করোনা এখনও আমাদের রেহাই দেয়নি। এরই মধ্যে রাজ্যে ম্যালেরিয়ার নতুন স্ট্রেন ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’-এর সন্ধান মিলেছে। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এক যুবকের শরীরে পাওয়া গেছে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’-এর উপস্থিতি, এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসকরা। একে করোনা এখনও আমাদের মুক্তি যায়নি। তার উপর ম্যালেরিয়ার এই নতুন স্ট্রেন। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ও একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ প্রজাতির ম্যালেরিয়া এক প্রকার হয় না। এটা মূলত আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকাতে হয়। ভারতে এই ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ প্যারাসাইটের উপস্থিতি তাই কিছুটা হলেও চিন্তার কারণ। তবে এই নিয়ে মানুষের সচেতন হওয়ার দরকার অবশ্যই আছে, কিন্তু উদ্বেগ বা ভয়ের কোনও কারণ সেই অর্থ নেই।
আসলে এই বিশ্বায়নের যুগে গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযোগ আরও নিবিড় হয়েছে। আমরা চাইলেই যেমন বিশ্বের যে কোনও দেশের উৎপাদিত দ্রব্য নিজেদের নাগালের মধ্যে আনতে পারি, তেমনই বিভিন্ন রোগও আমাদের আক্রান্ত করতে পারে যখন তখন। এর কারণ বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যেকার মেলামেশা বৃদ্ধি। কাজের সূত্রে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনা। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার যাঁর শরীরে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’-এর উপস্থিতি মিলেছে, জানা যাচ্ছে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সূত্রে গিয়েছিলেন। লকডাউনের সময় তিনি ভারতে ফিরেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, এর ফলেই ওই ব্যক্তির শরীরে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ প্রবেশ করে থাকতে পারে। কেননা ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’-এর সন্ধান আফ্রিকাতেই এখন পাওয়া যায়।
করোনা চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে কী গোপনে বাড়ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু? গত প্রায় 18 মাস সময় ধরে আমাদের দেশে ও রাজ্যে তো বটেই করোনা যে ভাবে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উদ্যোগ আগের চাইতে কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। তবে এরই মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পুরসভাগুলি যদিও কিছুটা উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু ম্যালেরিয়া নিয়ে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না গোটা প্রশাসনকে। এটাই চিকিৎসকদের মত। তাই করোনার চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে গোপনে বাড়ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ। হাসপাতালগুলোর কাছে এখন প্রধান গুরুত্ব পাচ্ছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর কমছে।
এরই মধ্যে আমরা করোনাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় দুর্গোৎসব উদযাপন সবে শেষ করলাম। আর পুজো মিটতেই রাজ্যে আবার বাড়ছে করোনা। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গুও। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কলকাতার চিকিত্সকদের একাংশের অনুমান, বাংলায় খোঁজ মিলেছে নতুন রকম ম্যালেরিয়ার। যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হচ্ছে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ প্রজাতির ম্যালেরিয়া। যা ভারতে সচরাচর দেখা যায় না।
দিন কয়েক আগে, বেলডাঙার এক যুবকের কাঁপুনি দিয়ে ধুম জ্বর আসে। তাঁর রক্ত পরীক্ষায় করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়েনি ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়াও। চিকিত্সকদের সন্দেহ, বছর সাতাশের ওই যুবক বিরল প্রজাতির প্লাসমোডিয়াম ওভাল-এ আক্রান্ত। রোগীর কী চিকিত্সা হবে, তা জানতে তাঁর রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্যভবনে। স্কুল অফ ট্রপিকালের মেডিসিনের বিশেষজ্ঞের কাছেও পাঠানো হয়েছে রক্তের নমুনা।
চিকিৎসকদের মতে, ম্যালেরিয়ার মূলত চারটি প্রজাতি। এগুলি হল প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপরাম, প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরিয়ে ও প্লাসমোডিয়াম ওভাল। এর মধ্যে চতুর্থ প্রজাতির ম্যালেরিয়া ভারতে বিরল, হয় না বললেই চলে। তাই এই প্রজাতির ম্যালেরিয়ার সন্ধান পাওয়ায় চিকিৎসকরা চিন্তায় রয়েছেন।
কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজিস্ট শতদল দাসের সঙ্গে আমরা এই বিষয়ে কথা বলেছিলাম। তিনি জানিয়েছেন, দেশে ও এই রাজ্যে প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স ও ফ্যালসিপরামের প্রজাতির ম্যালেরিয়ার খোঁজই মেলে। প্লাসমোডিয়াম ওভালের সন্ধান মেলে না। বেলডাঙার যুবকের রক্ত পরীক্ষায় ভাইভ্যাক্স ও ফ্যালসিপরামের রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কারণ হতে পারে ওই ব্যক্তির রক্তের Rapid Test হয়েছে। এর ফলে ওই ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া ধরা পড়েনি। তাই এক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার সমস্ত উপসর্গ কোনও মানুষের শরীরে থাকলে, তাঁর রক্তের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করা দরকার, Rapid Test নয়। ওই ব্যক্তির রক্তের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করলেই ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’-এর উপস্থিতি ধরা পড়ত। তবে আমাদের দেশে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ প্রজাতির ম্যালেরিয়া হয় না। তাও সন্দেহের কারণ আছে কারণ ভারত এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ। তাই এই সমস্ত রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারছে। কিন্তু এর ফলে মানুষকে সাবধান হতে হবে, আতঙ্কিত নয়।
‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ কতটা ভয়ঙ্কর ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের 0.1 শতাংশেরও কম প্লাসমোডিয়াম ওভাল-এ আক্রান্ত হন। কিন্তু সময় মতো রোগ নির্ধারণ করতে না পারায় মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এই প্রসঙ্গে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস জানান, “‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’ সংক্রমণ হয় অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে। পশ্চিম আফ্রিকার কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, লাইবেরিয়ার মতো দেশে প্লাসমোডিয়াম ওভালের দেখা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এটা হতই না। তাই এই ঘটনা আমাদের অবাক করছে। তবে ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’, ম্যালেরিয়ার এই বিরল প্রজাতি কোনও মারণ রোগ নয়। ক্লোরোকুইন দিয়েই এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। তবে যাতে মশা না বাড়ে সেই দিকে প্রশাসনের ও সাধারণ মানুষের নজর দিতে হবে। রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। দিনের বেলায়, কাজের সময় পরিবেশ মশামুক্ত করার দিকে নজর দিতে হবে।''
প্লাসমোডিয়াম ওভাল বিষয়ে আবার কোনও কোনও চিকিত্সক বলছেন, এই রোগ একবার শরীরে বাসা বাঁধলে ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই জীবাণু ডিম পাড়ে লিভারে। সেই ডিম ফুটলে আবার জীবাণুর জন্ম হয়ে আবার ম্যালেরিয়া হতেই পারে। ক্লোরোকুইন দেওয়া হয় এই রোগের চিকিৎসায়। প্রাইমারি কুইন নামের ওষুধ দিয়েও মেরে দেওয়া হয় এই জীবাণু।
আরও পড়ুন: মাস্ক পরুন, মাস্ক পরান, নইলে শাসন করুন, না মানলে পরিহার করুন
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ম্যালেরিয়ার নতুন প্রজাতি নিয়ে যখন রাজ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, তখন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। 3 দিন আগে দিল্লি যান তিনি। বেশ কয়েকদিন ধরেই তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। শনিবার তাঁর রক্ত পরীক্ষার পর তাতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গেছে। বঙ্গভবনে চিকিত্সা চলছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের। গতকাল শিলিগুড়িতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ম্যালেরিয়া নিয়ে মানুষকে সচেতন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গে এই সময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হয়। যাদের মশারি কেনার ক্ষমতা নেই, প্রশাসনকে বলছি তাদের মধ্যে মশারি বিতরণ করা হোক। এ ছাড়া, জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, এখন ম্যালেরিয়া জিন চেঞ্জ করছে, ফলে মশা থেকে সাবধানে থাকতে হবে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর মশারি ব্যবহারের নির্দেশকে সমর্থন করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস বলেছেন, ‘মশারি তো রাতে ব্যবহার করা হয়। সেটা করতেই হবে। তবে সারাদিন কাজের সময় যাতে মশার উপদ্রব না থাকে, সেই বিষয়টা প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রশাসনিক স্তরে যে সব পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি সেটা নিতে হবে।'
আমাদের দেশে ম্যালেরিয়াতে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা আগের চাইতে অনেক হ্রাস পেয়েছে। তবে এখনও ভারতে প্রায় 130 কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া রোগের 2 শতাংশ ভারতে হয় এবং বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া মৃত্যুর 2 শতাংশ ভারতে ঘটে। হিসেবে বলছে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় 85.2 শতাংশ ম্যালেরিয়ার বোঝা বহন করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিশ্বব্যাপী প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স প্রজাতির যে ম্যালেরিয়া হয় তার 47 শতাংশ ভারত বহন করে। তবে ভারত ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ভারতে 2019 সালে, 2016-এর তুলনায় 68 লক্ষ কম মানুষের ম্যালেরিয়া হয়েছিল। এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার প্রতি 1,000 জনের মধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা 10 থেকে হ্রাস পেয়ে 4.3-এ নেমে এসেছে। একই সময়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও প্রতি 1,000 জনসংখ্যার নিরিখে 0.018 থেকে 0.006- এ নেমে এসেছে। দেশের 36টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র সাতটি রাজ্যে 90 শতাংশ ম্যালেরিয়া হয়। বাদবাকি রাজ্যে সেই অর্থে ম্যালেরিয়া হয় না। দেশের ও বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসন সচেতন হয়েছে বলেই এই সাফল্য এসেছে। তাই প্লাসমোডিয়াম ওভালের নামে আতঙ্কে না ভুগে সচেতন ও সজাগ হওয়াই হোক প্রশাসনের ও জনসাধারণের প্রধান কাজ।
নোটবন্দির পাঁচ বছর পার। এখনও মানুষের ভরসা নগদ লেনদেনেই।
মৃত্যুর ঘটনাটাকেই অস্বীকার করে তার দায়িত্ব থেকে হাত মুছে ফেলছে কেন্দ্র রাজ্য সমস্ত সরকার
পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
কালী একাধারে সংহার ও সৃজনের দেবী
গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরী হওয়ার বদলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন দলীয় কোন্দলে বিদীর্ণ।
গাড়ির গতি কমিয়েই কলকাতার পথ দুর্ঘটনা ও সেই কারণে মৃত্যু রোখা যায়, মত বিশেষজ্ঞদের।