কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি, মানে অমাবস্যার আগের দিনটিই হচ্ছে ‘ভূত চতুর্দশী’। আমাদের রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই দিনটিতে দুপুরে চোদ্দ রকম শাক খাওয়া এবং সন্ধ্যায় বাড়ির চোদ্দটি জায়গায় চোদ্দটি প্রদীপ, বর্তমানে মোমবাতি জ্বালানোর নিয়ম চলে আসছে। মহালয়া থেকে শুরু হয় প্রেতপক্ষের। প্রেতপক্ষের ঠিক একমাস পরেই ভূত চতুর্দশী উদযাপিত হয়। ভূত চতুর্দশীকে কেন্দ্র করে নানা ধর্মীয় রীতি, সংস্কার, ভয়-ভীতি এখনও এই আধুনিক যুগে আছে। তবে ভূত চতুর্দশী কালীপুজোর ঠিক আগের দিন হওয়ায় এখন তা একটা উৎসবের আদল নিয়েছে। কিন্তু এই উৎসবের মধ্যেও কোথায় যেন একটা গা-ছমছমে ভাব এখনও রয়েই গেছে।
পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চভূতের সঙ্গে ভূত চতুর্দশীর সম্পর্ক আছে বলে অনেকে মনে করেন। হিন্দু শাস্ত্রমতে পঞ্চভূত হচ্ছে ক্ষিতি বা মাটি, অপ্ অর্থাৎ জল, তেজ হচ্ছে আগুন, মরুৎ অর্থাৎ বায়ু, ব্যোম হল আকাশ। এই পঞ্চভূতের সমাহারেই মানুষের শরীর বা দেহ তৈরি। শাস্ত্রে বলা হয়, মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর এই পঞ্চভূতেই বিলীন হয়। ভূত চতুর্দশীতে সেই শরীর বা দেহ সংশোধন ও সংস্কার হয়। মানব শরীর দীর্ঘ ব্যবহারের জন্য দূষিত, দুর্বল হয়। আবার কোনও কোনও সময় এই মানবদেহ অকেজোও হয়ে পড়তে পারে। তাই ভূত চতুর্দশীর দিনটিতে শারীরিক ক্ষয় রুখতে বিশেষ গুণযুক্ত চোদ্দ রকমের শাক খাওয়ার কথাও শাস্ত্রে বলা হয়েছে। এই চোদ্দ শাক হল পলতা, বেতো, কালকাসুন্দি, সর্ষে, গুলঞ্চ, জয়ন্তী, ওল, শুষুনী, নিম, শালিঞ্চা, ঘেঁটু, হিঞ্চে। শাস্ত্রে আবার এটাও বলা আছে, শীতের আগে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি চালু হয়েছিল।
তবে চোদ্দ শাকের সঙ্গে সেই অর্থে ভূতের তেমন কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায় না।
তবে বাংলার পল্লী-গ্রামে ভূত চতুর্দশী নিয়ে নানা কাহিনি ও বিশ্বাস এখনও প্রচলিত আছে। কোথাও কোথাও বলা হয় ভূত চতুর্দশীর দিন অপদেবতারা যাতে গৃহে প্রবেশ করতে না করেন, সে জন্য সন্ধ্যায় গৃহস্থ বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। লোকসমাজের বিশ্বাস, ওই দিন আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এসে দেখে যান আমরা, অর্থাৎ তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছে। বাংলার কোনও কোনও জায়গায় আবার রীতমতো ওইদিন পূর্বপুরুষদের জন্য জল, মিষ্টির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। পূর্বপুরুষদের আত্মা যখন এসে আমাদের দেখে ফিরে যান, তখন তাঁদের পথ দেখানোর জন্যই বংশধরেরা প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে রাখেন, তবে এর পুরোটাই লোকাচার, যার জন্ম বিশ্বাস থেকে।
আবার রামায়ণ মহাকাব্যের সঙ্গে আমরা ভূত চতুর্দশীর ছায়া খুঁজে পাই। বলা হয়, চোদ্দো বছর বনবাসে কাটিয়ে শ্রীরামচন্দ্র এই ভূত চতুর্দশীর দিনেই অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য গোটা অযোধ্যাবাসী সেদিন প্রদীপ জ্বালিয়ে অযোধ্যা নগরীকে আলোকিত করে দিয়েছিল। সেই থেকে এই প্রথা চলছে। অন্যদিকে চতুর্দশী তিথি আবার শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছেও খুবই পবিত্র তিথি। শিবচতুর্দশীতে মহাদেবের পূজা করা হয়। এ ছাড়াও চতুর্দশী তিথিতে তারা মায়ের পুজো আদর্শ তিথি।
আরও পড়ুন:বর্ষা যখন মনকে ভাসায়
ভূত চতুর্দশীকে নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনিও রয়েছে। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের অধীশ্বর দানবরাজ বলির বড়ই অহংকার ছিল দানবীর হিসাবে। কথিত আছে, এক সময় সব দেবতারা তাঁর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। এমন সময় দেবগুরু বৃহস্পতি বিষ্ণুকে পরামর্শ দেন, বামন রূপে তাঁর কাছে পা রাখার জন্য মাত্র তিন পা জমি ভিক্ষা চাওয়ার জন্য। বিষ্ণু ঠিক তেমনটাই করেছিলেন। তবে অতি বিচক্ষণ বলি বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্বয়ং বিষ্ণুই তাঁর কাছে এসেছেন। তবু বিষয়টা এতটুকুও বিষ্ণুকে বুঝতে দেননি তিনি। বিষ্ণুর কথামতো তিনি রাজি হলেন শুধু মাত্র কথা রাখার জন্য। তখন বামনরূপী বিষ্ণু একটা পা রাখলেন স্বর্গে, আর একটা পা দিলেন মর্তে। তাঁর নাভি থেকে বের হল আরও একটি পা। এই পা তিনি রাখলেন রাজা বলির মাথায়। এর পরই বলির পাতাল প্রবেশ হল। বলি জেনে বুঝেও জমি দান করেছিলেন বলে বিষ্ণু রাজা বলির ‘নরকাসুর’ রূপের পুজোর প্রবর্তন করেন মর্ত্যলোকে। তাই ভূত চতুর্দশীর দিন বলি দৈত্যরাজের পুজোর প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকে নরকাসুর রূপে বলি রাজা মর্ত্যে ভূত চতুর্দশীর দিন পুজো নিতে আসেন, তাই এই দিনটিকে ‘নরক চতুর্দশী’ বলা হয়ে থাকে। কারণ নরকাসুর যখন পুজো নিতে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর অসংখ্য অনুচর ভূত-প্রেত। তাদের দূরে রাখার জন্যই প্রদীপ জ্বালানো হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। এই দিন বাড়ির বাইরে যে দীপ জ্বালানো হয়, তাকে ‘যমদীপ’ দান করাও বলা হয় কোনও কোনও জায়গায়। কোথাও আবার ভূত চতুর্দশীকে ‘যম চতুর্দশী’ও বলা হয়। কারণ এই দিন চোদ্দজন যমের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার নিয়ম রয়েছে। এই 14 জন যমরাজের মধ্যে রয়েছেন ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উডুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত। ‘পদ্মপুরাণ’ অনুসারে এই তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে আর নরক দর্শন করতে হয় না।
লোকসংস্কৃতির রীতি অনুসারে, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং মালদহের কিছু জায়গায় ভূত উৎসব পালিত হয় ভূত চতুর্দশীর দিন। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় এই চতুর্দশীর নাম ‘চৌরচতুর্দশী’। প্রথা অনুযায়ী, ওই দিন এখনও ওপার বাংলার ফরিদপুরের মানুষের মধ্যে কিছু না কিছু চুরি করতেই হয় বলে বিশ্বাস ও ধারণা রয়েছে।
‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’, করোনার পাশাপাশি নতুন সমস্যা!
নোটবন্দির পাঁচ বছর পার। এখনও মানুষের ভরসা নগদ লেনদেনেই।
কলকাতায় সার্কাসের তাঁবু উধাও। একসময় শহরে শীতের বার্তা নিয়ে আসত এই সার্কাসের তাঁবু।
কলকাতা পুর নির্বাচনে বামফ্রন্টের ইস্তাহার দেখে মনে হচ্ছে তৃণমূলের সাফল্য অনুসরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে নিযুক্ত গ্রিন পুলিশ শাসকের সহায় হতে পারে, জনগণের নয়।
নেতাজির 125তম জন্মদিন নিয়ে কমিটি, প্রধানমন্ত্রী চেয়ারম্যান, নেই কোনও বৈঠক।