সংজ্ঞার নিরিখে আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য আছে কি? গুজরাত, মধ্যপ্রদেশে মুসলিমদের যে ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে কিংবা জেএনইউ-তে আমিষ খাওয়ার জন্য যে নৃশংস ভাবে বাম ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করা হয়েছে, তার কোনও সমালোচনা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করেছেন কি? তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে মুসিলম-প্রেম ব্যাক বার্নারে চলে গেছে। হিন্দু ভোটের বড় অংশ করায়ত্ত করতে পারলে আর কিছুটা মুসলিম ভোট পেলেই কিস্তিমাত হয়ে যাবে। উল্টোটা কিন্তু হবে না। 2021-এর নির্বাচনী ফলাফল থেকে এই শিক্ষাটা তিনি নিয়েছেন।
শুধু তৃণমূল কেন, সবাই এখন সুড়সুড় করে নরম হিন্দুত্বে নাম লেখাচ্ছে। কংগ্রেস তো এই ব্যাপারে পথপ্রদর্শক! রামজন্মভূমি থেকে শাহ বানু কেস থেকে কাশ্মীর, সর্বত্রই তাদের নরম হিন্দুত্ব আরএসএস-বিজেপির ঘৃণার রাজনীতির রাস্তা সুগম করে দিয়েছে। এবার তো কংগ্রেস নেতা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ মধ্যপ্রদেশে দলীয় কর্মীদের সার্কুলার জারি করে দিয়েছেন, রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী পালন করতে হবে। সেখানে ঈদ, গুড ফ্রাইডের কোনও উল্লেখ নেই। দেশের সর্ব বৃহৎ সেকুলার পার্টির কী করুণ পরিণতি!
আর আপ? যাদের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন প্রগতিশীলতার পোস্টার বয়! অনেকে যাঁর মধ্যে রাম মনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণের সমাজবাদী রাজনীতির খোয়াব দেখছেন। তিনি তো হনুমান চাল্লিশা পাঠ না করে দিন শুরু করেন না। যে কোনও শহরে গেলে প্রথমে সেখানকার মন্দির দর্শন করেন। অথচ 2014 সালে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া নাকি তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর রাম এমন কোনও মন্দিরে থাকতে পারেন না যেটা মসজিদ ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে। 2015-য় ক্ষমতায় এসে পুরো পাল্টি! সাষ্টাঙ্গে হিন্দুত্বে নিজেকে সমর্পিত করে দিয়েছেন। তারপর সরকারের পয়সায় দিল্লির প্রবীণ নাগরিকদের বারোটি তীর্থস্থানে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নিজেকে সহি হিন্দু প্রমাণে করোনার বাড়বাড়ন্তর জন্য তাবলিগিদের দায়ী করেছেন; দিল্লিতে মুসলিমদের ওপর আক্রমণের সময় ঘরে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকেছেন এবং তাতে এতই তাঁর বিবেক দংশন হয়েছে যে, গান্ধী মুর্তির পাদদেশে গিয়ে বিলাপ করেছেন। 2022-এর নির্বাচনের সময়ে অয্যোধ্যায় রামলালার দর্শন পেয়ে তিনি এতই আপ্লুত হয়ে যান যে, তীর্থস্থানের তালিকায় অয্যোধ্যার নামটাও যুক্ত করে দেন।
আরও পড়ুন:মমতা জানেন জনতার কথা
এঁরা কেউই গুরগাঁওয়ে প্রকাশ্যে নমাজ পড়ার বিরোধিতা করেননি, কর্ণাটকে হিজাব নিয়ে প্রতিনিয়ত মুসলিম ছাত্রীদের যে হেনস্থা করা হচ্ছে, সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি, ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি দ্বারা যে তীব্র মুসলমানদের ওপর ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সেটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি করেননি, ধর্মগুরুরা যে রাজধানীর বুকে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে মুসলিমদের গণহত্যা ও মুসলিম নারীদের গণধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে, সেটার কোনও প্রতিবাদ করেননি। কর্ণাটকের ধারওয়ারে গেরুয়াবাহিনী যে নির্দয় ভাবে এক দুঃস্থ প্রৌঢ় মুসলিম ফেরিওয়ালার তরমুজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে দিল, তা দেখে এই জনদরদী ভন্ডদের বুক একটুও কেঁপে ওঠেনি। আর এঁরা করবেন কিনা আরএসএস-বিজেপির বিরোধিতা!
ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা এখন তামাদি হয়ে গেছে। কে কতটা কম বা বেশি হিন্দু, সেটাই এখন বিচার্য বিষয়। হিন্দুত্বই আজ ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র, যার আবর্তে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে সমস্ত বিরোধী স্বর স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে
প্রচার মাধ্যম পাল্টালেও পুরনো দিনের ভোটচিত্র ও রাজনীতির স্লোগানের সঙ্গে আজকের অনেকই মিল।
দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘু পীড়ন দেখে যাঁরা চুপ থাকেন, তাঁরা করবেন বিজেপি-সংঘের বিরোধিতা?
পড়ে থাকে ছড়ানো ছিটানো কিছু শুকনো রুটি, বিশ্বের দরবারে যা ভারতের মানুষের ক্ষুধার বীভৎস চিত্র।
উত্তরপ্রদেশে আইনের প্রয়োগ অখন নাগরিকের ধর্মের উপর নির্ভর করে।
মাধুর্যের আড়ালে লুকনো কদর্যতা 60 বছরেও বদলায়নি।